শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উচ্চশিক্ষায় অনিশ্চয়তা

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উচ্চশিক্ষায় অনিশ্চয়তা

বৈষম্যমূলক পে-স্কেল ও পেনশন স্কেল বাতিলের দাবিতে সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সর্বাত্মক কর্মবিরতি চলছে। শিক্ষকদের সঙ্গে মিলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে। একইসঙ্গে চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে চলছে অনির্দিষ্টকালের ছাত্র ধর্মঘট। সব মিলে চরম অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে দেশের উচ্চশিক্ষাখাতে।

কর্মসূচিতে প্রথম দিন সোমবার (১ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সকাল ৯ টা হতে বেলা ১ পর্যন্ত সব ধরনের কর্মবিরতি পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির ডাকে সর্বাত্মকভাবে এই কর্মসূচি পালিত হয়েছে বলে জানা গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া জানিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে যে কোনো বৈষম্য-বৈপরিত্যে প্রথম প্রতিবাদ করে। সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম শিক্ষকদের জন্য বৈষম্যমূলক ও অবমাননাকর। আমরা সারাদেশের শিক্ষকদের এর বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলেছি। এই বৈষম্য দূর না করা পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন কর্মসূচি চলবে।

সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, আমাদের এ আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্দোলন। বৈষম্যমূলক ও মর্যাদাহানিকর প্রত্যয় স্কিম থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনস্কেল প্রবর্তন, সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালিত হবে।

এদিকে একই দাবিতে কর্মসূচি পালিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, হাজি দানেশ বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সবগুলো  পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, আন্দোলন কর্মসূচির অংশ হিসেবে কোথাও কোনো ক্লাস-পরীক্ষা, সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রাম, প্রফেশনাল প্রোগ্রাম, অনলাইন ক্লাস ও অফলাইন ক্লাস, প্রশাসনিক কাজ চলেনি।

এছাড়া চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও। সোমবার বিকেলে সমিতির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।

শিক্ষকদের বিরোধিতা কেন

সঙ্কটের শুরু মূলত সর্বজনীন পেনশনের একটি স্কিমকে কেন্দ্র করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন পেনশন ব্যবস্থায় মাসে মাসে এখনকার চেয়ে ২ দশমিক ৭ গুণ টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু এ জন্য শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন থেকে টাকা কাটা হবে। অবসরের পর কোনো এককালীন টাকা পাওয়া যাবে না, বছর বছর পেনশন বাড়বে না এবং পেনশনারের মনোনীত ব্যক্তি এখনকার মতো আজীবন পেনশন পাবেন না।

আরও কয়েকটি সুবিধা না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে শিক্ষকেরা বলছেন, সব মিলিয়ে নতুন ব্যবস্থায় তাদের সুবিধা কমে যাবে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গত ১৩ মার্চ অর্থ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারির পর প্রত্যয় কর্মসূচি পর্যালোচনার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।ওই কমিটি বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থা ও সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার প্রত্যয় স্কিম পর্যালোচনা করেন। সেখানে দুটি ব্যবস্থার মধ্যে বিস্তর ব্যবধানের বিষয়টি উঠে আসে।

বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থা ও প্রত্যয় স্কিমের মধ্যে যে পার্থক্য

সুবিধার ক্ষেত্রে বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় শিক্ষকদের কোনো বেতন কাটা হয় না। কিন্তু প্রত্যয় স্কিম বাস্তবায়িত হলে বেতন ১০ শতাংশ হারে কাটা হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় অধ্যাপক গ্র্যাচুইটি বা আনুতোষিক বাবদ এককালীন ৮০ রাখ ৭৩ হাজার টাকা পাবে কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে এই সুযোগ রহিত হবে।

বিদ্যমান ব্যবস্থায় বেতন থেকে টাকা না কেটে অধ্যাপকের মাসিক পেনশন ৪৫ হাজার ৭৯০ টাকা কিন্তু প্রত্যয়ে বেতন থেকে টাকা কর্তনের পর প্রতিষ্ঠানের টাকায় মাসিক পেনশন পাবে ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা।

বিদ্যমান ব্যবস্থায় চাকরিজীবী ও নমিনি আজীবন পেনশন পেলেও প্রত্যয় স্কিমে চাকরিজীবী আজীবন পাবেন। তবে তার মৃত্যুর পর নমিনি ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত পেনশন পাবেন। বিদ্যমানে বছরে পেনশনে ইনক্রিমেন্ট হয় ৫ শতাংশ হারে অন্যদিকে প্রত্যয় স্কিমে কোনো ইনক্রিমেন্ট নেই। বিদ্যমানে অর্জিত ছুটির বিপরীতে টাকা পাওয়া যায় প্রত্যয় স্কিমে সেটি রহিত করা হয়েছে। বিদ্যমানে অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটি(এলপিআর)সুবিধা আছে কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।

বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় অবসরের বয়স শিক্ষকদের ক্ষেত্রে ৬৫ বছর, কর্মকর্তাদের ৬২ বছর আর কর্মচারীদের ক্ষেত্রে ৬০ বছর নির্ধারণ করা রয়েছে। পক্ষান্তরে প্রত্যয় স্কিমে সবার জন্য বয়স সীমা ৬০ করা হয়েছে। এছাড়া বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় মাসিক চিকিৎসা ভাতা, দুটি উৎসব ভাতা ও ১টি বৈশাখি ভাতার ব্যবস্থা থাকলেও প্রত্যয় স্কিমে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

তুঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলনও

শিক্ষকদের আহ্বানে যখন বন্ধ হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ধরনের কার্যক্রম তখন তাতে ঘি ঢেলেছে কোটা বিরোধী আন্দোলন। সোমবার থেকে দেশের সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি দেশের সকল উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে।

সোমবার (১ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আগামী ৩ ও ৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সাত কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ঢাকার সব কলেজে একযোগে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিদ হাসান বলেন, আমরা সবার উদ্দেশে বলতে চাই, ২০১৮ সালের পরিপত্র বহালের জন্য প্রয়োজনে আবারও আন্দোলনে নামবো আমরা। দেশের সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একযোগে আন্দোলন করার আহ্বান জানাচ্ছি। এসময় ২ থেকে ৪ জুলাই আন্দোলন কর্মসূচি হিসেবে পদযাত্রা ও অবস্থান কর্মসূচী ঘোষণা করেন তিনি।

ভোগান্তিতে শিক্ষার্থীরা

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে স্থবির হওয়ায় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দূর-দূরান্তের শিক্ষার্থীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। বিশেষ করে ঢাকার বাইরের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন বলে জানা গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবু মো. খালিদ হাসান বলেন, ঈদের লম্বা ছুটি কাটিয়ে মাত্রই ক্যাম্পাসে ফিরেছি। এই অবস্থায় ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অলস সময় পার করতে হচ্ছে।

ঈদ ও গ্রীষ্মকালীন অবকাশের দীর্ঘ ছুটির পর আবারো ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হওয়ায় ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, গত সপ্তাহে আমি দক্ষিণবঙ্গ থেকে এসেছি। ভালোভাবে ক্লাস শুরু না হতেই আবারো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আগে জানলে এখানে আসতাম না।

জোবায়ের হাসান নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। আজকে পরীক্ষা ছিল স্থগিত হয়েছে। কবে যে আবার পরীক্ষা হবে? পরীক্ষার মাঝে এ অনিশ্চয়তা ভালো লাগে না।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবহন সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোগান্তি বেড়েছে বলেও মন্তব্য করেন এসব শিক্ষার্থী।

Bangla Outlook

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here