পৌত্তলিকতার অনুসারী ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠী হিন্দুত্ববাদী ভারতের সহায়তাক্রমে বিগত এক যুগ ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রেখেছে। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই গোষ্ঠী ইসলামের চেতনা ও ঐতিহ্যবিনাশী [De-Islamization] এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলেছে। এই সময়কালে স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তক থেকে ইসলামী দর্শন ও মূল্যবোধ বাদ দেয়া হয়েছে, ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে মুসলমানদের বীরত্বগাঁথা উপেক্ষা করে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কল্প-কাহিনি সাজিয়ে তাদের জাতীয় বীরের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, টেলিভিশনের অনুষ্ঠানগুলোতে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ প্রচার করে পৌত্তলিকতার জয়গান গাওয়া হয়েছে, সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে ইসলাম ধর্ম এবং আমাদের রসূল হযরত মোহাম্মদ [সাঃ] এর বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচারকে আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতারূপে মহীয়ান করা হয়েছে, তথাকথিত ইসলামী জঙ্গী দমনের নামে গ্রামাঞ্চলের হতদরিদ্র নারী, পুরুষ ও শিশুকে নিয়মিত বিরতিতে নির্মমভাবে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ইসলাম ধর্মপালনকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, পূজা-অর্চনার পৌত্তলিক সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হয়েছে, ব্যক্তিপূজা ও মূর্তিপূজাকে রাষ্ট্রীয় আচার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, এবং একদা মসজিদের নগরী ঢাকাকে মূর্তির নগরীতে পরিণত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের এমন পরিনতিতে অবাক হওয়া অনুচিত হবে। হিন্দু সংস্কৃতির আদর্শে লালিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনুসারীদের তরফ থেকে এ জাতীয় রাষ্ট্র পরিচালনাই প্রত্যাশিত ছিল। বিস্ময় অন্যখানে। বাংলাদেশের নব্বই শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর এক উল্লেখযোগ্য অংশ অন্তহীন অনাচারে কেবল নীরবই থাকে নাই, তারা এই ইসলাম বিদ্বেষী কর্মকাণ্ডে রীতিমতো ইন্ধন জুগিয়েছে। জনসংখ্যার বাকী অংশ ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে নীরবতা পালন করে জীবন ও জীবিকা রক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছে। বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত সম্পর্কে আলোচনা অর্থহীন। এই শ্রেণিটির জীবন কেবল মুনাফা এবং অশ্লীল বিলাসব্যসনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। ধর্ম, দেশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশের লুটেরা উচ্চবিত্ত কখনও মাথা ঘামায় না। ফ্যাসিস্ট সরকার অঢেল লুটপাটের সুযোগ করে দেয়ায় এই গোষ্ঠী বরং হাসিনার প্রতি বেশ সন্তুষ্ট।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন যে, একটি দেশে মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণি মেধা, আদর্শ এবং সৃজনশীলতার জোগানদারের দায়িত্ব পালন করে থাকে। দুর্ভাগ্যক্রমে, বাংলাদেশে বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চলছে তার সবচেয়ে কার্যকর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর। শহুরে মধ্যবিত্ত বাংলাদেশে এখন হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির প্রধান সমর্থক ও প্রবর্তকে পরিণত হয়েছে। পৌত্তলিকতার আচার-অনুষ্ঠানের জাঁকজমকে মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণীর চোখ ধাধিয়ে গেছে। ইসলামে জাঁকজমকের কোন স্থান না থাকায় বর্তমান ফেসবুক প্রজন্মের কাছে ধর্মটি সম্ভবত নিতান্তই নিরস ও বিধিনিষেধ কন্টকিত বিবেচিত হচ্ছে। হিন্দু ধর্মের পূজার বাহার এবং হোলির ঝলক ইসলামী মূল্যবোধ বিবর্জিত তথাকথিত সেক্যুলার পরিবারের তরুণদের হয়তো তাদের অজান্তেই বিদেশী আগ্রাসনের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। বাকী রইলো নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠী। বাস্তবতা হোল ফেসবুক সংস্কৃতি তাদেরকেও মত্ত করে রেখেছে। আকাশ সংস্কৃতির কল্যাণে পৌত্তলিক জাঁকজমকের প্রতি আকর্ষণ এখন শহর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলেও বিস্তৃত হচ্ছে।
অনেক পাঠক হয়তো তর্ক তুলে বলবেন, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তো হয়েছে, আলেমরা শাপলা চত্বরে শহীদও তো হয়েছেন। এখনও তো মূর্তির সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আলেমরাই প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন। আমি অবশ্যই মেনে নিচ্ছি যে আলেম সমাজ ২০১৩ সালে প্রতিবাদ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন এবং ফ্যাসিবাদী শাসনের শত প্রতিকূলতার মধ্যে বসবাস করে এখনও তারা মূর্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু তাদের প্রতিবাদের ভাষা এবং চরিত্র নিয়ে আমি বড় সংশয়ে পড়ে গেছি। একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। আমার অভিমতে আপনারা সন্তুষ্ট নাও হতে পারেন। এমনকি বিরক্ত বোধও করতে পারেন।
ব্যাখ্যা শুরু করার আগে বলে রাখা প্রয়োজন যে, ইসলামের ইতিহাস নিয়ে সামান্য পড়াশোনা করলেও শরিয়া সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞ। মূর্তি বনাম ভাস্কর্যের যে কূটতর্ক পৌত্তলিকতার অনুসারীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে তুলেছেন সেই অর্থহীন আলোচনাতেও আমি যাচ্ছি না। আমি ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলছি। একটা নিরীহ প্রশ্ন দিয়ে কথা শুরু করছি। আমাদের মহানবী[সাঃ] পবিত্র কাবা ঘরের মূর্তি কবে এবং কেন ভেঙেছিলেন? ইসলামের ইতিহাসের বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে জেনেছি যে, এটা ঘটেছিল অষ্টম হিজরিতে [৬২৯ খ্রিষ্টাব্দ] মক্কা বিজয়ের পর। তিনি নিজে আল্লাহ্র ঘরে প্রবেশ করে মূর্তি ভাঙতে ভাঙতে বলেছিলেন, সত্যের বিজয় হয়েছে, মিথ্যা দূরীভূত হয়েছে। পবিত্র কাবা ঘর থেকে মূর্তি অপসারিত হওয়ার পরও হযরত মোহাম্মদ [সাঃ] কে তায়েফ নগরীতে মূর্তিপূজকদের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে হয়েছে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে জয়লাভ করেই মুসলমানদের তায়েফ নগরীর বিশাল মূর্তি ভাঙতে হয়েছে। আর মূর্তি ভাঙ্গার মূল উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহ্র একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করা। পবিত্র কোরান শরীফে আল্লাহ্তায়ালা শির্ককে নিকৃষ্ট পাপ ঘোষণা করেছেন। শেখ মুজিবকে নিয়ে বাংলাদেশে যা হচ্ছে তা পরিষ্কার শির্ক। আমার ইতিহাস বর্ণনায় অথবা ইসলামের মর্মবাণী অনুধাবন করায় কোন ভুল হয়ে থাকলে আগে থেকে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্তায়ালার কাছে সর্বান্তকরণে মাফ চেয়ে রাখছি।
মক্কাবিজয়ের আগে পৌত্তলিক কুরাইশদের বিরুদ্ধে রসূল [সাঃ] কে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে মোকাবেলা করতে হয়েছিলো। বদর, ওহোদ এবং খন্দকের যুদ্ধের পর মুসলমানরা মক্কা বিজয় করতে সমর্থ হন। আল্লাহতায়ালা হযরত মোহাম্মদ [সাঃ] কে এই পৃথিবীতে ইসলামের বাণী নিয়ে পাঠিয়েছিলেন মানুষের কল্যাণ ও হেদায়েতের জন্য। কোন মূর্তির হেদায়েতের জন্য পাঠান নাই। মুসলমানদের জেহাদ করতে হয়েছে অবিশ্বাসী মানুষের বিরুদ্ধে, কোন মূর্তির বিরুদ্ধে নয়। হযরত মোহাম্মদ [সাঃ] সমস্ত জীবন অতিবাহিত করেছেন মানুষের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়ার কাজে। মূল উদ্দেশ্য মানুষের হেদায়েত ও শির্কের উচ্ছেদ। মিথ্যার প্রতীক মূর্তি ভাঙ্গা ছিল সেই প্রক্রিয়ায় উপলক্ষ মাত্র।
দুর্ভাগ্যক্রমে, বাংলাদেশে আলেমদের প্রতিবাদের ধরন দেখে মনে হচ্ছে, তাদের আন্দোলন শুধুই মূর্তির বিরুদ্ধে, শির্ককারী মূর্তি নির্মাতা কিংবা পূজারীদের বিরুদ্ধে নয়। আমি কোথাও ইসলামের এমন ব্যাখ্যা পাই নাই। শেখ মুজিবকে পূজার প্রতীক হিসেবেই বাংলাদেশে হাজার হাজার মূর্তি নির্মিত হচ্ছে। এগুলোকে ভাস্কর্য নামে ডাকলেও মূল পূজার উদ্দেশ্যে কোন ব্যতিক্রম ঘটছে না। তাহলে ইমানদার মুসলমানের লড়াই কার বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে? শেখ মুজিবের মূর্তির বিরুদ্ধে নাকি মূর্তি পূজারী শেখ হাসিনা ও তার পৌত্তলিক সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে? হেফাজত নেতৃবৃন্দ বারে বারে সাফাই গাইছেন যে, শেখ মুজিবের প্রতি তাদের অন্তরে অসীম শ্রদ্ধা। আমাদের আলেমদের মধ্যে কেউ কেউ এমন কথাও বলেছেন যে, তাদের হৃদয়ের মধ্যে নাকি শেখ মুজিব সর্বদা সসন্মানে বিরাজমান। যদি তারা এমন কথা বলে থাকেন তাহলে সেটাও কি ইসলামের মর্মবাণীর সাথে সাংঘর্শিক হচ্ছে না? বাইরের কাঁদামাটির মূর্তি ভেঙে আমি যদি হৃদয়ে স্থাপিত মুজিবের মূর্তির পূজা করতে থাকি, সেক্ষেত্রে ইসলামের একত্ববাদের প্রতি আমার সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের জায়গায় কি খানিকটা হলেও ফাঁক থেকে যাচ্ছে না?
জালিম শাসককে মেনে নিয়ে জড় পদার্থের বিরুদ্ধে হুঙ্কার আমাদের ইমানের দুর্বলতাকেই বরং প্রকাশ করছে। অনেক আলেম আবার জালিম, পৌত্তলিকতার অনুসারী শাসককে মাননীয় সম্বোধন করে তাকে শত বছর ক্ষমতায় থাকার গ্যারান্টি দিচ্ছেন। ইসলামের বিরুদ্ধচারণকারী কোন ব্যক্তি কি করে আলেম সমাজের কাছে মাননীয় হতে পারে সেটি আমার মাথায় ঢুকছে না। স্বয়ং মূর্তি নির্মাতার কাছে মূর্তির বিরুদ্ধে দাবি জানানোটাও আমার কাছে হাস্যকর ঠেকছে। আমি মনে করি, আলেমসমাজসহ বাংলাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণআন্দোলনের মাধ্যমে মূর্তি নির্মাতা, পৌত্তলিকতার অনুসারী, ফ্যাসিস্ট শাসককে উৎখাতই শির্কসহ সকল অনাচার থেকে আমাদের মুক্তির একমাত্র পথ। ফ্যাসিবাদের অবসান হলে শেখ মুজিবের হাজার হাজার মূর্তি জনগণই টেনে নামাবে। কারো কাছে দাবি জানানোর প্রয়োজন হবে না। ইরাকে সাদ্দামের মূর্তির পরিণতি আমরা কি দেখি নাই? এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে লেনিন এবং স্ট্যালিনের মূর্তিও টেনে নামানো হয়েছে। ভারতের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত এক ছবির নাম, হীরক রাজার দেশে। ঐ ছবির শেষ দৃশ্যে জনগণের অত্যাচারী রাজার মূর্তির গলায় দড়ি বেঁধে টেনে নামানোর একটা দৃশ্য আছে। সত্যজিৎ রায় মুসলমান ধর্মাবলম্বী ছিলেন না। কোন ধর্মবোধ থেকে তিনি মূর্তি ভাঙ্গার দৃশ্য চিত্রায়িত করেন নাই। সত্যজিৎ রায় তার ছবিতে মূর্তির বিনাশ দেখিয়েছেন জালিম শাসকের পতনের প্রতীকরূপে। ছবির ঐ দৃশ্যে চমৎকার দুটো পংক্তি অবিস্মরণীয় হয়ে আছে,
দড়ি ধরে মার টান
রাজা হবে খান খান
বাংলাদেশেও মুজিবের মূর্তির পতনের জন্য ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনার পতন অপরিহার্য। অতএব, আসুন দৃঢ় ঈমান নিয়ে আমরা রসুলের[সাঃ] জেহাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের পৌত্তলিকপন্থী শাসকগোষ্ঠীর পতনের লক্ষে রাস্তায় নামি। মূর্তির নির্মাতা ক্ষমতায় না থাকলে মূর্তি নির্মাণও হবে না, মূর্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনেরও আর প্রয়োজন পড়বে না।
আল্লাহু আকবর