- মইনুল হোসেন
- ০৩ মার্চ ২০২১
বিকৃত আইনি ব্যবস্থার কারণে নিরপরাধ ব্যক্তিদের হত্যার বিরুদ্ধে আমাদের বিবেক প্রতিবাদী হোক, বিদ্রোহী হয়ে উঠুক। আসামি লেখক মুশতাক আহমেদের সরকারি হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণের ঘটনায় আন্তর্জাতিকভাবে ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা সরকারের কাছে সুষ্ঠু তদন্তের দাবিও জানিয়েছে। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মাইকেল বেচেলেটও মুশতাকের মৃত্যু নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছেন।
সাধারণ লোককে থানায় নিয়ে পিটিয়ে মারা তো কিছুই নয়। কিছু দিন আগে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে কক্সবাজারে প্রাইভেট গাড়ি থেকে নামিয়ে এনে গুলি করে হত্যা করা হয় পরিকল্পিতভাবে। আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো, ভিন্নমত প্রকাশের জন্য সরকারের কাছে সংবিধানস্বীকৃত অধিকারের কোনো মূল্য নেই। নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করতে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা অভিযুক্তদেরও আইনি নিরাপত্তা নেই। আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে খুন, গুম বা হত্যার রাজনীতির দায়-দায়িত্ব অস্বীকারের সুযোগ থাকে। কিন্তু বিচারাধীন ব্যক্তিদের পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা অস্বীকার করার উপায় নেই। অর্থাৎ সরকারি লোকদের জন্য মামলার আসামিকে বিনা জামিনে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো, এমনকি মৃত্যু ঘটাতেও আদালতকে আমলে নিতে হয় না। আমরা এত অসহায় যে বিচারাধীন ব্যক্তির আইনবহির্ভূত হত্যাও সম্ভব হচ্ছে। বিদেশীদের এ জাতীয় মৃত্যুর তদন্ত দাবি করতে হয়। বহির্বিশে^ আমাদের সরকারকে কতটা বর্বর মনে করা হচ্ছে, তা ভেবে দেখতে হবে। লেখক মুশতাকের মৃত্যুর ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে তদন্ত হওয়া যেকোনো মর্যাদাসম্পন্ন সরকারের জন্য চরম বিব্রতকর। তারপরও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়ার নিশ্চয়তা নেই।
এসব মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত পুলিশ এবং সরকারের বাহিনীবিশেষের জানা থাকা উচিত যে, রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সুরক্ষা পাবার কোনো আইনগত সুযোগ নেই। সংঘটিত অপরাধের দায়ভার ব্যক্তিগতভাবে এড়িয়ে যাবার নয়। আমাদের এটাও অজানা নয় যে, নিষ্ঠুর সরকারি ব্যবস্থার পরিণতি কতটা নিষ্ঠুর হয়। তাই নীতি হওয়া উচিত, অন্তত নিজে বাঁচো এবং অন্যকে বাঁচতে দাও।
ভাগ্যাহত লেখক মুশতাকের মৃত্যুতে আন্তর্জাতিক বিবেকবোধের জাগরণ দেখার পর আমাদের বিচারব্যবস্থার উচিত জামিনের ব্যাপারে বাস্তবভিত্তিক একটা মানবিক অবস্থান গ্রহণ করা। কতিপয় লোকের অতি উৎসাহের কারণে মুশতাকের এমন মৃত্যু হয়েছে এবং মলিন হয়েছে পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার ভাবমর্যাদা। বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অন্ধ দাপট দেখানো হয়েছে। লেখক মুশতাককে তো আইনি প্রক্রিয়ায় গ্রেফতার করে বিচারের ব্যবস্থা সরকারই গ্রহণ করেছিল।
যতই গুরুতর অভিযোগ দেখিয়ে জামিন নামঞ্জুর করা হোক না কেন, পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে আইনের চোখে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে বেআইনিভাবে হত্যা করা হয়েছে। অন্যভাবে দেখার কোনো উপায় নেই। লেখক মুশতাকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বা খুনের কোনো অভিযোগ ছিল না। যেখানে রাজনৈতিক বিবেচনায় করা মামলায় পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে; সেখানে বিচার বিভাগকে জামিন নামঞ্জুর এবং পুলিশের কাছে রিমান্ড দেয়ার ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
বিচারব্যবস্থার প্রতি অবজ্ঞা দেখানোর প্রকাশ্য সাহস গ্রহণীয় নয়। আমাদের মেরুদণ্ডহীনতা নিজেদের দুর্ভোগের জন্য দায়ী। দুর্বল হয়েও সরকার ক্ষমতাধরসুলভ শক্তি দেখাচ্ছে। সরকারের নিজস্ব শক্তিতে তো ক্ষমতায় থাকার কথা নয়।
পুলিশের ওপর নির্ভর করে এ কথা বলা যে, ‘পুলিশ রিপোর্টে তোমার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তাই আইনের চোখে নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও তোমাকে কারাজীবন ভোগ করতে হবে।’ অথচ বিচারব্যবস্থার মূল কথা যে কোনো অভিযুক্তই নির্দোষ যতক্ষণ না বিচারে কোর্ট তাকে দোষী সাব্যস্ত করে। তারপরও জামিন না দিয়ে জেল খাটানো অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে বিচারব্যবস্থার চিন্তা-ভাবনায় বিবেকপ্রাণিত সংস্কার আনতে হবে।
ব্যক্তিস্বাধীনতা, মৌলিক অধিকারসমূহ রক্ষার নিশ্চয়তা বর্তমান শাসনতন্ত্রেরও অঙ্গীকার। আমাদের সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে নির্যাতন নিষেধ করা হয়েছে। পুলিশ হেফাজতে বা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারটি আদালতের অনুমোদনের ব্যাপার। কাউকে পুলিশ রিমান্ডে নিতে আদালতের অনুমোদন পাওয়া সরকারের জন্য কোনো বিষয়ই নয়। বিচারপ্রক্রিয়া জনগণকে আইনের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য, সরকারের ইচ্ছা পালনের জন্য নয়। এটি না হলে বিচারব্যবস্থা আর বিচারব্যবস্থা থাকে না।
বিচারকদের অনেকেই চিরাচরিতভাবে এটা ভাবতে অভ্যস্ত যে, পুলিশকে সাহায্য করতে হবে। তারা প্রায়শ ভুলে যান যে, পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে মানুষকে সাহায্য করতেই বিচারব্যবস্থা।
অস্বীকার করব না যে, জামিনের বিরুদ্ধে জনমনে এক ধরনের কুসংস্কার রয়েছে। জনগণের ধারণা শেষ পর্যন্ত বিচার যখন হবে না তাই বিনা জামিনে জেলে থাকার সাজা ভোগ করুক। এরূপ ধারণা সাংবাদিকসহ অনেকের মধ্যেই রয়েছে যে, মামলা দেয়ার অর্থই হচ্ছে জামিনে মুক্তি না পাওয়া। এ ধরনের নির্মম চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। অভিযোগ আনলেই যদি কাউকে জেল খাটতে হয়, তা হলে সাক্ষ্য-প্রমাণ এনে বিচার করার কী প্রয়োজন?
আমাদের ভেতরকার অনেকে অতীতের সম্মানজনক দিনগুলোর কথা ভুলে গিয়ে বর্তমান ব্যবস্থার অধীনে নতুন গণবিরোধী আচরণকে গ্রহণ করার বিষয়টি সহজভাবে দেখছেন। ফলে আমরা গণবিরোধী সরকারই পেতে থাকব। বিচারব্যবস্থা এ ধরনের অবিচারমূলক চিন্তা-ভাবনার অংশীদার হতে পারে না।
অভিযুক্ত ব্যক্তির অতীত রেকর্ড যদি বলে লোকটি সমাজের জন্য বিপজ্জনক সে ক্ষেত্রে জামিন নামঞ্জুর করা জনস্বার্থে অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। বিদ্যমান বাস্তবতায় বিচারব্যবস্থা যদি জীবনের নিরাপত্তায় আদৌ আইনি সুরক্ষা দিতে না পারে, তবে তাকে বিচারব্যবস্থা বলা যাবে না।
আমার হাতে যদি ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব থাকত তাহলে আমি বিচারাধীন সব বন্দীকে মুক্তি দিয়ে দিতাম, কারণ আইনের চোখে তারা অপরাধী নয়। সমাজের জন্য কেউ যদি বিপজ্জনক বিবেচিত হয়; তবে তাকে জামিনে মুক্তি না দিয়ে জনস্বার্থে তার বিচার ত্বরান্বিত করা হতো। তদুপরি জামিন পাওয়ার অর্থ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নয়। বলা হয় যে, সে আদালতের হেফাজতে আছে। জামিনে থাকা অবস্থায় কোনো অপরাধ করলে তার পক্ষে পুনরায় জামিনে মুক্তি অসম্ভব হয়ে পড়ে।
তাদের জামিনে মুক্তি দেয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। বরং আদালত মিথ্যা মামলার বোঝা মুক্ত হবে। আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় পুলিশকে ব্যবহার করে অশান্তি সৃষ্টি করাই তাদের কাজ। আমলাতান্ত্রিক সরকার হলো জেলে পাঠানোর সরকার।
আমাদের বিচারব্যবস্থার অপব্যবহার হচ্ছে দু’ভাবে। প্রথমত, জামিন নামঞ্জুর করে এবং দ্বিতীয়ত, আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে পুলিশের হাতে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেয়ার কারণে।
বিচারব্যবস্থাকে জজ-বিচারকরা নিজেরাই মেরুদণ্ডহীন করে দিতে পারেন না। আমরা সবাই মিলে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সৎ সাহস দেখালে সমাজ থেকে ভয়-ভীতির আতঙ্ক অনেকাংশে বিলুপ্ত হবে। ভয়-ভীতির ভিত্তির ওপর তখন আর সরকার নির্ভরশীল থাকবে না।
সংবিধানবর্ণিত বিচারের নীতিমালার প্রতি নিম্ন আদালত ও পুলিশকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। অন্যেরা সংবিধানের কথা বলে অসাংবিধানিক সরকার চালাতে পারে। কিন্তু সংবিধানের বাইরে বিচারকদের নিজস্ব অস্তিত্ব থাকে না।
একটা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালনের কারণে সমাজে বিচারকদের মহাসম্মানজনক অবস্থান দেয়া হয়। আন্তর্জাতিকভাবে তারা একা নন। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে প্রতিটি দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর। স্বীকার করছি আমাদের সুপ্রিম কোর্টের ওপর জনগণের কিছুটা আস্থা এখনো রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে বিচারপতিরা বিচারব্যবস্থার মানবিক দিক রক্ষার কিছুটা হলেও চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সার্বিকভাবে বিচার বিভাগ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিতে পারছে না। যার জন্য নিম্ন আদালতগুলো চলছে আইন মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছায়।
ভয়-ভীতির সংক্রামক ব্যাধির অস্তিত্ব থাকার কারণে ভয়-ভীতি রয়েছে সবার মধ্যেই। তবুও আমরা তো এখনো কঠিন পুলিশি রাষ্ট্রে বাস করছি না।
আমরা কেন এ প্রশ্ন করতে পারব না, কেন এর ব্যাখ্যা চাইতে পারব না যে, একজন আসামিকে কেন এমন ভয়ঙ্করভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে যাতে তার প্রাণহানি ঘটতে পারে? সংবিধান অনুযায়ী কাউকে তো তার নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। এ কথার অর্থ হচ্ছে কাউকে তো বল প্রয়োগ করে দোষ স্বীকার করানো যাবে না। অথচ বেশি বই কম হবে না শতকরা ৮০ ভাগ স্বীকারোক্তি আদায় করা হচ্ছে নির্যাতন করে। আমরা একে বলছি সফল পুলিশি তদন্ত! বস্তুত, ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই নীতির অনুসারী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করতে গিয়ে আমাদের পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা যতই দিন যাচ্ছে ততই আন্তর্জাতিকভাবে অসহায় হয়ে পড়ছে।
রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ কিভাবে করতে হবে তার একটা গাইডলাইন হাইকোর্টের রায়ে দেয়া হয়েছে, যা পুলিশ ও নিম্ন আদালতের মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অভিযুক্তকে যুক্তিযুক্ত মনে হলে তার আইনজীবীর উপস্থিতিতে জেলগেটেই জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। হাইকোর্টের এই নির্দেশনাবলি নিম্ন আদালত ও পুলিশের কাছে মূল্য হারিয়েছে। মনে হচ্ছে তাদের কাছে আমরাও আমাদের জীবনের নিরাপত্তা হারিয়েছি।
বিচারিক প্রক্রিয়ায় আইন-কানুনের প্রতিফলন না থাকলে সমাজ যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে না, এই সহজ কথাটি আমাদের শিক্ষিতজনদের অজানা নয়। দেশে দুর্নীতির শাসন যে কারো একার নয় তা তো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। বিদেশী মিডিয়াতে তার বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। দুর্নীতির বিভিন্ন স্তম্ভ সরকারকে ধরে রাখছে।
পরিস্থিতির কত অবনতি ঘটেছে তার সব শেষ প্রমাণ লেখক মুশতাকের নিষ্ঠুর হত্যা। বিচারব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে। কাউকে জীবনে শেষ করার জন্য ডিজিটাল বা কোনো আইনই প্রয়োজন হয় না। লেখক মুশতাকের মামলার যতদূর জানা গেছে, তাতে বলা হচ্ছে, তিনি ফেসবুকে কিছু আপত্তিকর সরকারবিরোধী বক্তব্য তুলে ধরেছেন। সেজন্য তার বিরুদ্ধে ভয়াবহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে বিচারের আগেই তাকে জীবন দিতে হলো।
আইনকানুন এমনকি সম্পূর্ণ বিচারব্যবস্থাকে অবজ্ঞা করে লেখক মুশতাকের এমন মৃত্যু নিয়ে ছাত্র-জনতার মধ্যে বিক্ষোভ গড়ে উঠছে। নিজেদের জীবনকে মূল্যবান মনে করা আর অন্য সবার জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করা সুস্থ চিন্তা-ভাবনা নয়। জীবনে বাঁচার জন্যই আমাদের সাহসী হতে হবে। তাই ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলবেই। কোনোরূপ রক্তপাত হলে তার দায়-দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। রক্তপাতের পরিণতি ভালো হবে না।