শাহীনবাগের কূটনৈতিক যুদ্ধ

  • ড. এ কে এম মাকসুদুল হক
  •  ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:১৩
ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস – ছবি : সংগৃহীত

মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাংলাদেশের শাহীনবাগে একজন গুম হওয়া বিএনপি নেতার বাসায় পরিদর্শনকে কেন্দ্র করে একটি ত্রিমুখী কূটনৈতিক যুদ্ধের অবতারণা হয়। এই কূটনৈতিক বাহাস প্রথমে আমেরিকা ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয়ভাবে হলেও পরবর্তীতে হঠাৎ করে রাশিয়া তৃতীয় পক্ষ হিসেবে জড়িয়ে পড়ে। কূটনৈতিক জগতে সংশ্লিষ্ট দুই দেশের মধ্যে বাক্য-বিনিময়, মান-অভিমান খুবই স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু এই টানাপড়েনের মধ্যে তৃতীয় কোনো দেশের অযাচিতভাবে জড়ানো মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোনো দেশ শুধু ভালোবেসে বা কল্যাণ কামনা করে অন্য দেশের সাথে জড়ায় না। বিশেষ করে শক্তিশালী দেশগুলো অন্য দেশের সাথে শত্রুতা যেমন করে নিজেদের স্বার্থে তেমনি বন্ধুত্বও করে নিজস্ব স্বার্থে, উদ্ধারের জন্যই।

গত ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস শাহীনবাগে যান। সেখানে তিনি ২০১৩ সালে গুম হয়ে যাওয়া ছাত্রদল নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাসায় গিয়ে সাজেদুলের পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সাজেদুলের বোন সানজিদা ইসলামের সাথে কথা বলেন। উল্লেখ্য যে, সানজিদা ইসলাম নিখোঁজ ভাইয়ের খোঁজাকে জোরদার করার জন্য গত এক দশকে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে ‘মায়ের ডাক’ নামক সংগঠন গড়ে তুলে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। মার্কিন দূত পিটার হাস সুমনদের বাসায় গেলে ‘মায়ের কান্না’ নামক আরো একটি সংগঠন সেখানে ভিড় করে এবং রাষ্ট্রদূতকে স্মারকলিপি দিতে চাইলে সেখানে একটি অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ফলে নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় পিটার হাস দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

উল্লেখ্য যে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসন আমলে বিদ্রোহের অভিযোগে যেসব সামরিক ব্যক্তিবর্গের সামরিক আইনে মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল তাদের পরিবারবর্গ সম্প্রতি ‘মায়ের কান্না’ নামক একটি সংগঠন করে ওই সব মৃত্যুদণ্ডের বিচার চাইছেন। ‘মায়ের কান্না’ সংগঠনের সদস্যদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা এবং সহমর্মিতা রেখেই একটি প্রশ্ন জাগে। একটি শাসন আমলের কার্যকর করা ফাঁসি বা মৃত্যুদণ্ডের বিচার চাওয়ার অধিকার আত্মীয়স্বজনের অবশ্যই আছে। কিন্তু এই বিচার তো সরকার বা দেশের আদালতে চাইতে হবে। ভিন্ন একটি দেশের রাষ্ট্রদূতের সেই বিষয়ে কি কিছু করার আছে? তার পরও যদি রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে মার্কিন সরকারকে জানানোর প্রয়োজন অনুভূত হয় তা কি সংশ্লিষ্ট দূতাবাসে বা অন্য কোনো উপায়ে করা যেত না? ‘মায়ের ডাক’ সংগঠন তো দীর্ঘ দিন ধরে সরকারের কাছে প্রতিকার চেয়ে আন্দোলন করছে।

এ ধরনের একটি অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ‘মায়ের কান্না’ সংগঠনের মাধ্যমে প্রতিকার চাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় উদ্ভূত পরিস্থিতি অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত শাহীনভাগ থেকে সরাসরি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের দফতরে গিয়ে ঘটনা জানান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আবেদন জানান। আমেরিকার দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু আমেরিকার বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানকে তলব করে এর প্রতিবাদ জানান। এরপর গত ২২ ডিসেম্বর মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরম্যানের সাথে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের একই উদ্বেগের বিষয়ে কথা হয়। অন্য দিকে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীবর্গ পিটার হাসের শাহীনবাগে সাজেদুলের বাসায় যাওয়াকে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন হস্তক্ষেপ বলে বিভিন্ন তীর্যক মন্তব্য করেছেন। অবশ্য এর অনেক আগে থেকেই মার্কিনিরা এবং তাদের পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছিলেন।

বাংলাদেশের এমন একটি অস্বস্তিকর কূটনৈতিক পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই গত ২০ ডিসেম্বর ঢাকায় রুশ দূতাবাস ‘কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করার’ নীতিকে সমর্থন জানিয়ে বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মিতা জানায়। পরদিন মার্কিন দূতাবাস রাশিয়ার নাম উল্লেখ করেই ইউক্রেন আক্রমণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রতিক্রিয়ায় ঢাকায় রুশ দূতাবাস একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বের বিষয়টি তুলে ধরে। রুশ দূতাবাসের এসব বিবৃতিকে আমাদের একজন মন্ত্রীমহোদয় আকারে- ইঙ্গিতে সমর্থনও করেন। এরই মধ্যে গত ২২ ডিসেম্বর রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের চেষ্টা’ শিরোনামে রুশ ভাষায় একটি বিবৃতি দেন। ২৫ ডিসেম্বর ঢাকায় রুশ দূতাবাস এর ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করে (নয়া দিগন্ত : ২৬/১২/২০২২)। এতে বলা হয়, “Russia considers the US ambassador’s visit to Shaheenbagh as an attempt to interfere in the internal affairs of Bangladesh” (ডেইলি স্টার : ২৬/১২/২০২২)।

এভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে দুই পরাশক্তি যখন কূটনৈতিক যুদ্ধে লিপ্ত তখন হঠাৎ জানা যায় যে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা একটি রুশ জাহাজকে মংলা বন্দরে ভিড়ার অনুমতি দিতে রাশিয়া চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশকে। গত ২০ ডিসেম্বর ওয়াশিংটন বাংলাদেশকে জানায়, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের সরঞ্জাম বহনকারী রাশিয়ার ‘উরসা মেজর’ নামের জাহাজটি আসলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাভুক্ত জাহাজ ‘স্পার্টা-৩’। এটির রঙ ও নাম বদল করা হয়েছে। এই জাহাজকে নোঙর করতে দেয়ার ভয়াবহতা বুঝতে পেরে বাংলাদেশ মংলা বন্দরে প্রবেশ নিষেধ করে। পরে ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টটস্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে জাহাজ ভিড়তে দেয়ার অনুমতি প্রদানের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন এবং সম্পর্ক নষ্টের হুমকিও দেন (নয়া দিগন্ত : ৩০/১২/২০২২)। কিন্তু মার্কিন নিষেধাজ্ঞাভুক্ত জাহাজ হওয়ায় অনুমোদন দেয়নি বাংলাদেশ সরকার। পরে জাহাজটিকে ভারতের হলদিয়া বন্দরে বিড়ানো হয়। কারণ ভারত মার্কিন এই নিষেধাজ্ঞা আমলে নিচ্ছে না।

এতসব ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় সুস্পষ্ট করেছেন যে, বিদেশী কোনো দেশেরই আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জড়িত হওয়া উচিত নয়। তিনি রাশিয়া ও আমেরিকার নাম উল্লেখ করেই এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন গত ২৭ ডিসেম্বর। আমাদের এই কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া সঠিক হলেও বেশ বিলম্বিত হয়েছে বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করেন। এ ছাড়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞাভুক্ত জাহাজকে মংলা বন্দরে ভিড়তে না দেয়াটাও ছিল যথাযথ কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত। তবে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশীরা জোর করে আসেনি। যেকোনোভাবেই হোক আমরাই তাদের আসার পথটি মসৃণ করে দিয়েছি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকায় এসে সরাসরি আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। এমনকি কিছু দিন আগে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, আমাদের বর্তমান সরকারকে আবার ক্ষমতায় আনার জন্য ভারতকে প্রয়োজনীয় সব কিছু করার অনুরোধ করেছেন তিনি। অবশ্য সেই সময় আমাদের দেশের বিজ্ঞ অনেক বুদ্ধিজীবী নীরব থাকলেও এবার পিটার হাসের শাহীনবাগে যাওয়াকে কেন্দ্র করে অনেক সরব হয়েছেন, বিবৃতি দিয়েছেন। কাজেই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপের প্রতিক্রিয়াটিতে উক্ত বুদ্ধিজীবীরা বস্তুনিষ্ঠ বা নিরপেক্ষ ছিলেন না, যা দেশ ও জাতির জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়।

যদিও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মানবাধিকারের অজুহাতে শাহীনবাগ পরিদর্শন করেছেন তথাপি তাদের মানবাধিকারের বিষয়টি একেবারেই স্বার্থকেন্দ্রিক। আধুনিক ভূরাজনীতির বাস্তবতায় বাংলাদেশের গুরুত্বের কথা বিবেচনায় রেখেই তারা এখানকার মানবাধিকার নিয়ে অত্যন্ত সরব। তাদের কোনো রাষ্ট্রে নাক গলানোর আগের উছিলা ছিল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আর এখন সেই উছিলা পরিবর্তিত হয়েছে মানবাধিকারে। এই আমেরিকাই ইসরাইলের সন্ত্রাসী সৈনিকেরা গুলি করে ফিলিস্তিনের নিরপরাধ নিরস্ত্র নারী, শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করলে তাকে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার বলে সমর্থন করছে।

২০০৩ সালে তারা মিথ্যা সন্ত্রাসের অজুহাতে ইরাকে আক্রমণ চালিয়ে লাখো অসামরিক নারী-পুরুষ হত্যা করেছে এবং আইএসের উত্থান ঘটিয়েছে। পরে ‘আইএস’ নির্মূলের নামে মধ্যপ্রাচ্যে সীমাহীন যুদ্ধ করে চলছে। আরো আগে ইরান-ইরাক যুদ্ধ বাধিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। আবার সোভিয়েত রাশিয়া আফগানিস্তান দখল করলে আমেরিকা আফগানিস্তানকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। কিন্তু সোভিয়েতরা পরাজিত হলে মার্কিনিরা আফগানিস্তানকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়ে চলে যায়, যা পরে আলকায়েদা ও তালেবানের উদ্ভব ঘটায়। পরে এই মার্কিনিরাই আফগানিস্তানে ২০ বছর ধরে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছে তালেবান ঠেকানোর নামে। সেগুলো নিশ্চয়ই মার্কিন সংজ্ঞায় মানবাধিকার লঙ্ঘন ছিল না! কাজেই মার্কিনিদের বাংলাদেশে মানবাধিকারের মুরুব্বিয়ানা দেখে আমরা যারা খুশি হচ্ছি তাদেরকে চিন্তা করতে হবে কেন আমেরিকার এই দরদ! আমেরিকার চীন ঠেকানো নীতিই এখন তাদের সব কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। রাশিয়ার বিষয়ে তারা কম চিন্তিত, কারণ তারা ইউরোপিয়ানদেরকে সফলভাবে ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িত করে ইউরোপ ও রাশিয়া উভয়কেই ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিণত করছে।

অন্য দিকে চীন ঠেকানোর জন্য তাইওয়ানকে উজ্জীবিত করে রেখেছে। সম্প্রতি চীনের উত্থানে ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। ফলে প্রশান্ত এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সমুদ্রপথ নিরাপত্তার জন্য মার্কিন নেতৃত্বে একটি বলয় সৃষ্টি হয়েছে। এ বলয়টি ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ (আইপিএস), ‘কোয়াড’, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফোরাম’ (আইপিইএফ), ‘অকাস’ (অস্ট্রেলিয়া-ইউকে-ইউএস) ইত্যাদি বিভিন্ন জোট বা চুক্তির মাধ্যমে শক্তিশালী চীনবিরোধী পক্ষ প্রস্তুত করছে। বাংলাদেশের অবস্থান বঙ্গোপসাগরের মাঝ বরাবর এবং এই বঙ্গোপসাগর ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে সংযুক্ত রয়েছে। একই সাথে চীনের আশ্রিত রাষ্ট্র মিয়ানমারও বঙ্গোপসাগরে যুক্ত রয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমান ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এ জন্য চীনও অত্যন্ত সজাগ রয়েছে। ২০২১ সালের মে মাসে চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বাংলাদেশকে ‘কোয়াডে’ যোগদান করতে প্রকাশ্যে নিষেধ করেছিলেন।

গত পহেলা মে চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুবুজ্জামানকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া বিষয়ক দফতরের মহাপরিচালক লিউ জিনসেং ‘ব্লক রাজনীতি’ প্রত্যাখ্যান করতে আহ্বান জানান। তিনি ‘আইপিএস’, ‘অকাস’, ‘কোয়াড’ এবং ‘আইপিইএফ’কে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্ট্রিজম’ এবং ‘এক্সপানশনালিজম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন (নয়া দিগন্ত : ০৪/০৬/২০২২)। চীনের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও সামরিক অংশীদারিত্ব দীর্ঘ দিনের। চীনের ১০০-এর বেশি কোম্পানি বাংলাদেশে কাজ করছে। চীন বাংলাদেশের একক বৃহৎ বিদেশী বিনিয়োগকারী রাষ্ট্র। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেলসহ অবকাঠামো খাতের বিভিন্ন মেগা প্রকল্প এবং পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ জ্বালানি খাতে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে। আবার অতি সম্প্রতি রাশিয়া ও চীনের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা জোরদারের লক্ষ্যে ‘সি-পুতিন’ ভিডিও সংলাপও হয়েছে (প্রথম আলো : ৩১/১২/২০২২)। চীনের সামরিক সহযোগিতা পেলে ইউক্রেনে পশ্চিমাদের পরাজয় নিশ্চিত হবে। এ জন্যই আমেরিকা তাইওয়ানে উত্তেজনা সৃষ্টি করে চীনকে ব্যস্ত করে রাখছে। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাসের তাগিদ দিয়েছে। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা চিঠিতে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অবাধ চলাচল ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ কোস্টকার্ড ও নৌবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবান অংশীদার বলে উল্লেখ করেছেন (নয়া দিগন্ত : ০৫/০৪/২০২২)।

তবে মনে রাখতে হবে, এ অঞ্চলে অবাধ চলাচল ও স্বাধীনতা মানে হলো চীনের আধিপত্যের বিপরীত স্রোতে চলা। প্রকৃতপক্ষে চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিসিয়েটিভের’ বিপরীতেই যুক্তরাষ্ট্র ‘আইপিএস’ গঠন করেছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নবগঠিত অর্থনৈতিক জোট ‘আইপিইএফ’ এ বাংলাদেশকে যুক্ত করতে চাচ্ছে। আর চীন বাংলাদেশকে এই জোটে যোগ না দেয়ার জন্য সতর্ক করে দিয়েছে। অন্তত গত কয়েক দিনের মার্কিন ও চীনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে ভিজিট ও কাউন্টার ভিজিটের ব্যস্ততা দেখে বাংলাদেশকে নিয়ে দুই দেশের প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এ দিকে চীনের সাথে নিকটতম প্রতিবেশী ভারতেরও রয়েছে চিরবৈরিতা। বাংলাদেশে চীনের উপস্থিতি ভারতের জন্য খুবই অস্বস্তিকর। কাজেই চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বে ভারতও নিশ্চিতভাবে মার্কিন দিকে থাকবে।

এমন প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার অযাচিতভাবে জড়িত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের পক্ষে দাঁড়ানো মোটেই স্বাভাবিক নয়। যে দেশটি অন্য একটি দেশে সরাসরি সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, সেই দেশের কি শাহীনবাগের ঘটনায় জড়িত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক আগ্রাসন নিয়ে কথা বলা সাজে? এখানে প্রথমত তাদের মালবাহী জাহাজ ভিড়ার সুবিধা নেয়ার স্বার্থটি সরাসরি সংশ্লিষ্ট ছিল। অন্য দিকে মার্কিন বিরোধী ব্লকে বাংলাদেশকে কাছে পাওয়া এবং চীনের পক্ষে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে শক্তি সঞ্চার করার একটি পরোক্ষ উদ্দেশ্যও ছিল বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

ভূরাজনীতির এমন জটিল সন্ধিক্ষণে আমাদের দেশ ও জাতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সর্বাধিক অগ্রগণ্য বিষয়। মনে রাখতে হবে, কোনো শক্তিধর দেশ কখনো নিজের দেশে যুদ্ধ করে না। তারা তৃতীয় কোনো দেশে যুদ্ধ করে নিজেদের জয়-পরাজয় নিশ্চিত করে। শীতল যুদ্ধ থেকে শুরু করে বর্তমান ইউক্রেন পর্যন্ত সব যুদ্ধেই তারা অস্ত্রের ধার পরীক্ষা এবং অস্ত্র ব্যবসায় করেছে তৃতীয় কোনো গরিব দেশে। কাজেই ভবিষ্যতে আমেরিকার সাথে চীন-রাশিয়ার সংঘর্ষ হলে তার সম্ভাব্য ময়দান হতে পারে বাংলাদেশের সীমানার উত্তরের পাহাড়ি ভূমি থেকে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। এমতাবস্থায় আমাদের কূটনীতি চলছে একটি ‘কষে বাঁধা’ রশির ওপর দিয়ে। এখানে সামান্য ভুল করলে দেশ ও জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে রক্ষা করুন।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email: maksud2648@yahoo.com