লন্ডনি ওহি এবং কোমরভাঙা বিএনপি-আতঙ্ক

Daily Nayadiganta


বাংলাদেশের কথানির্ভর রাজনীতির ময়দান করোনার কবলে পড়ে বেশ কিছু দিন বিরান অবস্থায় ছিল। অর্থাৎ রাজনীতির স্বাভাবিক ধারা বজায় থাকলে যেভাবে রাজনীতির ময়দান সরগরম থাকে ঠিক তেমনটি দেশে হচ্ছে না বলতে গেলে প্রায় এক দশক হয়ে গেল। মিছিল-মিটিং-হরতাল, প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সরকার অচল করে দেয়ার পুরনো রীতি এখন রীতিমতো ইতিহাস। কোনো রাজনৈতিক দল যদি ওসব বলে ভয় দেখাতে চায় তবে লোকজন হেসে গড়াগড়ি খাবে এই বলে যে, অতীতের ওসব গল্পের বাস্তব রূপ কেবল সিনেমা নাটক কিংবা রঙ্গমঞ্চেই সম্ভব- রাজপথ কিংবা বিস্তীর্ণ জনপদে সম্ভব নয়। কবিতার ভাষায় রাজনীতি, নাটকের মতো করে আন্দোলন এবং সিনেমার মতো করে ভাষণ দিয়ে যে রাজপথে দাবি আদায়ের সংগ্রাম গড়ে ওঠে না তা ইদানীংকালের নবজাতকরাও বেশ ভালোভাবে বুঝে গেছে।

উল্লিখিত অবস্থার কারণে হাল আমলে আমরা কথানির্ভর রাজনীতির ধারক-বাহক, গ্রাহক এবং দর্শকে পরিণত হয়ে পড়েছি। জনগণকে সাত্ত্বনা দেয়ার জন্য আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো বড় বড় লেখকদের বড় বড় পদে বসিয়ে অদ্ভুত এবং বর্ণালী সব বর্ণমালায় রচিত মুখরোচক শব্দমালার রসমঞ্জুরী বানিয়ে রাজনীতির ডালা সাজিয়ে রাজনীতির ময়দানে আবাদ করে চলেছে। ফলে সাধারণ জনগণ সেই রসমঞ্জুরীর গদ্য কথা না শুনলে যেমন দিবসের প্রাতঃকর্ম শুরু করতে পারে না- তেমনি ওগুলো ছাড়া ঘুমাতে গেলে সারা রাত দুঃস্বপ্নের কবলে পড়ে অশান্তিতে মরণাপন্ন হয়ে পড়ে। ফলে সরকারি ও বিরোধী দলের জন্য কতিপয় কথক এবং তাদের রম্যকথার রসমঞ্জুরী এখন পুরো জাতির জীবন-জীবিকার টনিকে পরিণত হয়েছে।

করোনা যখন দুনিয়াকে আক্রমণ করল তখন আমাদের জীবন রক্ষাকারী রাজনৈতিক রসমঞ্জুরীর ফুলঝুরির প্রবল ঢেউয়ে তাড়িত হয়ে আমরা নিশ্চিত হলাম যে, সৌরজগতের সব জায়গায় করোনা অবাধে বিস্তার লাভ করতে পারলেও বাংলাদেশে ঢুকতে পারবে না। কারণ আমাদের রাজনীতির সাধু সন্ন্যাসীদের যোগাসনের বস্ত্র এবং রুদ্রাক্ষের মাল্যর সুতীব্র অলৌকিক ক্ষমতার কারণে করোনা সীমান্ত বরাবর এসেই উল্টো ভোঁ দৌড় দিয়ে ভারত ও মিয়ানমারে গিয়ে প্রলয় ঘটাবে। কিন্তু বাস্তবে যখন একের পর এক উল্টো ঘটনা ঘটতে থাকল তখন কথকদের কয়েকজনের কণ্ঠে যেন বাজ পড়ল। কিছু দিনের জন্য তাদের রসমঞ্জুরীর অভাবে করোনার আতঙ্ক-বেদনা এবং বিপর্যয় বহু গুণে বেড়ে গেল।

জাতির উপরোক্ত ব্যথা বেদনা দূর করার জন্য কথকবৃন্দ তাদের কথামালার পসরা নিয়ে আবার রাজনীতির ময়দানে উষ্ণতা ফেরানোর চেষ্টা করছেন। কেউ হয়তো বলার চেষ্টা করছেন-হুয়্যা! অন্যরা সমসুরে উত্তেজিত অবস্থায় বলে উঠছেন, কিয়্যা হুয়্যা! কাইস্যে হুয়্যা! কাহা হুয়্যা-কৌনসে হুয়্যা-কি ধারসে হুয়া! কব হুয়্যা ইত্যাদি। সাধারণ জনগণ কথকদের ইত্যাকার হুয়্যা ধ্বনি শুনে করোনার বেদনা ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে বাঁচার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য যখন আয়োজন শুরু করেছে তখন শিরোনামের বিষয়টি রাজনীতির ময়দানে নতুন একটি ইস্যু তৈরি করে ফেলেছে।

দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নিয়ে প্রতিপক্ষের ঘুম হারাম হয়ে পড়েছে। এর কারণ হলো, বিএনপিকে নিয়ে পাবলিকের কান গরম করার মতো কোনো কথামালার রসমঞ্জুরী বহু দিন থেকে রচনা করা যাচ্ছিল না। রবীন্দ্রনাথের জুতা আবিষ্কার কবিতার মতো করে পিপের পর পিপে নস্যি নাকের অভ্যন্তরে রফতানি করেও বিএনপি ঘায়েলের রসমঞ্জুরীর দুই-চারটে শব্দমালা আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়ে কথকদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহত্যার কথা ভাবছিলেন। কারণ ওসব রচনা করতে না পারলে তাদের মালিক তাদের যেসব পারিতোষিক খানা-পিনা ও আদর-আপ্যায়ন দিয়ে যাচ্ছিলেন তা হয়তো বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং সেটি যদি সত্যি সত্যিই ঘটে যায় তবে বেইজ্জতি-দুর্ভোগ-দুর্গতির কোনো সীমা-পরিসীমা থাকবে না। পরিস্থিতি যখন এমনতর জটিল হতে চলছিল ঠিক তখনই কোত্থেকে যেন শিরোনামের কথামালাগুলো কারো মাথায় চলে এলো এবং তিনি তা প্রসব করে রাজনীতির ময়দানে ছেড়ে দিলেন অব্যর্থ জীবনরক্ষাকারী টনিকরূপে।

শিরোনামে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তার যদি আমরা ভাব সম্প্র্রসারণ করি তবে দুটো অংশ দেখতে পাবো। প্রথমটি হলো, লন্ডনি ওহি এবং দ্বিতীয়টি হলো কোমর ভাঙা বিএনপি। আমি আমার সাধ্যমতো আজকের বিষয়ের ওপর আলোকপাত করব এবং আশা করছি- আপনাদের ভালো লাগবে। তবে এ ব্যাপারে সম্মানিত পাঠকবৃন্দের প্রতি একটি সনির্বন্ধ অনুরোধ- আপনারা আলোচনার গভীরে ঢোকার আগে সম্ভব হলে নাউজুবিল্লাহ পড়ে নেবেন। এর কারণ হলো, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে গিয়ে আমরা কিভাবে শিরকের মতো মহাপাপ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ি তা আজকের আলোচনার শিরোনামের প্রথম অংশ অর্থাৎ লন্ডনি ওহির ব্যাখ্যা শুনলেই বুঝতে পারবেন।

যারা লন্ডনি ওহি শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন তারা বুঝাতে চেয়েছেন যে, লন্ডনে বসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, তার দলের নেতাকর্মীদের নানামুখী আদেশ-নিষেধ, নির্দেশনা-পরামর্শ অথবা প্রস্তাবনা দিয়ে থাকেন। টেলিফোন-ই-মেইল ছাড়াও আধুনিক প্রযুক্তির হোয়াটস অ্যাপ-গ্রুপ চ্যাট, স্কাইপে, হামা-জুম ইত্যাদির মাধ্যমে জনাব তারেক রহমান প্রতিনিয়ত লন্ডন থেকে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং তদারক করছেন যা কিনা ভাষ্যকারদের মতে সঠিক নয়। তাদের মতে লডনে বসে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে সহস্র যোজন দূরের বাংলাদেশে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের প্রথাগত রাজনীতির ময়দানে সফল হওয়ার জন্য সশরীরে ময়দানে উপস্থিত থেকে রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই। তো কাজেই প্রবাসে থাকা তারেক রহমানের প্রযুক্তিনির্ভর রাজনীতিই বিএনপিকে শেষ করে দিচ্ছে বলে অভিযোগকারীরা মনে করেন।

তারেক রহমান সম্পর্কে উপরোক্ত সাদামাটা অভিযোগকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন এবং রসযোগ্য করার মানসে কথকবৃন্দ লন্ডনি ওহি শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় বিবেক বিবেচনাবোধ এবং বিচারশক্তির ওপর ক্রমাগত বলাৎকার ঘটায় আমরা এখন অনেক কিছুই বুুঝতে পারি না। ফলে ফ্রান্সের বিষয়াদি ফিলিস্তিনের ঘটনাপঞ্জি অথবা আটলান্টিকের ওপর প্রান্তের আমেরিকার যুদ্ধনীতি আমাদের যতটা উত্তেজিত করে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজ দেশের অনেক কিছু ক্রমাগত নিস্তেজ করে তোলে। তা না হলে লন্ডনি ওহি শব্দ নিয়ে কেন আমরা আজ অবধি একটি টুঁ শব্দটি করতে পারলাম না।

লন্ডনি ওহি শব্দের মধ্যে প্রতিবাদের কী কী উপকরণ রয়েছে এবং এই শব্দটির দ্বারা ক্ষমতাধর বাকপুট কথকবৃন্দ কত বড় কবিরা গুনাহ করেছেন তা যদি আপনি অনুধাবন করতে চান তবে ওহি শব্দের অর্থ এবং ব্যাখ্যা বিবৃতি ও বৈশিষ্ট্য জানা আবশ্যক। ওহি শব্দটি একটি মৌলিক আরবি শব্দ এবং ইসলামী পরিভাষা। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে যখন তাঁর কোনো নবী কিংবা রাসূলের কাছে বার্তা আসে তখন তাকে ওহি বলা হয়। কোনো একটি বার্তাকে তখনই ওহি বলা হবে যখন বার্তাটির তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকবে। প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো এটি যার নিকট থেকে আসবে তিনি হলেন বিশ্ব জাহানের মালিক মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন। দ্বিতীয়ত, যার কাছ আসবে তিনি হবেন কোনো নবী কিংবা রাসূল এবং তৃতীয়ত যিনি বার্তাটি বহন করে আনবেন তিনি হবেন আল্লাহর মনোনীত বিশেষ বিভাময় ফেরেশতা হজরত জিবরাইল আমিন আ:।

ওহির উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যের বাইরে আরো কিছু মৌলিক পরিচয় রয়েছে। ওহি সাধারণত মানবমণ্ডলীর কল্যাণের জন্য প্রেরিত হয়। পৃথিবীর কোনো মানুষের সাধ্য নেই ওহির বিষয়বস্তু চ্যালেঞ্জ করা অথবা ওহির কার্যকারণ বা সত্যতার বিষয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করার। হজরত আদম আ:-এর জমানা থেকে হুজুরে পাক সা:-এর জমানা অবধি আল্লাহ তাঁর পছন্দের নবী ও রাসূলগণের প্রতি ওহি নাজিল করেছেন। খাতামুননাবীইন মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:-এর পবিত্র ওফাতের পর পৃথিবীতে কিয়ামত পর্যন্ত ওহি পাঠানো বন্ধ। অর্থাৎ হুজুর সা:-এর পর যেমন আর কোনো নবী পৃথিবীতে আসবেন না; তদ্রূপ মানবমণ্ডলীর জন্য আর কোনো ওহিও নাজিল হবে না। শেষ ঘটনায় হজরত ঈসা আ:কে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হবে কেবলমাত্র সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে সাক্ষ্যদানের জন্য এবং তিনি কী কী বিষয়ে সাক্ষ্য দেবেন। সেসব সাক্ষ্যের বাক্যগুলো ওহি আকারে শেষ নবীর কাছে প্রেরিত হয়েছে এবং আল কুরআনে বর্ণিত রয়েছে। সুতরাং হজরত ঈসা আ:-এর নিকট নতুন কোনো ওহি নাজিল হবে না।

ওহি সম্পর্কে ইসলাম ধর্মের মৌলিক নীতিমালা পৃথিবীর তাবৎ ঐশী ধর্মগুলো সমর্থন করে। অন্য দিকে মুসলমান নামধারী কোনো লোক যদি ওহি নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে এবং রঙ্গরসের কথাবার্তা বলে তবে তার পরিণতি কী হবে তা আমার চেয়ে বিজ্ঞ আলেমবৃন্দ ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু সেসব লোক অর্থাৎ ইসলাম ধর্মে যাদের ওলামা হিসেবে সম্মান এবং মর্যাদা দিয়েছে তারা কেন ওহি শব্দের অমর্যাদা নিয়ে কথা বলছেন না তা আমার বোধগম্য না হলেও সম্মানিত পাঠক ইতোমধ্যে বুঝতে পেরেছেন যে বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তারেক রহমান এবং বিএনপিকে নাজেহাল করার জন্য আসমান এবং জমিনের কোনো জায়গাতে ব্যঙ্গাত্মক তীর ঢুকিয়ে মানুষের ঈমান একিনের রক্তপাত জমিয়েছেন।

আলোচনার এই পর্যায়ে এবার কোমর ভাঙা বিএনপি সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলে নিবন্ধের ইতি টানব। কথকবৃন্দ কথায় কথায় বলে বেড়ান যে, বিএনপির কোমর ভেঙে গেছে। তারা আরো বলার চেষ্টা করেন যে, নেতৃত্বসঙ্কট, রাজনৈতিক অপরিপক্বতা, দল পরিচালনায় দুর্নীতি, মনোনয়ন বাণিজ্য এবং অযোগ্য লোকদেরকে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম করানোর লন্ডনি কৌশলের কারণেই বিএনপির কোমর ভেঙে গেছে। তাদের মতে, কোমরভাঙা বিএনপি দ্বারা আর রাজনীতি সম্ভব নয়। ফলে বাংলাদেশে বিএনপির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কথকদের এসব বক্তব্যের মাধ্যমে তারা আসলে কী বোঝাতে চান তা আমার বোধগম্য নয়। কারণ বিএনপির যদি কোমর ভেঙেই গিয়ে থাকে তবে সেই বেদনায় তো বিএনপির আর্তনাদ করা উচিত কিন্তু সেটি না হয়ে যদি উল্টোটা হয় অর্থাৎ বিএনপির প্রতিপক্ষ যদি অতি চিৎকার করে তবে ধরে নেয়া যায় যে, বিএনপি-আতঙ্কে তাদের জীবন যৌবন, সমাজ এবং ভবিষ্যৎ বরবাদ হতে চলেছে।

বিএনপির কোমর ভাঙা বলতে দলটির বিরোধী পক্ষ যা বলার চেষ্টা করছে তা হলো বিএনপিকে আহত ও রক্তাক্ত করা হয়েছে, জুলুম ও নির্যাতন করে তাদের ঘরে বন্দী অথবা কারাবাসে পাঠানো হয়েছে। তাদের সম্পদহানি ঘটিয়ে তাদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক পয়দা করা হয়েছে। তাদের বন্ধুহীন করার যাবতীয় অপতৎপরতা চালানো হয়েছে। সুতরাং দলটির পক্ষে আগামী দিনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো সম্ভব হবে না। কথকেরা নানান মিথ্যার ফুলঝুরি দিয়ে কথামালার রসমঞ্জরীর ডালা রাজনীতির ময়দানে পরিবেশন করার পরও স্বস্তি পাচ্ছে না।

কারণ তারা জানে যে, তারা অন্যায়ভাবে বিএনপির ভুল জায়গায় আক্রমণ চালিয়ে বিএনপিকে আহত বাঘের মতো দুর্দান্ত ও প্রতিশোধপরায়ণ বানিয়ে ফেলেছে। ফলে অনাগত দিনে কথকদের পরিণতি কী হতে পারে তারা তা জিম করবেট নামক বিখ্যাত বাঘ শিকারির বই পড়ে জেনে গেছেন এবং সে কারণেই কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে আল্লাহ রাসূল আসমান জমিন এবং রাজনীতির মিথ্যাচারের পার্থক্য নির্ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। নাউজুবিল্লাহ!