শিক্ষকের নিরাপত্তাহীনতা ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন

 ড. মোহাম্মদ ফজলুর রহমান খান

 ১৬ এপ্রিল ২০২২
messenger sharing button
শিক্ষকের নিরাপত্তাহীনতা

মানবজাতির উন্নয়নের সোপান হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে ভালো-মন্দ বা আলো-অন্ধকারের পার্থক্য বুঝিয়ে মুক্তচিন্তার পথে হাঁটতে শেখায়। শিক্ষার ছোঁয়ায় বিকশিত হয় মানুষের সৃজনশীলতার। তাই কোনো দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সময়োপযোগী ও সুবিন্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থার।

তাই জাতির মেধাবী ও আত্মপ্রত্যয়ী সন্তানদেরই আসা উচিত শিক্ষকতায়। সাধারণত রাষ্ট্রব্যবস্থায় শিক্ষকের পেশাগত মর্যাদা, আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা শিক্ষাব্যবস্থায় মেধাবীদের অংশগ্রহণের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হতে চায়। সে লক্ষ্যে সম্প্রতি আধুনিকায়ন করা হয়েছে জাতীয় কারিকুলামের রূপরেখা। কিন্তু যারা এ কারিকুলাম বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের আগামী প্রজন্মকে আলোকিত মানবসম্পদে পরিণত করবেন, তাদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা এ উন্নয়ন অভিযাত্রায় অংশগ্রহণে কতটা প্রস্তুত?

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আলোকপাত করতে হবে আমাদের শিক্ষক সমাজের কর্মপরিবেশ এবং কর্মসন্তুষ্টির মাত্রার ওপর। নির্মম হলেও সত্য, বিদ্যমান বাস্তবতায় আমাদের শিক্ষকরা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তটস্থ থাকেন শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তাহীনতায়; যা তাদের কর্মস্পৃহাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা চলমান পরিস্থিতির ভয়াবহতা আরও তীব্র করে তুলেছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গাইবান্ধা সরকারি কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক মহোদয়ের একটি পোস্টে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের নিরাপত্তাহীনতার একটি ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। সম্পাদক মহোদয় তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ১৩ এপ্রিল গাইবান্ধা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় জোহরের নামাজ শেষে কলেজ মসজিদ থেকে বের হয়ে কয়েকজন যুবককে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজিয়ে বেপরোয়াভাবে মোটরবাইক চালানোরত অবস্থায় দেখতে পান।

ফলে স্বীয় দায়িত্ববোধ থেকেই অধ্যক্ষ মহোদয় যুবকদের থামিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে এভাবে বাইক চালাতে নিষেধ করেন। এতেই যুবকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং অধ্যক্ষ মহোদয়কে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে শুরু করে।

একপর্যায়ে মসজিদের কাছে থাকা শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক মহোদয়সহ অন্য শিক্ষকরা ও কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী এগিয়ে এলে বখাটেরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে উপস্থিত ছাত্র-শিক্ষকরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মূল অপরাধীদের একজনকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন।

আমাদের শিক্ষক সমাজের সম্মান ও জীবনের নিরাপত্তাহীনতার অপর একটি মর্মান্তিক উদাহরণ সৃষ্টি হয় ৩০ মার্চ শরীয়তপুরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজে।

৩১ মার্চ দা ডেইলি স্টার বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের বরাতে জানা যায়, ৩০ মার্চ কলেজের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষাকেন্দ্রে বহিঃপরীক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালনের জন্য আগত অন্য কলেজের কয়েকজন শিক্ষক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধানের সম্মানে বিভাগের পক্ষ থেকে ছোট পরিসরে খাবারের আয়োজন করা হয়। ওই খাবার অনুষ্ঠানে দাওয়াত না দেওয়ায়, একটি ছাত্র সংগঠনের কলেজ শাখার সভাপতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ২০-২৫ জন কর্মীসহ বাংলা বিভাগে উপস্থিত হয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হয় এবং এক পর্যায়ে বাংলা বিভাগের একজন প্রভাষককে লাথি ও কিল-ঘুষি মারতে শুরু করে। উপস্থিত অন্য শিক্ষকদের জোর প্রচেষ্টায় আক্রান্ত শিক্ষককে উদ্ধার করা হয়। পরে রাত ১১টার দিকে ওই শিক্ষকসহ কলেজের সিনিয়র শিক্ষকরা মামলা দায়েরের জন্য পালং মডেল থানায় যান। সেখানে রাত ১টা পর্যন্ত অপেক্ষার পরও অজ্ঞাত কারণে মামলা নেয়নি পুলিশ।

অবশ্য একদিন পর অভিযোগটি মামলা হিসাবে গ্রহণ করা হয়। এক পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সংগঠন থেকে অভিযুক্ত ছাত্র নেতাকে বহিষ্কারও করা হয়। তবে তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এ ধরনের মর্মান্তিক ও অবমাননাকর অসংখ্য ঘটনা ঘটতে দেখেছি আমার শিক্ষকতা জীবনের ১৭ বছরে।

কেবল পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ না দেওয়ার অপরাধে হেনস্তা করা হয়েছে বহু শিক্ষককে। এমনকি ছুরিকাঘাত করার মতো ঘটনাও শুনেছি বহুবার। দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ঘটনাই থানা পর্যন্তও গড়ায়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে হার মেনেছে শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণের বিষয়টি।

আমরা শিক্ষাঙ্গনে সংঘটিত এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রতিরোধ, প্রতিকার ও অবসান চাই। কারণ কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা ইতোমধ্যেই আমাদের শিক্ষক সমাজের আত্মসম্মান ও দায়িত্ববোধে চিড় ধরিয়েছে। অথচ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে উপনীত মানবসভ্যতায় বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের প্রয়োজন আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন শিক্ষকমণ্ডলীর সমন্বয়ে সুবিন্যস্ত একটি সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্রনামধারী সন্ত্রাসী কর্তৃক কর্মক্ষেত্রে শিক্ষক নিগৃহীত হওয়ার ধারাবাহিক ঘটনাগুলোর প্রতিক্রিয়ায় আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্নের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ? এ ধরনের ঘটনা আমাদের সাংস্কৃতিক বাস্তবতার যে চিত্র তুলে ধরছে, তা জাতির সামনে কোন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে? এ পরিস্থিতিকে নীতিনির্ধারকরা কতটা উদ্বেগের সঙ্গে বিবেচনা করছেন? আমরা কি এ ধরনের সন্ত্রাসের ইনডেমনিটি দিয়ে রেখেই উন্নত জাতি গঠনের স্বপ্নে বিভোর থাকব? আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার পরিচালকদের এ প্রশ্নগুলো ভেবে দেখাটা এখন অত্যাবশকীয়ভাবে প্রাসঙ্গিক।

ড. মোহাম্মদ ফজলুর রহমান খান : সহকারী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান, ময়মনসিংহ সরকারি কলেজ

[email protected]