শেখ হাসিনা, আপনার জয় কি এখন “ওই আমেরিকায়” নাই?

 আমার দেশ
৪ জুন ২০২৩
মাহমুদুর রহমান

মাহমুদুর রহমান

মাহমুদুর রহমান

বেশ কিছুদিন ধরে শরীর খানিকটা বিগরে যাওয়ায় লেখালিখিতে মনোনিবেশ করতে পারছিলাম না। আরো সপ্তাহখানেক বিশ্রামে থাকার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু, শেখ হাসিনার গতকালের বাগাড়ম্বর দৃষ্টিগোচর হওয়ায় মনে হলো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পাঠকদের জন্য তুলে ধরা জরুরী। বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী বাইডেন প্রশাসনের স্যাংশন এবং নতুন ভিসা নীতিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দলীয় সমাবেশে মোক্ষম বচন ঝেড়েছেন। তিনি বলেছেন, “২০ ঘন্টা বিমানে সফর করে এতো মহাদেশ, মহাসাগর পেরিয়ে ‘ওই আমেরিকায়’ না গেলে কি হয়? অন্য মহাদেশ এবং মহাসাগরে আমাদের কত বন্ধু আছে। আমরা সেখানে যাব”। অবৈধ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের উপর আমার মন্তব্য লেখার আগে শেখ হাসিনাকে অনেকগুলো প্রশ্ন করার আছে। এক নম্বর প্রশ্নটা লেখার শিরোনামেই করে ফেলেছি। এবার বাকীগুলো একে একে করা যাক।

২) আমেরিকায় না গেলে যদি আপনার কিছু নাই হয়, তাহলে মাত্র কিছুদিন আগে আপনি সাঙ্গপাঙ্গ ও লুটেরার এক বিশাল দল নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের যে কোন একজন ডেস্ক অফিসার অথবা একজন কংগ্রেসম্যান অথবা সিনেটরের সাথে আলোচনা না হোক, নিদেনপক্ষে একটা ফটোসেশনের সুযোগের জন্য জনগণের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে তীর্থের কাকের মত ওয়াশিংটনে বসে রইলেন কেন? ছেলের সাথেও তো সম্ভবত: এই সফরে আপনার দেখা হয় নাই।

৩) আমেরিকা যদি এতই তুচ্ছ তাহলে আপনার একমাত্র ছেলে এই দীর্ঘ সময় সে দেশে থেকে কি করলো? তার বিয়েটাও তো এক মার্কিনী নারীর সঙ্গেই হয়েছে।

৪) আপনার সেই মার্কিন নাগরিক পুত্রবধু এবং নাতনী কি আটলান্টিকের পারে তাদের নিজ দেশে থাকে নাকি মার্কিন পুলিশের ভয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সংগে অজানা গন্তব্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে? দুষ্ট লোকে বলে, আপনার পুত্র নাকি ভারত, আমিরাত, ফিনল্যান্ড অথবা বেলারুশের কোন এক গোপন, নিরাপদ স্থানে পালিয়ে আছে? কিংবা নিয়মিত স্থান বদল করছে।

৫) আপনার পুত্র জয় পরিবারসহ যদি আমেরিকাতেই বসবাস করে, তাহলে আপনি আমেরিকায় না গেলে তাদের সাথে কেমন করে দেখাসাক্ষাৎই বা করবেন? আপনি এবং আপনার পুত্র বাংলাদেশের সম্পদ লুট করে যে বেসুমার ধনদৌলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশে পাচার করেছেন, সেগুলোরই বা কি হবে? সুতরাং, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণতন্ত্র ধ্বংসের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা বাতিল করলে আপনার অন্তত: হারানোর অনেক কিছুই আছে। অবশ্য, লুটের সব অর্থ যদি ইতিমধ্যে ভারত, চীন এবং রাশিয়ায় চালান করে থাকেন তাহলে হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আপনার না গেলেও চলবে।

৬) আপনার পুত্র এবং পুত্রবধুর মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক ঠিকঠাক আছে তো? বহুদিন তাদের কোন পারিবারিক ছবি কেউ দেখে নাই। আপনার কন্যার পরিবার নিয়েও তো একই রকম ধোঁয়াশা। তার স্বামী কোথায় কেউ জানে না। মার্কিন পুত্রবধুর প্রথমবার বাংলাদেশ সফরের সময় তো আওয়ামী লীগের কর্মীদের দিয়ে বিমানবন্দর থেকে দীর্ঘ পথে নানারকম ফুল ছিটানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তারপর তো তাদের আর কোন হদিস নাই। একমাত্র নাতনী তো বোধহয় আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে পা দেয় নাই। আমেরিকার প্রতি আপনার এতো বিরাগ! সেক্ষেত্রে, পুত্র, পুত্রবধু এবং নাতনীকে বাংলাদেশে নিজের কাছে নিয়ে আসছেন না কেন?

৭) যতদূর জানি, আপনার বোন শেখ রেহানা এবং তার সকল পুত্রকন্যা পশ্চিমা দেশেরই নাগরিক এবং তাদের স্ত্রী ও স্বামীদের প্রত্যেকেই অমুসলিম, বিদেশী নাগরিক। ‘হাজার বছরের সেরা বাঙালীর’ ভুয়া দাবিদারের সকল নাতিনাতনী (শেখ হাসিনার কন্যা পুতুল ব্যতীত) বিয়ে করার জন্য সদলবলে অবাঙালী বেছে নিয়েছে, বাঙালিত্বের শ্লোগানের সাথে এমন বৈপরিত্যের ব্যাখ্যা জাতিকে আপনি জানাবেন কি?

যাই হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত, আপনিসহ পরিবারের সদস্যদের ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলে, সত্যিই কি আপনাদের কিছু যায়-আসে না? আপনি কি নিশ্চিত যে, মার্কিন ভিসা বাতিলের কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া ইউরোপে শেখ পরিবারের সদস্যদের উপর পড়বে না?

৮) যে সকল সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, বিচারকবৃন্দ, ইলেকশন কমিশনের কর্তাব্যক্তি, লুটেরা আওয়ামী ব্যবসায়ী, ফ্যাসিস্ট সরকারের মন্ত্রিকুল এবং ভোটবিহীন সংসদ সদস্যবৃন্দ শেখ হাসিনার যাবতীয় অপকর্মের সহযোগী, তাদের মধ্যে এক বিরাট অংশ লুটপাট করা সম্পদের বৃহৎ অংশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশেই বিনিয়োগ করেছে অথবা ব্যাংকে আমানত রেখেছে। শেখ হাসিনা আপনি কি এদেরকে জিজ্ঞাসা করেছেন যে, মার্কিন ভিসা বাতিল হলে তাদের কিছু যায়-আসে কিনা? পাঠকদের মনে থাকার কথা যে, জামালপুরের চূড়ান্ত অসভ্য পাতি মন্ত্রি মুরাদ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে কানাডায় আশ্রয় নিতে গেলে তাকে টরোন্টোর বিমান বন্দরে কানাডীয় পুলিশ গ্রেফতার করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছিল। কানাডায় পরিবার এবং বাড়ি থাকা স্বত্ত্বেও মুরাদকে ইমিগ্রেসন পার হতে দেওয়া হয় নাই। মার্কিন স্যাংশনপ্রাপ্ত, একসময়ের ডাকসাইটে আইজিপি, খুনি বেনজির আহমেদ এখন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন? হাসিনা সরকারের আরো কতজনকে মুরাদ এবং বেনজিরের ভাগ্য বরণ করতে হবে সেটা আমাদের জানতে খুব বেশিদিন বোধহয় অপেক্ষা করতে হবে না।

৯) আপনি যে প্রায়ই বাইডেন প্রশাসনকে মার্কিন পণ্য না কেনার হুমকি দিয়ে থাকেন, আপনার কি বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ সম্পর্কে কোনরকম ধারনা আছে? আপনাকে পরিসংখ্যান দিয়ে একটু সাহায্য করি। ২০২২ সালে বাংলাদেশ আমেরিকায় ১০ বিলিয়ন ডলারের অধিক পণ্য রপ্তানি করেছে যার বিপরীতে শেখ হাসিনার কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ “ওই আমেরিকা” থেকে আমদানির পরিমাণ মাত্র ২.৮ বিলিয়ন ডলার। একক দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য রফতানি করে থাকে। গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্সও এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগের হিসাবেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক নম্বরে। এমন একটি উপকারী রাষ্ট্রকে চরম শত্রু বানিয়ে আপনি কি বিদায়ের আগে বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়ে যেতে চাচ্ছেন?

১০) আপনার মন্ত্রিরা গত কয়েকদিন ধরে একজোট হয়ে মার্কিন ভিসা নীতির ভূয়সী প্রশংসা করার পর আপনি আবার হঠাৎ করে উল্টো গীত গাইছেন কেন? মন্ত্রিরা তো সমস্বরে বলছিল, ভিসা নীতিতে নাকি আপনারা নন, বিএনপি বিপদে পড়েছে। আজ দেখলাম ১৪ দল সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছে যে, মার্কিন ভিসা নীতি দূরভিসন্ধিমূলক। জনগণ কার কথাকে সরকারী নীতি বলে মানবে? ক্ষমতা হারানোর আতংকে আপনারা কি সকলেই উন্মাদ হয়ে গেলেন?

শেখ হাসিনার কাছ থেকে আমার কোন প্রশ্নেরই জবাব মেলার কোন সম্ভাবনা নাই। তিনি যে কোন মূল্য অবৈধ ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চাচ্ছেন। তবে সময় তার পক্ষে নেই। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ভুয়া নির্বাচন তৎকালিন মার্কিন প্রশাসন মেনে নিলেও এবারের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। একদিকে ইসলামী জঙ্গী কার্ডের কার্যকারিতা শেষ হয়ে গেছে। অপর দিকে, নয়া দিল্লিও আগের সেই শক্তিশালী রাজনৈতিক অবস্থানে নেই যে, ওয়াশিংটনকে হাসিনার পক্ষে ম্যানেজ করে ফেলবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে চীন এবং রাশিয়ার প্রভাব এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ভারতের স্তরে পৌঁছাতে পারেনি।

সুতরাং, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও সকল দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে ওয়াশিংটন ও অন্যান্য পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূ্হ নীতিগত এবং শক্ত অবস্থান নিলে চীন, রাশিয়া ও ভারতের সমর্থন নিয়ে তাকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা শেখ হাসিনার যে নাই সেটা তিনিও বুঝতে পারছেন। কদিন আগে বিবিসিতে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরাতে চায়। এই সব হতাশা থেকেই শেখ হাসিনা এখন রীতিমত প্রলাপ বকছেন। তার বরকন্দাজরাও প্রকৃত অবস্থা ঠিকমত বুঝতে না পেরে সংশয়ের মধ্যে আছে। বাংলাদেশের জনগণ মুক্তি ত্বরান্বিত করতে চাইলে আর বিলম্ব না করে তাদের সাহস করে ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নেমে আসা উচিৎ। শেখ হাসিনার পতনের ঘন্টা বেজে গেছে।

লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ

০৪/০৬/২০২৩

1 COMMENT

Comments are closed.