লুই কানের নকশা কেন বাইবেল হলো ?
( দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত উপ-সম্পাদকীয় কলাম )
প্রেয়সীর গাল এবং দেশের পতাকা- এ দুই জায়গায় প্রেমিক বা ভক্তকুল কোনো দাগ বা খুঁত দেখতে চান না। এসব নিয়ে পাগল প্রেমিকদের অনেক পাগলামির গল্প শোনা যায়। লাখ লাখ ডলার খরচ করে কসমেটিক সার্জারির মাধ্যমে প্রেয়সীর এক গাল থেকে দাগ সরানো হয়, আবার অন্য গালে তিল বা বিউটি স্পট বসানো হয়। সেই তিল একবার এই গালে আবার কিছু দিন পর অন্য গালে উদয় হয়।
এসব প্রেমিক পুরুষের মতো প্রেমিক জাতিও রয়েছে। এরা একই কিসিমের মজনু বা প্রেমিক। দেশপ্রেম বা ভালোবাসার প্রদর্শনীতে এরা সারা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেয়। তাদের এ প্রেমের রঙ আর ঢঙ দুটোই চমকপ্রদ। এরা নিজের প্রেমিকাকে সামান্য লোভে বা ভয়ে দস্যু বা ডাকাতের হাতে তুলে দেয়। অর্থাৎ জাতীয় স্বার্থ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সামান্য খুদকুঁড়া বা উপঢৌকনের বিনিময়ে অবলীলায় অন্যের হাতে সমর্পণ করে। অন্য দিকে, প্রেমাস্পদের মসৃণ গাল বা জমিন নিয়ে গান ও কবিতা লিখে খাতা ভরে ফেলে।
কিন্তু এবার ব্যাপারটি একটু জট পেকে গেছে। কারণ গালটি অন্যেরÑ কিন্তু কসমেটিক সার্জারিতে পকেটটি কাটা পড়ছে আমাদের! পতাকাটি পাকিস্তানের কিন্তু তার জমিন বা গাল থেকে ‘অনাকাক্সিক্ষত’ একটি দাগ সরানোর জন্য হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হচ্ছে বাংলাদেশের। শুধু পুরনো নকশা সংগ্রহ বাবদই এই জাতির পকেট থেকে খসে গেছে চার লাখ ডলার! পুরো কসমেটিক সার্জারি বাবদ কত খরচ (আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক) হবে- তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। চাঁদ-তারার এই জমিন থেকে দাগটি সরানোর জন্য কসমেটিক সার্জনদের সবাই বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বলে দাবি করছেন।
নিজের পতাকার চেহারা দাগমুক্ত রাখতে পাকিস্তান যদি এ কাজটি করত, তখন হয়তো বলার কিছু থাকত না। এই মজনু প্রেমিকটি যদি পাকিস্তানের আবেগ বা গন্ধযুক্ত কোনো রাজনৈতিক দল হতো, তার পরও একটু যুক্তি বা সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়া যেত। কিন্তু সহস্রাব্দের একটি বড় কৌতুক বা চমক হলো- প্রেয়সীর গাল থেকে এই অনাকাক্সিক্ষত দাগটি সরাতে উদ্যোগী হয়েছে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বলিষ্ঠ দাবিদার একটি মহল- যারা পাকিস্তান শব্দটি বা চাঁদ-তারা প্রতীকটি দেখামাত্রই হাজার ভোল্টের শক খান এবং তাদের নিরীহ ও নির্দোষ প্রতিপক্ষকেও সকাল-বিকেল রুটিনমাফিক পাকিস্তানে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
আমরা দেখেছি, বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলটি কোনো কাজ সরাসরি করে না। একটা করতে চাইলে কৌশল খাটিয়ে অনেক দূর থেকে অন্যটা বলে। সব কিছু দেখে এখন মনে হচ্ছে, এটা যেন গল্পের সেই চাষি, যিনি বুদ্ধির জোরে একা একাই চার চোরকে শাস্তি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই ফর্মুলা বা বুদ্ধি খাটিয়ে জামায়াতকে সাইজ করা হয়েছে, এখন বোধহয় বিএনপিকে সাইজ করার পালা। আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে যে কাজটি করা সম্ভব হয়নি, বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী দিয়ে সে কাজটিও অনেকটা সম্ভব হয়েছে। ১৯৯৪-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন জামায়াতের সাথে যুগপৎ বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল, তখন আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবীরা এ কাজটি তাদের পছন্দের দলটির জন্য সহজ করে দিয়েছিলেন। জামায়াতকে আওয়ামী লীগের সাথে দেখে কোনোরূপ গোসসা করেনি। কিন্তু বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের চেতনা দেখলে মনে হয় সূর্যের চেয়েও বালুর উত্তাপ বেশি। এখন জিয়ার কবর সরানোর মোক্ষম সময় উপস্থিত হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের বহু পুরনো এই খায়েশটি পূরণের নিমিত্তে কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক প্লট তৈরি করা দরকার হয়ে পড়ে। তজ্জন্যে লুই কানের স্থাপত্য নকশাকে ‘একধরনের বাইবেল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা দরকার। বাইবেলকে যেমন পরিবর্তন করা যায় না, তেমনি লুই কানের এই স্থাপত্য নকশাও অপরিবর্তনযোগ্য। ষাটের দশকে তদানীন্তন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাবধারার খচিত নকশায় একটা দাগ বসিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত এই জাতি ভয়ানক পাপ করে ফেলেছে! শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াসহ কয়েকজনের কবর সরিয়ে এখন সেই পাপ মোচন করতে হবে? এই পাপের ভয়ঙ্কর পরিণতি বোঝাতে সব মেশিনারি কাজে লেগে গেছে। কিছু মহাজ্ঞানী আবার চাঁদ-তারার মূল থিমটিকে এক পাশে রেখে এখানকার প্রকৃতি ও মানুষের সাথে এই নকশার একটা মিল টানার কোশেশ শুরু করে দিয়েছেন।
সরকার আইয়ুব খানের দু’টি জিনিসের প্রতি তাদের মারাত্মক দুর্বলতা প্রদর্শন করে চলেছে। এক, আইয়ুব খানের সেই ‘কম গণতন্ত্র আর অধিক উন্নয়নের’ মসলা। দুই, আইয়ুব খানের পরিকল্পনায় ও নির্দেশে প্রণীত জাতীয় সংসদের নকশা। ক্রিসেন্ট লেককে চাঁদ এবং সংসদ ভবনকে তারা বানিয়ে এ নকশাটি অঙ্কন করা হয়েছিল। মূলত এটি ছিল পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দর্শন, যা লুই কান তার স্থাপত্যে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবর যদি লুই আই কানের সেই মূল নকশাকে বিঘিœত করে, তবে তা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্য আরো স্বস্তির কথা। জিয়া শুধু জীবিত থাকতেই পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গড়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেননি। মরণের পরও পাকিস্তানের মূল নকশায় বিঘœ সৃষ্টি করেছেন।
ব্যাপারটা যেন এমন, সতীনের কাঁথা-বালিশ-লেপ-তোশককে ঘৃণাভরে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু তার তৈরি বিল্ডিং, এমনকি খাটপালঙ্ক প্রভৃতি দারুণ তৃপ্তিসহকারে উপভোগ করা হচ্ছে।
আমরা জানি, স্থপতি লুই কান কোনো মহৎ শিল্পকর্মের টানে নয়, বরং নিজের খরিদ্দারের ফরমায়েশ বা খায়েশমতো এ নকশাটি তৈরি করেছিলেন। লুই কান খ্যাতিমান স্থপতি; কিন্তু তার খ্যাতি এমন মানের নয় যে, সারা পৃথিবীর মানুষ এক নামে তাকে চেনে। পৃথিবীর সেরা ও বিখ্যাত ১০০টি স্থাপত্যের মধ্যেও আমাদের জাতীয় সংসদ বা লুই কানের অন্য কোনো কর্ম পড়ে না। তার নকশাকে অরিজিনাল অবয়বে ধরে রাখতে আন্তর্জাতিক কোনো চাপ নেই, যেমন রয়েছে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ ধরে রাখতে কয়লা বিদ্যুৎ কারখানা বন্ধ করার চাপ। সরকার সেগুলোকে কোনো পাত্তা বা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
মুসলিম জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজেতা গাজী সালাহউদ্দীনের কবর নিয়ে পরে খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা যা করেননি, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার কবর নিয়ে বর্তমান সরকার ও তার পেছনের শক্তি তার চেয়েও বেশি বিদ্বেষ প্রদর্শন করে চলেছে। জিয়ার প্রতি তাদের আক্রোশ এত তীব্র কেন? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বিষয়টির আরেকটু গভীরে যেতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধে সশরীরে নেতৃত্বদানকারী মরহুম তাজউদ্দীন আহমেদের কন্যা শারমিন আহমেদ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা তার ‘নেতা ও পিতা’ বইটিতে তুলে ধরেছেন। তিনি আমেরিকার উদাহরণ টেনে একক জাতির পিতা ধারণার পরিবর্তে জাতির পিতাসমূহের কথা উল্লেখ করেছেন। আমাদের দুই টাকা, পাঁচ টাকা, দশ টাকাসহ সব নোটে একই ব্যক্তিকে তুলে ধরা হয়েছে; এটা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। অন্য দিকে, আমেরিকায় তাদের জাতির পিতাদের ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ছবি দেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে সশরীরে নেতৃত্বদানকারী তাজউদ্দীন আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীকে এক আজব কারণে ইতিহাসের সাইড লাইনে রেখে দেয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার আয়োজন করা হয়েছে। মওলানা ভাসানী সবার আগে পাকিস্তানিদের ‘ওয়ালাইকুম সালাম’ জানিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি সৃষ্টিতে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তার প্রতিও একই আচরণ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে স্বাধীনতার ঘোষক জিয়ার প্রতি বিদ্বেষের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। কারণ ইতিহাসের বাঁকে যেখানেই অন্যদের ভীরুতা, কাপুরুষতা ও সুবিধাবাদী ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেখানেই জিয়ার উপস্থিতি জাজ্বল্যমান। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে ক্ষেপে উঠলে সব চাচা আপন আপন প্রাণ বাঁচাতে বর্ডারপানে ছুটে গেছেন, তখন ‘উই রিভোল্ট’ বলে পুরো স্রোতকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন তদানীন্তন মেজর জিয়া। প্রতিকূল পরিবেশে বাঙালির স্বভাব কেমন হয়, তা বর্তমানে একটু আঁচ করা যাচ্ছে। সবাই গোপনে থেকে মিহি মিহি স্বরে প্রতিবাদ করাকেই নিরাপদ মনে করেন। ভীরু বাঙালির এই চিরন্তন স্বভাব কখনো ভিন্ন ছিল না।
‘নেতা ও পিতা’ বইটিতে শারমিন আহমেদ আরো জানিয়েছেন, তার পিতা তাজউদ্দীন আহমেদ ‘মুজিব কাকু’র মুখ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটি রেকর্ড করার জন্য সারা দিন কাকুর বাসায় অপেক্ষা করে সন্ধ্যায় ভগ্ন মনোরথ হয়ে ফিরে আসেন। তার মুজিব কাকু তার পিতাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি কি চাও পাক আর্মি এটা নিয়ে আমাকে কোর্ট মার্শালে ফাঁসি দেউক?’ তাজউদ্দীন আহমেদের অনুরোধমতো স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে ২৭ মার্চ হরতালের ঘোষণা দিয়ে সবাইকে বাসায় গিয়ে ঘুমানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। দৈনিক ইত্তেফাকও অন্যান্য পত্রিকার পুরনো সংখ্যায় শারমিন আহমদের এসব বর্ণনার সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
এমন কঠিন সময়ে একটা রেগুলার সেনাবাহিনীর সদস্য নিজের ঘাড়ে কোর্ট মার্শালের হুমকি নিয়ে সেই বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং বলিষ্ঠ কণ্ঠে নিজের নাম স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখন জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত একজন প্রধানমন্ত্রীকে ফাঁসির হুকুম দিলে পৃথিবীর অনেক বৃহৎ শক্তি প্রতিবাদ করত; কিন্তু নিজের বাহিনীর একজন বিদ্রোহী মেজরকে কোর্ট মার্শালে ফাঁসি দিলে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করত না। কাজেই কত বড় ঝুঁকি মাথায় নিয়ে তিনি এই ঘোষণা দিয়েছিলেন তা সহজেই অনুমেয়।
আবার সেই একই জিয়া জাতির জন্য উদ্ধারকারী হিসেবে আবির্ভূত হন ১৯৭৫ সালে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন পারস্পরিক কোন্দলে গণতন্ত্রকে বাকশালের খাদে ফেলে দিয়েছিল এবং তা সেই খাদ থেকে আরো বড় গর্তে পড়ে যাচ্ছিল, তখন সেখান থেকে টেনে তোলার দায়িত্বটিও চাপে তার কাঁধে। আজীবন গণতন্ত্রের পূজারী এক নেতার হাতে যখন গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটেছিল, সেখানে সচরাচর গণতন্ত্রের জম হিসেবে বিবেচিত একটি মহলের একজন কর্মকর্তার হাত দিয়ে গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের হতবাক করে দেয়। এসব কারণেই জাতীয় জীবনের সব জায়গা থেকে জিয়াকে সরানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ‘এক নেতা এক দেশ’ থিওরির সামনে তাজউদ্দীন আহমেদ, এম এ জি ওসমানী, মওলানা ভাসানী প্রমুখ হুমকি হলেও সবচেয়ে বড় হুমকিটি এসেছে জিয়ার কাছ থেকে। জীবিত জিয়ার চেয়ে মৃত জিয়া আরো শক্তিশালী হয়ে পড়েছেন। কাজেই জাতীয় সংসদ ভবন থেকে জিয়ার কবর সরানো দরকার।
তজ্জন্য নিজেদের জন্য চরম অ্যালার্জিক চাঁদ-তারা পতাকার প্রতিও বিশেষ দুর্বলতা দেখানো হচ্ছে। কারণ চাঁদ-তারা প্রতীকটি ইসলামি ভাবধারা ও জীবনবোধ তুলে ধরে। পাকিস্তান ছাড়াও আরো কয়েকটি মুসলিম দেশের জাতীয় পতাকায় এ সিম্বলটি রয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশের এয়ারপোর্ট বা মার্কেট প্লেসে চাঁদ-তারার সিম্বল দিয়ে মুসলমানদের নামাজের জায়গা নির্দেশ করা হয়।
যে সুফিয়া কামালরা এই চাঁদ-তারা পতাকা ও কায়েদে আযমকে নিয়ে একদা অনেক কবিতা লিখেছেন, অনেক আবেগের ঘনঘটা সৃষ্টি করেছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে তারাই এটাকে ঠাট্টা-মশকারার বিষয়ে পরিণত করেন। যে ব্যক্তিরা গণপাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করে পাকিস্তানের শত্রুকে ধ্বংস করতে মারাত্মক রিপোর্ট করেছিলেন, তারাই আবার পরবর্তী প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় ভারতপ্রেমিক সেজে যান। পাকিস্তানকে ঠাট্টা-মশকারা করতে গিয়ে অনেক সময়ে ইসলামকেই মশকারার বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে। দাড়ি-টুপি পরিহিত মানুষ হয়ে পড়ে এদের নাটক-উপন্যাসের একমাত্র ভিলেন।
পাকিস্তানের ভাবধারা অপসারণের নামে জাতীয় জীবনের সব জায়গা থেকে সব ইসলামিক সিম্বল এবং মুসলিম পরিভাষা সরিয়ে ফেলার ধুম পড়ে গিয়েছিল। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে মুসলিম শব্দটি খসে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে কুরআনের আয়াত সরিয়ে প্রদীপ বসানো হয়।
অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে একটি গ্রুপ এটাকে মক্কা বিশ্ববিদ্যালয় বলে উপহাস করেছিলেন। বিপরীতক্রমে যারা এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং নিজেদের শত শত একর জমি দান করে গেছেন, তাদের নাম আজ এখানে উচ্চারণ করা হয় না। জন্মদিন বা মৃত্যুদিবসেও তাদের স্মরণ করা হয় না। এমন হীনম্মন্যতা নিয়ে কখনো মুক্তচিন্তার ধারক হিসেবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়াতে পারে না।
এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে অত্র এলাকার মুসলমানদের জন্য সান্ত্বনা পুরস্কার। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই জন্ম-ইতিহাস আজ ভুলিয়ে দিয়ে পুরো জাতির ইতিহাসটি ক্ষমতাধরদের মনমতো লেখা হচ্ছে। যারা ইতিহাস বিকৃত করছেন, তারাই এই ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ বেশি তুলছেন।
পূর্ববঙ্গের চাষাভূষার ছেলেরা (যাদের বেশির ভাগ মুসলমান ও নি¤œ শ্রেণীর হিন্দু) শিক্ষিত হয়ে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়বেÑ এটাই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারীদের মূল ভীতি। বাস্তবে হয়েছিলও তাই। কলকাতার এলিট বর্ণবাদী ও জমিদার শ্রেণীর হাত থেকে বাঁচতে এ দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ওই ভূখণ্ডের মানুষকে রাজনৈতিক এ সচেতনতা দান করেছিল নিঃসন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর গ্র্যাজুয়েটরাই আবার পরে মাতৃভাষার আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায় এবং এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা বা স্বাধিকারের আন্দোলন শুরু হয় বাংলাদেশে। ফলে ১৯৪৭ সালে রাজনৈতিক অপারেশনে আলাদা করা ভূখণ্ডটিই ১৯৭১ সালে দ্বিতীয় অপারেশনের (রাজনৈতিক+সামরিক) মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়। ১৯৪৭ সালে এভাবে বৃহত্তর ভারত থেকে আলাদা না হলে এই ভূখণ্ড কাশ্মিরের চেয়েও নাজুক অবস্থায় পড়ে যেত। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দিয়ে যারা দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করতে চান, তারা একধরনের মৌলিক ভুল করে বসেন। দ্বিজাতিতত্ত্বের ত্রুটি একজাতিতত্ত্বের সঠিকত্ব প্রমাণ করে না, বরং ত্রিজাতি বা বহুজাতিতত্ত্বের ধারণাকে সামনে টেনে আনে। একজাতিতত্ত্ব ভুল ছিল, দ্বিজাতিতত্ত্বও ত্রুটিপূর্ণ ছিল। সঠিক হলো ত্রি বা বহুজাতিতত্ত্ব। দ্বিতীয় সংশোধনী কখনোই প্রথম সংশোধনীকে অস্বীকার করে না, বরং এর ঐতিহাসিক বাস্তবতা স্বীকার করে নেয়।
দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর এক শ্রেণীর ইতিহাসবিদের আবির্ভাব হয়। এদের ইতিহাস শুরু হয় ১৯৪৭ সালের পর থেকে। এদের ইতিহাসে দীর্ঘ মুসলিম শাসন নেই, ১৭৫৭ সাল নেই, হাজী শরীয়তুল্লাহদের আন্দোলন নেই, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা নেই, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ নেই, ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ নেই, ত্রিশ বা চল্লিশের দশকজুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি নেই, যার মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশের উদ্ভব হয়েছে। এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক মানসটিও হাজার বছরের সৃষ্টি।
এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের মনে অনুরণিত এ কথাগুলো উচ্চারণ করা যেত না। একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লাঠিয়ালপনার মাধ্যমে সব মুক্ত গবেষণার দুয়ার বন্ধ রাখা হয়। এ অবস্থায় দেশের মানুষের মনে এসব কথা বলার সাহস জুগিয়ে গেছেন স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। এ দেশের মানুষের প্রতিটি নিঃশ্বাস থেকেই জিয়ার জন্য দোয়াটি বের হয়ে পড়ে। হয়তো এ কারণেই জিয়ার প্রতি কারো কারো বিদ্বেষ এত তীব্র।
তিনি যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণা পেশ করে গেছেন, তা এই ত্রিজাতিতত্ত্বের দার্শনিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, যা আমাদের কোনো খণ্ডিত ইতিহাস নয়, বরং সামগ্রিক ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টি ফেরাতে উৎসাহিত করে।
আধিপত্যবাদী শক্তি এবং তাদের দোসরদের চক্ষুশূল হয়ে পড়েছে শহীদ জিয়ার রেখে যাওয়া আদর্শ, তার কবর ও তার পরিবার। মনে হচ্ছে এই তিনটির একটি কোনো মতে টিকে থাকলে এই দেশকে সিকিম বা কাশ্মির বানানো কঠিন হবে। ‘নিজেদের আন্দোলনের ফসল’ জরুরি সরকারের দুই বছর এবং পরে আরো আট বছরে এই দল ও পরিবারটির ওপর নির্যাতন চালিয়েও নির্মূল করা যাচ্ছে না। দলটির সাংগঠনিক ভিত্তি ঐতিহাসিকভাবে নড়বড়ে থাকলেও যেকোনো সময় এ দল ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম। এটিই বৈরী শক্তির ভীতির মূল কারণ।
প্রতিপক্ষ জিয়াকে মানুষের মন থেকে যতই সরাতে চাচ্ছে, ততই তিনি জনগণের মনের কুঠরিতে আরো জায়গা করে নিচ্ছেন। অতি চালাকের গলায় দড়ি। সেই দড়িটিও বোধহয় এই অতি চালাকেরা নিজেদের অজান্তেই তৈরি করে ফেলছে ।