চলমান কোটা বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিরা চিকিৎসা নিতে এসেছেন ঢামেকে। তাদের কারও মাথায় গুলি, কারও হাতে-পায়ে, কারও বুকে-পেটে। আহতদের বেশির ভাগই ছিল গুলিবিদ্ধ। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থী, পথচারী, ব্যবসায়ী, রিকশাচালকসহ নানা পেশার মানুষ রয়েছেন। হাসপাতালে আসার পর চিকিৎসকরা কাউকে মৃত ঘোষণা করছেন আবার কাউকে জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন। কেউ কেউ চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে। গুরুতর আহত অনেকে ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ রোগী। আহতরা কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বেডে। আকুতি জানাচ্ছেন সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে থাকা সংশ্লিষ্টরা বলেন, ঢামেকের মর্গে এ পর্যন্ত ৯৩টি লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে।
হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ১৫ই জুলাই জরুরি বিভাগ দিয়ে টিকিট কেটে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩০৬ জন রোগী। এরমধ্যে গুরুতর আহত হওয়া ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ১৩ জন। ১৬ই জুলাই চিকিৎসা নিয়েছেন ৬৫ জন এবং ভর্তি হন ৮ জন। ১৮ই জুলাই চিকিৎসা নিয়েছেন ২৭৬ জন, ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৮৭ জন এবং মৃতের সংখ্যা ১১ জন। ১৯শে জুলাই চিকিৎসা নিয়েছেন ৪৮২ জন, ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১৫৫ জন এবং মৃতের সংখ্যা ৪১ জন। ২০শে জুলাই চিকিৎসা নিয়েছেন ১৮৯ জন, ভর্তি হয়েছেন ৭৬ জন এবং সংখ্য ১৩। ২১শে জুলাই চিকিৎসা নেন ৯৩ জন, ভর্তি হয়েছেন ২০ জন এবং লাশের সংখ্যা ৯। এরপর থেকে ঢাকার অন্যান্য হাসপাতাল থেকে আহত অনেকে এসেছেন ঢামেকে চিকিৎসার জন্য। সংশ্লিষ্টরা জানান, গতকাল দুপুর পর্যন্ত ঢামেকের মর্গে ৯৩ জনের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে অজ্ঞাত ৮ জনের মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে আঞ্জুমান মফিদুলে।
ঢামেকের মর্গে সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, সংঘর্ষের ঘটনায় ১৯শে জুলাই বাড্ডায় গুলিবিদ্ধ হন পোশাক শ্রমিক ইয়ামিন। গার্মেন্টস থেকে বাসায় ফেরার সময় এই তরুণের পেটের নিচে ডান পাশে ও হাতে গুলি লাগে। ঢামেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার বেলা এগারোটার দিকে মৃত্যু হয় তার। ইয়ামিনের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন থানার কাঞ্চনপুর গ্রামে। অভাবের কারণে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান তার বাবা রতন চৌধুরী। বাড্ডার হাসান উদ্দিন রোডে ৭ হাজার টাকার একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা। সন্তানের লাশ পেতে রোববারও অপেক্ষারত ছিলেন ইয়ামিনের বাবা।
ইয়ামিনের বাবা রতন চৌধুরী বলেন, আমরা এই আঘাত নিতে পারছি না। এত ঘণ্টা হয়ে গেছে তবুও লাশটা পাচ্ছি না। আমার দুই ছেলের মধ্যে এই ছেলে ছোট। আমি কোনো কাজ করতে পারি না। দুই ছেলের আয়ে সংসার চলতো। এখন কী হবে। আজ এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল কিছু মুখে দিতে পারছি না। আমি কী নিয়ে বাঁচবো। মারা যাওয়ার পরে লাশ হাতে পাবো সেটাতেও হয়রানি। আমরা কোথায় যাবো? সন্তানের লাশ নিতে এক থানা থেকে আরেক থানায় ঘুরতে হচ্ছে। শনিবার সকাল সাড়ে এগারোটায় মারা যায় এবং সাড়ে বারোটায় লাশ মর্গে নেয়। বাড্ডা থানা থেকে রাত ১টার সময় দারোগা নিয়ে এখানে এসেছি। আইনি জটিলতা শেষ করে সাড়ে ৩টায় বাসায় গিয়েছি। আবার ৭টা বাজে থানায় গিয়েছি। এরপর ১১টায় এখানে এসেছি। এখন দুপুর হয়ে গেছে ছেলের লাশের অপেক্ষায় বসে আছি। ময়নাতদন্ত শেষে গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে নিয়ে যাবো।
১৯ তারিখে বাসা থেকে খাবার খেয়ে বের হলে রামপুরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় বিশ বছর বয়সী ইমতিয়াজ। পরে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিলে অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য সোমবার ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার ভোর ৪টার দিকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) তার মৃত্যু হয়। সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির বিবিএ’র শিক্ষার্থী ছিলেন। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণে যশোর থেকে এসেছিলেন ঢাকায়। নিহত ইমতিয়াজের বাবা নওশের বলেন, আমি তো বাবা কীভাবে সন্তানের লাশ কাঁধে নিবো? আমার ছেলের কোমরের নিচে পাশে দুইটা গুলি লাগে। আমি কৃষিকাজ করলেও আমার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবো।
যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার মাইন উদ্দিন (২৪) নামে আরেক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। সে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিল। নিহতের বাবা মো. কামরুল ইসলাম বলেন, আমার ছেলে যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় একটি টিউশনি শেষ করে বাসায় ফেরার পথে তার হঠাৎ গুলি লাগে। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে এলে ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার রাত ২টার দিকে ছেলেটি মারা যায়। আমাদের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায়। বর্তমানে যাত্রাবাড়ী রায়েরবাগ এলাকায় থাকি।
শুক্রবার বিকালে নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটি এলাকায় বাসার ছাদে খেলতে গিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিল ৬ বছরের শিশু রিয়া গোপ। পাঁচদিন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন থেকে বুধবার মারা যায় সে। একমাত্র মেয়েটির লাশ স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়ার সময় কথাও বলতে পারছিলেন না শিশুটির বাবা দীপক কুমার গোপ।
পাঁচদিন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন থেকে মঙ্গলবার রাতে মৃত্যু হয় শাহজাহানের। তিনি ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি ছিলেন। বাসায় ফেরার পথে শুক্রবার বিকালে মহাখালীতে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। দু’দিন ধরে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পড়েছিল তার লাশ। শাহজাহানের মৃত্যুর পর থেকে মর্গের সামনে লাশ নেয়ার অপেক্ষায় ছিলেন তার স্বজনেরা। একমাত্র ছেলে হারানোর শোকে থামছিল না মায়ের কান্না। বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা পর্যন্তও হয়নি শাহজাহানের ময়নাতদন্ত। তখনো দেখা যায় স্বজনদের অধীর অপেক্ষা। মর্গের সামনে আহাজারি করছিলেন শাহজাহানের মা। শাহজাহানের মা বলেন, আমার সব শেষ। কি হবে আমার? কোথায় পাবো এর বিচার। আমার পাখিটা নিয়ে গেল।
শনিবার ময়মনসিংহ থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢামেকে আসেন জামান মিয়া (২২)। তিনি সেখানে একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত ছিলেন। ঢামেকের জরুরি বিভাগের আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার মারা যান। নিহত জামানের চাচাতো বোন মার্জিয়া বলেন, আমার ভাই ময়মনসিংহের নান্দাইলে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতো। শনিবার বিকালে গার্মেন্টস থেকে বের হওয়ার পর তার গুলি লাগে। স্থানীয় একটি হাসপাতালে দেখানোর পর তাকে রাতে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। এখানে ভর্তির ৫ দিন পর আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভাইয়ের মৃত্যু হয়।
Manabzamin