- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৪ মে ২০২৩, ২৩:৩৮
রোহিত শর্মা এখনো ভারতের হয়ে খেলেন। তিনি ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। ভিরাট কোহলিও তিন ফরম্যাটেই ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার। এই দুজনের মাঝেই নিজেকে আলাদা করে চেনাচ্ছেন ভারতের তরুণ সেনসেশন শুভমন গিল।
তিনিই ২০২৩ সালে ভারতের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান। অনেকেই তাই মনে করছে, তিনিই ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ।
ক্রিকেট সমর্থকদের মধ্যে এই প্রবণতা থাকে। তারা কোনো কিংবদন্তী ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার শেষে কে তার জায়গা নেবেন তা খোঁজা শুরু করে দেন। যেমন সাচিন টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ারের শেষ দিকে ভিরাট কোহলিকে বলা হতো নতুন সাচিন। শুভমন গিলকে তেমন মনে করা হচ্ছে কোহলির জায়গা নিয়ে নেবেন।
বিবিসি নিউজ অনলাইনে সুরেশ মেনন লিখেছেন, ‘প্রায় এক দশক আগে যেদিন সাচিন টেন্ডুলকার তার শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলছেন এবং শেষবারের মতো আউট হলেন। তিনি প্যাভিলিয়নে যেতে যেতে ভিরাট কোহলি ব্যাট হাতে নামলেন এবং প্রথম বলেই চার হাঁকালেন। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামেই তখন আওয়াজ উঠেছিল, উত্তরসূরী তৈরি’।
গিল কেন আলোচনায়
শুভমন গিলকেও ভাবা হচ্ছে তেমনই একজন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৯৭ বলে ১১৬ রান, এরপর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪৯ বলে ২০৮ রান এবং ৭৮ বলে ১১২।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৬৩ বলে অপরাজিত ১২৬ রান। শুভমন গিল টেস্ট ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এ বছরই ২৩৫ বল খেলে ১২৮ রান তুলেছিলেন। সর্বশেষ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে গুজরাট টাইটান্সের হয়ে দুটি ম্যাচ জেতানো শতক হাঁকান।
ওয়ানডে ক্রিকেটের সবচেয়ে তরুণ ডাবল সেঞ্চুরিয়ান তিনিই এবং একইসাথে ভারতের সবচেয়ে কম বয়সে টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরির মালিকও তিনি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে ওয়ানডে ফরম্যাটে শুভমন গিল ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি রানের মালিক।
এ বছর তিনি নয় ম্যাচে ৭৮ গড়ে ৬২৪ রান তুলেছেন, ১১৭ স্ট্রাইক রেটে। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ছয় ম্যাচে তুলেছেন ২০২ রান, ৪০ গড় ও ১৬৫ স্ট্রাইক রেটে।
তবে তাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরকে আইপিএল থেকে বিদায় করে দেয়া এক সেঞ্চুরি হাঁকানোর পর।
শুভমন গিলের উঠে আসা
অনুর্ধ্ব-১৯ পর্যায় থেকেই শুভমন গিলকে নিয়ে ভারতের নির্বাচকদের মধ্যে আশাবাদের কথা শোনা যেত। ২০১৮ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষ শতক হাঁকানোর পর তিনি জাতীয় পর্যায়েও প্রশংসা পেতে শুরু করেন, তখন থেকেই ভারতের সময়ের সেরা ক্রিকেটার ভিরাট কোহলির সাথে শুভমনের তুলনা দেয়া শুরু করেন ক্রিকেট পণ্ডিতরা।
সে বছর ক্রিকেটের যুব বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়েই গিলকে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের দল কলকাতা নাইট রাইডার্স কিনে নিয়েছিল ১ দশমিক ৮ কোটি রুপি দিয়ে। গত চার বছর ধরে তিনি ছিলেন একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে যার সুফল তিনি চলতি বছর পাচ্ছেন।
শুভমন গিলকে নিয়ে কে কী বলছেন
ইএসপিএন ক্রিকইনফোর একটি বিশ্লেষণে ক্রিকেট লেখক সিদ্ধার্থ মোঙ্গা লিখেছেন, ‘গিলের নিয়ন্ত্রণ খুবই ভালো, বলের সাথে ব্যাটের বেশিরভাগ সংযোগই ঘটে ব্যাটের মাঝ বরাবর এবং কোথায় ফিল্ডার নেই সেটা গিল খুব সহজেই বের করে ফেলতে পারেন’।
৬ মারার সামর্থ্যও গিলের দারুণ, ব্যাঙ্গালোরের বিপক্ষে ম্যাচটিতে একটি বল স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে এতো সাবলীলভাবে ছক্কা মারেন, ধারাভাষ্যকাররা বলছিলেন, ‘এটা বারবার হাইলাইটস দেখলেও মন ভরবে না’। এই ম্যাচে জয় ও হারের মধ্যে তফাৎ গড়ে দেয় কোহলি ও গিলের শতক।
ম্যাচের পরে বিশ্লেষণে সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার টম মুডি বলেন, ‘দুটি শতকই ছিল দুর্দান্ত কিন্তু দেখেন কোহলির ইনিংসে ছিল একটি ছক্কা, গিল মেরেছেন আটটি ছক্কা। এখানেই পার্থক্যটা বড় হয়ে ওঠে’।
২০০ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করে সেঞ্চুরি তুলেছেন শুভমন গিল।
ভারতের ক্রিকেট বিশ্লেষক দীপ দাশগুপ্তা বলেন, ‘কখনোই গিলকে বিচলিত মনে হয় না, তার মন স্থির একইসাথে ব্যাট করার ধরনটা খুবই সাবলীল। এটা তাকে স্পেশাল করে তোলে’।
সিদ্ধার্থ মোঙ্গা তার লেখায় শুভমন গিলকে নিয়ে লিখেছেন, ‘গিলের মধ্যে একটা বিরল প্রতিভা রয়েছে, তিনি তার শারীরিক আচরণের মধ্য দিয়ে সময়কে ধীরে বইতে দিতে পারেন। কেমন আলসে ভঙ্গিমায় তিনি ব্যাট করছেন ৪ মারছেন কভার বা স্কয়ার অঞ্চল দিয়ে এই সময়ের সুবিধাও গিলই পান।’
সিদ্ধার্থ মোঙ্গা লিখেছেন, ‘তিনি (গিল) অন্যদের চেয়ে অন্তত পাঁচ মিলিসেকেন্ড আগেই বলের লাইন লেন্থ বুঝে ফেলতে পারেন, এটা অনেক পরিশ্রমের ফসল, একে মাসল মেমোরি বলা হয়।’
সুরেশ মেননও একই সুরে বিবিসি নিউজ অনলাইনে লিখেছেন, ‘গিলের ব্যাটিংয়ে শক্তির সাথে নান্দনিকতার একটা মিশেল রয়েছে, এতে সবকিছুই খুব সহজ মন হয়। গিল পুল খেলতে ভালোবাসেন, কভার ড্রাইভটা তার মতো সুন্দর করে খুব কম ব্যাটারই খেলতে পারেন এখন’।
মেনন লিখেছেন, ‘শুভমন গিল শান্ত ও নিয়ন্ত্রিত এক ভঙ্গিমায় ব্যাট চালান যা দর্শকের চোখের জন্য প্রশান্তিদায়ক, কখনো কখনো বোলারও তার দর্শক বনে যান’।
টেস্ট ক্রিকেটে এখনো ‘প্রতিষ্ঠিত নন’
গিল টেস্ট ক্রিকেটে এখনো ঠিক সেই ব্যাটার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হননি। যার অপেক্ষায় রয়েছে প্রায় এক বিলিয়ন লোক। যারা গিলকে সাচিন বা কোহলির জায়গায় দেখতে চাইবেন।
লেখক সুরেশ মেনন বিশ্বাস করেন, ‘সামনে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল রয়েছে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে, এই ম্যাচটায় হয়তো গিল নিজেকে টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন’।
টেস্ট ক্রিকেটে গিলের অভিষেকও হয়েছে খুবই বিপর্যস্ত এক পরিস্থিতিতে। যে সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারত ৩৬ রানে অলআউট হয়ে গিয়েছিল মাত্র ৪০ মিনিটের মাথায়, এই ম্যাচে প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্ক ও জশ হ্যাজলউড বল দিয়ে যা চাইছেন তাই করে দেখাচ্ছিলেন।
মজার কথা হচ্ছে, ওই সিরিজে ভারত শেষ পর্যন্ত জিতেছিল ২-১ ব্যবধানে, টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসেরই ‘সেরা কামব্যাক’ বলেন অনেকেই।
ওই সিরিজে শুভমন গিলের ছোট কিন্তু কার্যকরী কিছু ভূমিকা ছিল। যেমন দ্বিতীয় টেস্টে লো স্কোরিং একটা ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ৪৫ রান, চতুর্থ টেস্টে ৩২৮ রান তাড়া করতে নেমে গিলেন ৯১ রান, এই সিরিজে ঋষভ পন্ত এতোটাই নাটকীয় সব মুহূর্ত উপহার দিয়েছিলেন যে গ্যাবায় ভারতের রেকর্ড গড়া ওই জয়ের ইনিংসে যে শুভমন গিল সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক এটা অনেক সময় খেয়ালই করা হয়ে ওঠে না।
গিলের অভিষেক সিরিজ নিয়ে বোরিয়া মজুমদার ইএসপিএন ক্রিকইনফোতেন লিখেছিলেন, ‘গিল সিমেন্টের উইকেটে অনুশীলন করেছেন এতে করে তার কব্জির জোর বেড়েছে, ব্যাকফুট শটও ভালো হয়েছে। এই কদিন আগেও তাকে বিস্ময় বালক বলা হতো এখন সে ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা টেস্ট জয়ের কারিগর’।
টেস্ট ক্রিকেটে শুভমন গিল নিজের দক্ষতা বাড়াতে গত বছর কাউন্টি ক্রিকেটেও নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন, যুক্তরাজ্যে গ্ল্যামরগানের হয়ে চারদিনের ম্যাচ খেলে সেঞ্চুরি পেয়েছেন প্রথম ইনিংসেই।
শুভমন গিলের ক্যারিয়ারে এখন আর দৃশ্যমান কোনো বাধা নেই। যদি না ভারতের অতি উৎসাহী ক্রিকেট পাগল সমর্থক গোষ্ঠী কিংবা অতি বিশ্লেষণ তাকে মানসিকভাবে বিচলিত করে।
তবে শুভমন গিল নিশ্চিতভাবেই জানেন, উপমহাদেশের ক্রিকেটে এসব বিষয় স্বাভাবিক এবং এটা পেশার অংশ। ভারতের ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে দ্রুততম সময়ে এক হাজার রান তোলার রেকর্ডটি তিনি করে ফেলেছেন।
ভারতের ক্রিকেট এখন একটা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে বা আরো যাবে বলেই ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। ইতোমধ্যে ভারতের সাবেক কোচ রাভি শাস্ত্রী ইএসপিএন ক্রিকইনফোতে নিজের বিশ্লেষণে বলে দিয়েছেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তিনি একদম তরুণদের নিয়ে একটা দল দেখতে চান এখন। ভারতের জাতীয় টি-টোয়েন্টি একাদশে অনেক বেশি ক্রিকেটার অ্যাংকর রোলে খেলতে পছন্দ করেন।
সিদ্ধার্থ মোঙ্গা লিখেছেন, শুভমন গিল অ্যাংকর রোলের সংজ্ঞা বদলে দিচ্ছেন, তিনি ২০০ স্ট্রাইক রেটে অ্যাংকর রোল খেলতে পারেন।
আর ভারতীয় ক্রিকেটে শুভমনের আগমনী বার্তাও তিনি নিজেই গত সপ্তাহে টুইটারে দিয়ে রেখেছেন। সেঞ্চুরির পর নিজের ছবি আপলোড করে লিখেছেন, ‘এটা শুরু হলো কেবলই’।
সূত্র : বিবিসি