শিকলবন্দী প্রত্যাবাসন, শিকল পরা স্বপ্ন!

নিয়াজ মাহমুদ

(১০ ঘন্টা আগে) ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ৯:৩৬ পূর্বাহ্ন

mzamin

facebook sharing button

অভিবাসন—এই শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বপ্ন, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের এক দীর্ঘ ইতিহাস। ভিটেমাটি ছেড়ে, চেনা পৃথিবীকে ফেলে রেখে নতুন কোনো দেশে পাড়ি জমানোর পেছনে থাকে উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষা, জীবিকার অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির বাসনা, কিংবা রাজনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর হাজারো মানুষ অভিবাসনকে দেখেন নতুন জীবনের টিকিট হিসেবে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।

কিন্তু সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন যখন লাঞ্ছনা ও অপমানের শিকলে জড়িয়ে পড়ে, তখন সেটি হয়ে ওঠে এক দুঃসহ দুঃস্বপ্ন। ২রা আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো বাংলাদেশিদের অভিজ্ঞতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে সেই নির্মম সত্যটি আবারও স্মরণ করিয়ে দিল। শিকলবন্দী প্রত্যাবাসন, শিকল পরা স্বপ্ন!

ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গভীর রাতে নেমে এল বিশাল সামরিক পরিবহন উড়োজাহাজ সি-১৭। সময় তখন রাত সাড়ে ১২টা। ভেতরে ৩০ জন বাংলাদেশি—সবাই শিকলবন্দী। হাত ধরা ছিল লোহার ঠান্ডা হাতকড়ায়, কোমর জড়ানো ভারী শিকল, পায়ে বাঁধা লোহার গিট। যেন তারা কোনো ভয়ঙ্কর অপরাধী, রাষ্ট্রের জন্য হুমকি। অথচ তারা অপরাধী নয়—ছিলেন অবৈধ অভিবাসী মাত্র। স্বপ্ন দেখতে গিয়েছিলেন, অপমান বয়ে নিয়ে ফিরলেন।

তিন ঘণ্টা ধরে বিমান রানওয়েতে দাঁড়িয়ে ছিল। এতক্ষণেও তাদের হাতকড়া খোলা হলো না। যেন ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের মনে গেঁথে দেওয়া হচ্ছিল—“তোমরা অপরাধী, তোমাদের মর্যাদা নেই।” অথচ বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল এরিয়ায় পৌঁছানোর আগেই সব শিকল খোলা হলো। অর্থাৎ নিরাপত্তার প্রয়োজন ছিল না, কেবল ‘অপমান’ই ছিল উদ্দেশ্য।

তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে অন্তত ১৮৭ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। প্রথম দিকে হাতকড়া ও শিকল না পরানো হলেও এবার এক নারীসহ ৩৯ বাংলাদেশিকে দেশে পাঠানো হয়। তাদের সবার হাতকড়া ও শিকল পরানো ছিল।

ভাবুন, একটি তরুণ ছেলে। হয়তো গ্রামে মা তাকে বিদায় দিয়েছিলেন অশ্রুসিক্ত চোখে, বাবার আশা ছিল—পুত্র একদিন পরিবারের ভাগ্য বদলাবে। সে ঋণ করেছিল, গরু বিক্রি করেছিল, হয়তো ভিটে বন্ধক দিয়েছিল। সব স্বপ্ন নিয়ে পৌঁছেছিল আমেরিকার মাটিতে। কিন্তু ফিরল সে—শিকল বাঁধা হাত নিয়ে। বিমানবন্দরের গেটে দাঁড়ানো মা যখন দেখলেন, তার ছেলের হাত বাঁধা, চোখ নুয়ে গেল লজ্জা ও বেদনায়। এই দৃশ্য যে কোনো পিতামাতার হৃদয় ভেঙে দেয়।

শুধু একজন নয়, প্রত্যেকের গল্প একই রকম। কারও স্ত্রীর চোখে বাচ্চা নিয়ে অপেক্ষা, কারও বোন দৌড়ে এসেছে ভাইকে বুকে জড়াতে। কিন্তু তার আগেই তারা দেখেছে—তাদের প্রিয় মানুষ হাতকড়া ও শিকলে আবদ্ধ। এই দৃশ্য কোনো পরিবারের জন্য সহ্য করা সহজ নয়।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ স্পষ্ট বলছে—কোনো মানুষকে অমানবিক ও অপমানজনক আচরণের শিকার করা যাবে না। শরণার্থী হোক বা অভিবাসী, সবাই মানুষ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অবৈধ প্রবেশ ঠেকানোর নামে মানুষকে পশুর মতো বেঁধে আনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের নগ্ন উদাহরণ।

যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রবণতা চালু হয়েছে: অভিবাসীদের অপরাধী হিসেবে চিত্রিত করা। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশ থেকে আসা মানুষদের ঘিরে নেতিবাচক প্রচারণা বেশি। ফলে সাধারণ জনগণের মনে গড়ে ওঠে ভীতি ও বিরূপ মনোভাব।

কিন্তু গবেষণা বলছে—অভিবাসীরা স্থানীয়দের তুলনায় কোনোভাবেই বেশি অপরাধপ্রবণ নন। বরং তারা শ্রমবাজারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেন, এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটান। তবুও রাজনৈতিক প্রচারণায় তাদের অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগানো যায়।

এ যেন কেবল প্রত্যাবাসন নয়—এ যেন একটি শিক্ষা, একটি বার্তা। যেন বলা হচ্ছে—“আমেরিকায় আসবে না, এলে এইভাবে ফিরতে হবে।” আর এই শিক্ষা দিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানবিক মর্যাদা।

বাংলাদেশিরা একা নন। এর আগে একাধিকবার ভারতীয় নাগরিকদেরও একইভাবে শিকল পরিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে। সেই সময় ভারতীয় সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল।

কেননা, বিষয়টি কেবল কিছু মানুষের দেশে ফেরার ঘটনা নয়—এটি একটি জাতির মর্যাদার প্রশ্ন। যখন কোনো দেশের নাগরিককে শিকল পরিয়ে ফেরত পাঠানো হয়, তখন সে অপমান কেবল ওই ব্যক্তির নয়; সেটি গোটা জাতির জন্যই এক ধরনের আঘাত।

কিন্তু বাংলাদেশে তেমন সরব প্রতিবাদ দেখা যায়নি। কেবল কিছু সংবাদমাধ্যম খবরটি প্রকাশ করেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সীমিত প্রতিক্রিয়া এসেছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ নিয়ে তেমন উচ্চকিত অবস্থানও দেখা যায়নি। প্রশ্ন জাগে—কেন আমাদের নীরবতা?রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই, বড় কোনো সামাজিক আন্দোলনও দেখা যায়নি। প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ, অথচ তাদের মর্যাদাহানি নিয়ে যেন আমরা নীরব দর্শক।

দেশে ফেরত আসা অভিবাসীদেরপুনর্বাসনের উদ্যোগ না নিয়ে যদি আমরা কেবল দর্শক হয়ে থাকি, তবে তা আরও বড় সামাজিক সংকট তৈরি করবে। তাই রাষ্ট্রের উচিত—

১. যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের কাছে কূটনৈতিকভাবে কড়া প্রতিবাদ জানানো।
২. আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি উত্থাপন করা।
৩. দেশে ফেরত আসা অভিবাসীদের পুনর্বাসনে বিশেষ কর্মসূচি হাতে নেওয়া।
৪. জনগণকে সচেতন করা যে অভিবাসীরা অপরাধী নন, তারা আমাদেরই ভাই-বোন, যারা কেবল ভালো জীবনের খোঁজে বিদেশে গিয়েছিলেন।

শিকলের শব্দ শুধু ধাতব নয়, মানসিকও। যে শিকল হাত-পায়ে ছিল, তা খুলে গেছে; কিন্তু যে শিকল আত্মমর্যাদাকে বেঁধেছে, তা রয়ে গেছে। এই মানুষগুলো হয়তো আর কোনোদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। গ্রামের চায়ের দোকানে যখন তাদের ফেরার গল্প বলা হবে, তখন শিকলের শব্দ যেন আবার শোনা যাবে।

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ (ICCPR) কিংবা জাতিসংঘ শরণার্থী সনদ—উভয়ই জোর দিয়ে বলে যে প্রত্যেক মানুষের মর্যাদা রক্ষা করা রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্ব। একজন অভিবাসী অবৈধভাবে প্রবেশ করলেও তিনি অপরাধী নন; তিনি প্রশাসনিক নিয়ম ভঙ্গ করেছেন, কিন্তু তা কোনোভাবেই তাকে অপরাধীর আসনে বসায় না।

এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব Immigration and Nationality Act (INA)-তেও কোথাও বলা নেই যে অভিবাসীদের শিকল পরানো বাধ্যতামূলক। তাহলে কেন এই অপমানজনক আচরণ? এর উত্তর নিহিত আছে রাজনীতির মঞ্চে—অভিবাসন ইস্যুকে ভোটের রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন যেমন তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, তেমনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে শক্তি প্রদর্শনের জন্য অভিবাসীদের মানবাধিকার বিসর্জন দিয়েছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে অভিবাসনবিরোধী অভিযান তীব্রতর হয়েছে। সীমান্তে দেয়াল, আটক কেন্দ্রে ভিড়, আর ফেরত পাঠানোর নামে শাস্তিমূলক অপমান। এটি শুধু বাংলাদেশিদের জন্য নয়—লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়ার হাজারো মানুষ একই অভিজ্ঞতার শিকার। কিন্তু যে দেশ মানবাধিকার রক্ষার বুলি দেয়, তারাই যখন এই ধরনের আচরণ করে, তখন তা নৈতিক দ্বিচারিতার চূড়ান্ত উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়।

প্রখ্যাত রাষ্ট্রচিন্তক হান্না আরেন্ট লিখেছিলেন—”মানুষ যখন কোনো সম্প্রদায়ের অংশ বলে গণ্য হয় না, তখনই তার প্রকৃত বিপর্যয় ঘটে।”

এই শিকলবন্দী প্রত্যাবাসন সেই কথাই প্রমাণ করে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের আর মানুষ হিসেবে নয়, কেবল সংখ্যা হিসেবে দেখেছে। রাষ্ট্র যখন নিজের নাগরিকের মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই রাষ্ট্রও দুর্বল হয়ে পড়ে।

হাতকড়া ও শিকল শুধু লোহার নয়, এটি অপমানের প্রতীক। অভিবাসীরা অপরাধী নয়, তারা স্বপ্নবাজ, তারা জীবনের মান উন্নত করতে চেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডে ফিরে আসা, আর বাংলাদেশের উচিত নিজের নাগরিকদের মর্যাদা রক্ষায় দৃঢ় অবস্থান নেওয়া।
কারণ রাষ্ট্রের প্রকৃত শক্তি অস্ত্রশস্ত্রে নয়, তার দুর্বল নাগরিকের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষমতায়। অন্যথায় আজ যে শিকল তাদের হাতে পড়েছে, একদিন সেই শিকল আমাদের জাতীয় আত্মমর্যাদাকেও আবদ্ধ করে ফেলবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

niazjournalist@gmail.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here