শামীমাকে নিয়ে বাংলাদেশের বক্তব্যে ধাক্কা খেল যুক্তরাজ্য
সিরিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগ দেওয়া শামীমা বেগম বাংলাদেশেরও নাগরিক—এমন যুক্তিতে তাঁর ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করে দিয়েছে যুক্তরাজ্য। প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শামীমা বাংলাদেশের নাগরিক নন। তাঁর বাংলাদেশে ফেরার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না।
বাংলাদেশের এই বক্তব্য শামীমার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্তের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা না করে ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়াই তড়িঘড়ি করে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শামীমার নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে সমালোচনা চলছে। শামীমা ও তাঁর নবজাতক শিশুর নাগরিকত্ব নিয়ে যুক্তরাজ্যে চলমান বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া।
গতকাল বুধবার যুক্তরাজ্যের ইংরেজি দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, শামীমাকে ভুলভাবে বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করায় বাংলাদেশ সরকার গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। গণমাধ্যমের খবর থেকে শামীমার নাগরিকত্ব বাতিলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বাংলাদেশ জানতে পারে বলে তিনি জানান।
শাহরিয়ার আলম বলেন, শামীমা বাংলাদেশের নাগরিক নন। তিনি জন্মগতভাবে যুক্তরাজ্যের নাগরিক। তিনি কখনো বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদনও করেননি। ফলে, বাংলাদেশে তাঁকে ফিরতে দেওয়ার প্রসঙ্গও উঠতে পারে না।
পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রিন একাডেমির ছাত্রী শামীমা বেগম ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আরও দুই বান্ধবীসহ সিরিয়ায় পাড়ি দেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর। সেখানে আইএসে যোগ দিয়ে তিনি ডেনমার্কের বংশোদ্ভূত এক ধর্মান্তরিত ‘জিহাদি’কে বিয়ে করেন। দীর্ঘ চার বছর পর গত সপ্তাহে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় আল-হওর শরণার্থীশিবিরে শামীমার দেখা পান এক ব্রিটিশ সাংবাদিক। সাক্ষাৎকারে শামীমা যুক্তরাজ্যে ফিরে আসার আকুতি জানান। বর্তমানে ১৯ বছর বয়সী শামীমা গত রোববার এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। এর আগে তাঁর আরও দুই সন্তান ছিল। তারা অপুষ্টি ও অসুস্থ হয়ে মারা গেছে বলে জানান শামীমা। নবজাতককে বাঁচিয়ে রাখতে তিনি যুক্তরাজ্যে ফিরে আসার আকুতি জানান।
যুক্তরাজ্যের অভিবাসন বিভাগ (হোম অফিস) গত মঙ্গলবার শামীমার মায়ের কাছে লেখা এক চিঠিতে জানায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ শামীমার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শামীমার সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে থাকলে এই সিদ্ধান্তের বিষয়টি যেন তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
গতকাল বুধবার আইটিভির এক সাংবাদিক নাগরিকত্ব বাতিলের ওই চিঠির একটি অনুলিপি শরণার্থীশিবিরে অবস্থানরত শামীমার হাতে দিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চান। শামীমা বলেন, এই সিদ্ধান্তে তিনি কিছুটা হতবাক। তিনি ও তাঁর সন্তানের প্রতি এটা অন্যায় বলে মন্তব্য করেন শামীমা। তাঁর স্বামী ডেনমার্কের নাগরিক। সেই সূত্রে তিনি ডেনমার্কের নাগরিকত্বের জন্য আবেদনের চেষ্টা করবেন বলেও জানান।
পরে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শামীমা বলেন, তাঁর কেবল যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব আছে। সেই নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে আলোচনাও করা হয়নি। এখন তাঁর আর কিছুই থাকল না। শামীমা বলেন, তিনি বাংলাদেশে কখনো যাননি। তাঁর বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেই।
নাগরিকত্ব বাতিলের চিঠিতে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, শামীমার মা বাংলাদেশের নাগরিক। তাই বাংলাদেশের আইনানুযায়ী শামীমাও বাংলাদেশের নাগরিক অথবা বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
শামীমার পারিবারিক আইনজীবী তাসনিম আকুঞ্জি নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মঙ্গলবার সংসদে জানান, প্রায় ৯০০ ব্রিটিশ নাগরিক সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দেয়। এদের অন্তত ২০ শতাংশ সেখানে নিহত হয়েছে। ৪০ শতাংশ যুক্তরাজ্যে ফেরত এসেছে। আইএসে যোগ দেওয়া প্রায় ১০০ ব্যক্তির ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে।
শামীমার নাম উল্লেখ না করেই সাজিদ জাভিদ বলেন, মায়ের নাগরিকত্ব বাতিল হলেও সন্তানের ব্রিটিশ নাগরিকত্বের অধিকার ক্ষুণ্ন হবে না।
শামীমার নাগরিকত্ব বাতিলের বৈধতা ও তাঁর যুক্তরাজ্যে ফেরার অধিকার নিয়ে দেশটিতে এক অভিনব আইনি বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী নাগরিকত্ব বাতিল করে কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রহীন করা যায় না।
যুক্তরাজ্যে জন্ম ও বেড়ে ওঠা এবং সিরিয়ায় জঙ্গিবাদে জড়ানো কোনো ব্যক্তিকে বাংলাদেশ কেন গ্রহণ করবে, সে প্রশ্নও উঠেছে। বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো পরামর্শ ছাড়াই শামীমাকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে চালিয়ে দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও হচ্ছে আলোচনা। যুক্তরাজ্যে ফিরিয়ে এনে শামীমাকে বিচারের মুখোমুখি করানোটাই যৌক্তিক বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।