শেয়ারবাজারের অনিয়ম ও কারসাজির বিষয়ে গত রোববার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি যে তদন্ত কমিটি করেছে, তা শেষ কমিটি নয়। পর্যায়ক্রমে আরও তদন্ত হবে। আরও তদন্ত কমিটি হবে। সব অনিয়মের তদন্ত করে প্রমাণসাপেক্ষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ এমন বক্তব্য দিয়েছেন। রাজধানীর আগারগাঁও বিএসইসি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থান করে যে পরিবর্তনের সূচনা করেছে, তা একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। এমন সুযোগ হয়তো আর পাওয়া যাবে না। তাই তাড়াহুড়ো করে এমন কিছু করতে চান না, যাতে কাজটা ‘কাঁচা’ থেকে যায়।
তিনি আরও বলেন, গত রোববার গঠিত তদন্ত কমিটির মাধ্যমে বিগত দিনগুলোর অনিয়মের খতিয়ান নেওয়া শুরু হচ্ছে। সামনে পরিধি বাড়বে। কী কী অনিয়ম হয়েছে এবং কোন দুর্বলতার কারণে অনিয়ম সংঘটিত, কমিশনের কোনো দায় ছিল কিনা এ সবই বের করা হবে। কমিশনের দায় থাকলে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করা হবে। তদন্ত কমিটি নিশ্চয় সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেবে। শেয়ারবাজারকে স্বচ্ছ ও সবার বিনিয়োগের ভরসার স্থল করতে এর বিকল্প নেই।
তদন্ত কমিটির প্রধান জিয়া ইউ আহমেদ এবং সদস্য ইয়াওয়ার সাইদের প্রত্যক্ষভাবে দুই সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সাংবাদিকরা। এমনকি তদন্ত কমিটিকে যেসব বন্ড এবং কোম্পানির শেয়ার কারসাজি নিয়ে তদন্ত করতে বলা হয়েছে, তাতে দুই সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির বিনিয়োগ ছিল বা এখনও আছে। এ অবস্থায় তদন্ত কমিটির কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অযৌক্তিক হবে কিনা এমন প্রশ্নে বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তদন্তের জন্য জানাবোঝা ও অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। এমন লোকের খুবই অভাব। তারপরও কয়েকজনকে দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেছিলেন। তদন্তে বড় কয়েকটি ব্যবসায়িক গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা থাকা বা অন্য কোনো কারণে তারা অপারগতা প্রকাশ করেন। আবার অনেকে গায়ে কাদা লাগাতে চান না। এ অবস্থায় যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা সাহস করে এগিয়ে এসেছেন। শেয়ারবাজার বিষয়ে তারা অভিজ্ঞ এবং সততার সঙ্গে কাজ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বিএসইসির চেয়ারম্যান আরও বলেন, কমিশন বিশ্বাস করে, তদন্ত কমিটির কোনো সদস্যের আগের কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা তাদের তদন্তে কোনো প্রভাব ফেলবে না। কমিশন তদন্ত কমিটিকে সর্বাত্মক সহায়তা করবে। তবে কোনো প্রকার প্রভাব বিস্তার করবে না। তাছাড়া সাংবাদিকরা তাদের পর্যবেক্ষণে রাখবেন। তথ্য দিয়ে সহায়তা করবেন, যাতে তদন্ত সুষ্ঠু হয়। তদন্ত কমিটির কাজে এমন কোনো বিষয় যদি আসে, যেখানে কমিটির কোনো সদস্যের স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা আছে, সেক্ষেত্রে তদন্তের ওই অংশে তিনি সম্পৃক্ত থাকবেন না।
তদন্ত কমিটির সদস্য ও সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি এইমসের সাবেক এমডি ইয়াওয়ার সাইদ বলেন, ১৯৯৬ সাল এবং ২০১১ সালে শেয়ারবাজারে ধসের পর তদন্ত কমিটির রিপোর্টের পর আর কিছু হয়নি। ওই দুই তদন্ত কমিটির সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। একজন মন্ত্রী বলে দিয়েছিলেন, এদের নাম আনা যাবে না। নাম না এলে তদন্ত করে লাভ নেই।
তিনি বলেন, এবার কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই। তদন্ত কমিটিকে সুনির্দিষ্ট ১২টি ইস্যুতে তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অনিয়ম হয়েছে বলা সহজ কিন্তু তথ্য-প্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা
কঠিন। কঠিন কাজটি তারা সবাই মিলে করবেন, যাতে ফাঁক-ফোকর না থাকে। করতে না পারলে মানুষ ‘প্যান্ট’ খুলে নেবে। তাদের কাজ তারা জানেন। তিনি নিজেও যদি অপরাধী হন, তাহলে তাঁকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে।
তদন্ত কমিটির সদস্য হওয়া নিয়ে প্রশ্নের জবাবে ইয়াওয়ার সাইদ বলেন, ‘গত ২৫ বছরে শেয়ারবাজারে অনেক পীর-দরবেশ দেখেছি। পীর সাহেব থাকলে, তাদের মুরিদও থাকে। তারাই এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। এই ২৫ বছরে শেয়ারবাজার ২৫ কদমও এগোয়নি, উল্টো পেছনে গেছে। এ তদন্ত কমিটি সম্পূর্ণ সৎ ও নিরপেক্ষ থেকে কাজ করবে। বর্তমান বাংলাদেশ গণঅভ্যুত্থানের ফসল। অবসর কাটানোর সময় দেশের প্রয়োজনে ডাক পড়েছে। সুযোগ যখন পেয়েছি, এমন কিছু করে যেতে চাই, যাতে লোকে বলে, ‘ওমুক সময়ে ওমুকরা এটা করে গিয়েছিল’।
সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও তদন্ত কমিটির সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘এখন যে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি, আমাদের জীবনে আর কোনো দিন এমন সুযোগ পাব কিনা সন্দেহ আছে। আমাদের ওপর আস্থা রাখেন। আমাদের দায়বদ্ধতা কেবল দেশ ও মানুষের প্রতি।’
samakal