From Sonia Rahman’s Facebook entry 22 June 2023
বর্ষাকালে যখন গ্রামের বাড়ি যেতাম তখন মেঘনা নদীর দু’কুল ছাপানো রূপ ভয়ানক সুন্দর লাগতো! ছোট্ট ছই তোলা নৌকায় মেঘনার উত্তাল ঢেউ এ দুলতে দুলতে নানাবাড়িও যেতাম। মাঝে মাঝে বড় পণ্যবাহী (সাধারণত পাট) নৌকার দেখা পেতাম; সেখানে সাদা রঙের বিশাল পাল তোলা ( সাদা পালে কয়েক রঙের তালিও দেখতাম)। নৌকার সাথে লম্বা দড়ি বাঁধা থাকতো… দূরের তীর ধরে দুইজন সেই দড়ি টেনে নিয়ে যেতো( যাকে গুণ টানা বলে)। ছোটবেলায় সেই দুইজন মানুষ কে আমার অতিমানব বলে মনে হ’তো। এত বড় বড় নৌকা টেনে নিয়ে যাচ্ছে – না জানি তারা কত বড় “সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান!!( ছোট বেলায় তাকেই সবচেয়ে শক্তিশালী বলে মনে করতাম)।
দাদাবাড়ি তে গেলেই আমার কাজিনেরা তাদের শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসতো! প্রচলিত ভাষায় একে
‘নাইওর’ আসা বলা হতো। বিশেষ করে শীতকালে তো খুব ধুমধাম করে ‘নাইওর’ আনা হতো! বাড়ির মেয়েরা ‘নাইওর’ আসতো আর বউরা ‘ নাইওর’ যেতো!
সাধারণত ভাইয়েরা যেতো বোন কে ‘ নাইওর’ আনতে!
আহা!! বাপের বাড়ি আসা!!
কী আনন্দ!!!
এমন ও হতো, বাড়ির মেয়েরা বছরে/ দুই বছরে একবার ই বাপের বাড়ি ‘নাইওর’ আসার সুযোগ পেতো! চাইলেই শ্বশুর বাড়ি থেকে বের হওয়া যেতো না; তাদের অনুমতি সাপেক্ষে ‘ নাইওর’ আসা বিবেচনা করা হতো। এজন্য প্রতিটি বিবাহিত নারীর কাছে ‘নাইওর’ আসা একটা আরাধ্য বিষয় ছিল!!
খুব ছোটবেলায় কারো গলায় একটা গান শুনেছিলাম,
যার বিষয়বস্তু ছিল ‘ নাইওর’…. কোনও কারণে এই গান শুনে বুকের ভেতর একধরণের হাহাকার জেগেছিল। গানের বিষন্ন সুর কিংবা গায়কী টা খুব বিষাদময়।
কোন গান বলেন তো!!!
” কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া
আমার ভাইধন রে বইলো নাইওর নিতো বইলা “….
এমন বিষাদময় সুর খুব কম গানেই পাওয়া যায়।
এই গানের প্রতিটা পঙক্তি যেনো হাহাকার মেশানো।
বাপের বাড়ি যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ভাই এর দেখা পাবার জন্য বোনের এমন তীব্র আকুতি বাংলা ভাষায় আর রচিত হয়েছে বলে জানা নেই।
এমন অসাধারণ গানটি শচীন কত্তা’র!!
আজ রাজপুত্র কুমার শচীন্দ্রচন্দ্র দেববর্মণের গল্প বলিঃ
এক সময় কুমিল্লা ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত।
ত্রিপুরার ( কুমিল্লা) রাজপরিবারের কুমার বাহাদুর নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণ ছিলেন সেতারবাদক ও ধ্রুপদী সঙ্গীত শিল্পী। মনিপুর রাজপরিবারের মেয়ে নিরুপমা দেবী ও কুমিল্লার কুমার বাহাদুর নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণ ছিলেন শচীন দেববর্মণের বাবা ও মা। অনেক ভাইবোনের মধ্যে কুমার শচীন ছিলেন তুখোড় একজন। বাড়ির প্রায় সকলেই গান করতেন।
শচীন দেব এর গানের হাতেখড়ি পিতার হাতেই।
রাজপরিবারের নানা রাজনীতির প্রেক্ষিতে তাঁরা কুমিল্লার চর্থায় ৬০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত প্রাসাদে চলে আসেন। প্রাইমারি স্কুল আগরতলায় হলেও হাই স্কুল, কলেজ ও স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেছেন কুমিল্লাতেই।
অনেক আগে থেকেই কুমিল্লা অঞ্চল ছিল শিক্ষিত ও সংস্কৃতবান মানুষের বসবাস। শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে কুমিল্লা অঞ্চল এগিয়ে ছিল দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায়। শচীন কত্তা’দের বাড়িতে প্রতিদিন ই কুমিল্লার অনেক নামজাদা ও সংস্কৃতবান মানুষের আসা যাওয়া ছিল। আড্ডা, আলোচনার পাশাপাশি গান বাজনাও চলতো সমান তালে। মাঝে মাঝেই এই বাড়ির আসর জমাতেন কবি নজরুল ইসলাম ও।
এই পরিবারের সাথে বিদ্রোহী কবির ছিল গভীর পারিবারিক সখ্যতা।
সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন বলেই তিনি লোকসংগীতের ভেতর আত্মার খোড়াক খুঁজেছেন। একটা স্মৃতি চারণ থেকে জানা যায়, এই বাড়ির দুই পরিচারকের কাছ থেকে শচীন কত্তা মাটির গান রপ্ত করেছেন। একজনের সুর করে রামায়ন পাঠ আর অন্যজনের দোতরা বাজিয়ে দরাজ গলার ভাটিয়ালি গান তাঁকে ভাসিয়ে নিতো বাংলার জলে, হাওয়ায়, মাটিতে। আমৃত্যু কথা বলেছেন একেবারেই ‘বাঙাল’ ভাষায়। কোলকাতা ও মুম্বাই গিয়েও প্রায়ই স্বপ্ন দেখতেন কুমিল্লার দীঘির চারপাশ ঘুরে ঘুরে টিপরাই বাঁশী বাজাচ্ছেন।
রাজপরিবারের সন্তান হয়েও তাঁর রক্তে মিশে ছিল বাংলার মাটি। তাই বুঝি তাঁর প্রায় প্রতিটি গানের ভেতর আমরা বাংলার মাটির ছোঁয়া পেয়েছি।
তাঁর ভাষায়-
“ত্রিপুরার ধানের ক্ষেতে চাষী গান গাইতে গাইতে ধান চাষ করেন, মাঝিরা গানের টান না দিয়ে নৌকা চালাতে জানে না, জেলেরা মাছ ধরে গান গেয়ে। সেখানের লোকেদের গানের গলা ভগবান প্রদত্ত।”
অনেক নামকরা ওস্তাদের কাছে গানের তালিম নিয়েছেন। সংগীতাচর্য কৃষ্ণচন্দ্র দে এর কাছেও গান শিখেছেন। সেই সূত্রে বিখ্যাত শিল্পী মান্না দে এর একটা স্মৃতিকথা থেকে জানতে পারি, কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে বলেছিলেন- শচীন দেব এর অনুনাসিক স্বর ই তাঁর স্টাইল, নিজস্বতা।
কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম কুমিল্লার চর্থায় শচীন দেববর্মণের আদি বাড়িতে। ছুটির দিন বলে মূল গেট তালাবদ্ধ ছিল। তাই বলে কি সেই বাড়িতে ঢুকবো না?
গেটের ফাঁক গলে শরীর টা কে হাঁচড়েপাঁচড়ে নিয়ে পুরো টিম পঙ্গপালের মতো ঢুকেছি।
বিশাল জায়গা নিয়ে অভিজাত বাড়িটি নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। সংস্কার করা হয়েছে বলে জানলাম। বাড়ির সামনের তালপুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে শিহরিত হ’লাম। তারুণ্যের রোম্যান্টিক সেই গানগুলো মাথার ভেতর ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজতেই থাকলো….যার বেশীরভাগ গান শচীন কত্তার সহধর্মিণী শ্রদ্ধেয় মীরা দেবী’র লেখাঃ
*তুমি এসেছিলে পরশু কাল কেনো আসোনি
*বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা
*বাঁশী শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি
*শোনো গো দখিন হাওয়া….
*তুমি আর নেই সে তুমি
*নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক
এছাড়া – *তাকডুম তাকডুম বাজাই
কিংবা *নিশিথে যাইও ফুলবনে ইত্যাদি গানের আবেদন অমলিন রয়েছে আজও!
বন্ধের দিন বলে বাড়িটির সদর দরজা বন্ধ!
তাই বলে “বাঙালি কে দাবায় রাখা” কি যায়?
কে যেনো এসে ফিসফিস করে বললো,
পেছনের একটা দরজা খোলা….
ব্যাস! পঙ্গপাল এইবার বাড়ির ভেতরে!
আধো আলো ছায়াতে বাড়ির ভেতর টা দেখার চেষ্টা করলাম। পুরো বাড়ি ই ফাঁকা। আসবাবপত্র হীন।ভেতরটা যথেষ্ট ভালো অবস্থায় আছে।
অনেকগুলো রুম।
মাঝখানে চক মেলানো বড় হলঘর;
মনে হলো এটা রাজবাড়ির বৈঠকখানা!
ঠিক মাঝখানের ছাদের ডিজাইন টা অন্যরকম।
সেখানে বাইরের আলো আসার জন্য স্কয়ার ফোকড়
দেয়া। কী সাংঘাতিক আইডিয়া।
লম্বা চওড়া বিশাল খিলান দেয়া বারান্দা। লোহা ও কড়িকাঠের বর্গা দেয়া ছাদ এখনও অক্ষত রয়েছে।
বাড়ির একপাশে সংগীতজ্ঞ শচীন দেববর্মণের শ্রদ্ধা বেদী সহ ম্যুরাল আছে।
ইচ্ছে করলেই এই ঐতিহাসিক বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করা যায়। বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সদিচ্ছা কামনায়।
কখনো সুযোগ হলে দেখে আসবেন।