রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আর কত দূর

  • মো: আতিকুর রহমান
  •  ০২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৯:২৫
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আর কত দূর – ছবি : সংগৃহীত

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সৃষ্ট বিশাল এক মানবিক সঙ্কট প্রত্যক্ষ করে আন্তর্জাতিক বিশ্ব। সহিংস হামলার শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসে, যাদের গ্রামগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয়। এটি সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রবেশ করা মানুষের নজিরবিহীন এক ঢলের সূচনা করেছিল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের খোঁজে ৭ লাখেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করে। স্থানীয় বাংলাদেশী কমিউনিটির উদার সমর্থন এবং বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে বহুজাতিক সহায়তা প্রচেষ্টার কারণে একটি মারাত্মক মানবিক সঙ্কট এড়ানো সম্ভব হয়েছিল।

গত ২৫ আগস্ট, রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস পালিত হলো। শরণার্থী জীবনের পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পের খোলা মাঠে সমাবেশ করে। সমাবেশে গণহত্যা দিবসে স্বদেশে ফেরার আকুতি জানিয়ে মুনাজাত করে রোহিঙ্গারা। এতে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুরা উপস্থিত ছিল। সেই সমাবেশে শিশুদের হাতে হাতে নিজ দেশ মিয়ানমারের পতাকা দেখা গেছে। ফেস্টুনে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, উই ওয়ান্ট টু ব্যাক হোম’ লেখা ছিল। রোহিঙ্গা শিশুরা জানায়, তারা নিজের দেশে ফিরে যেতে চায়, সেখানে খেলতে চায়, পড়তে চায়। তারা সম্মান ও মর্যাদার সাথে নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরতে চায়। রোহিঙ্গারা এ দেশের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত। রোহিঙ্গারা নিজ দেশে গিয়ে পড়াশোনা করতে চায়। তাদের এই চাওয়ার বিপরীতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কতদূর?

দুঃখজনক হলেও সত্য, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এক প্রকার থমকেই গেছে বলা চলে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চায় না। এমন এক পরিস্থিতিতে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বহির্বিশ্বকে সাথে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর জোরালোভাবে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এটাই সবেচেয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

দিন যতই যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা বাড়ছে। অনৈতিক কর্মকাণ্ড, সন্ত্রাস, মাদকের ভয়াবহ গ্রাসে এক ধরনের চরম অস্থিরতা চলছে রোহিঙ্গা শিবির এলাকায়। এমন এক বাস্তবতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দাবি জানাতে হবে তারা যেন রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। সাধারণ রোহিঙ্গারা বলছে, ক্যাম্পে কিছু সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ তাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করছে। রোহিঙ্গারা তাদের ওপর নির্যাতনের বিচার ও নিজ দেশে মর্যাদার সাথে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছে, যা ইতিবাচক বলে মনে করি।

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। সরকার দাবি করছে, তারা প্রত্যাবাসন শুরু করতে সহায়ক মাধ্যমগুলোতেও প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে, গত পাঁচ বছরে মিয়ানমার সরকারের তরফ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া অর্জন করতে পারেনি। যদিও রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতি বছর জন্ম নেয়া রোহিঙ্গা শিশুদের সংখ্যাও বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন সঙ্কট। কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের তথ্য বলছে, প্রতি বছর ক্যাম্পগুলোতে ৩০ থেকে ৩৩ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্মগ্রহণ করছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে, যা সার্বিক জনসংখ্যার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এদের মধ্যে প্রায় এক লাখ ২০ থেকে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা সদস্য রয়েছে, যারা বাংলাদেশে এসে পৃথিবীর আলো দেখেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রত্যাবাসনের পাশাপাশি বাংলাদেশকে নজর রাখতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের পরিবার পরিকল্পনার দিকেও।

ইউএনএইচসিআরের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭২ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৩ জন। এ জনসংখ্যার মধ্যে এক লাখ ৯৬ হাজার ১২১টি পরিবার রয়েছে। এদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা ৫২ শতাংশ। আর পুরুষের সংখ্যা ৪৮ শতাংশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গারা বর্তমানে রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে প্রচারণা বা কাজ চলমান থাকলেও রোহিঙ্গাদের যে জীবনমান তাতে তাদের দিয়ে সহজে এ কাজে ফল পাওয়া যাবে না বলে মনে করি। এটি অনেক দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। যেমন উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের কথাই বলা যেতে পারে। বাংলাদেশে জন্ম নিয়ন্ত্রণে আজকের যে অবস্থান সেটি করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। যদিও শুরুতে পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে রোহিঙ্গাদের খুব নেতিবাচক ধারণা ছিল। নেতিবাচক আচরণ ছিল কিন্তু দৃশ্যমান বাস্তবতায় বলতে হয়, এখন তা নেই বললেই চলে।

যদিও বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা থেকে প্রত্যাশিত সহায়তা না আসায় রোহিঙ্গাদের তহবিলে টান পড়েছে। চলতি বছর বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য ৮৮১ মিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনের পদক্ষেপ নিয়েছিল জাতিসঙ্ঘ। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই তহবিলে জমা পড়েছে মাত্র ৪২৬ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার, শতকরা হিসাবে যা জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবিত অর্থের মাত্র ৪৯ শতাংশ।

এমন এক পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান নিরাপত্তা ও অধিকারসহ তাদের নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে দেয়া। কিন্তু গত তিন বছরে আলাপ-আলোচনা, চুক্তি সই, তালিকা বিনিময় ইত্যাদির ফলে এ ক্ষেত্রে সামান্যতমও কোনো অগ্রগতি হয়নি।

যদিও গত বছরে দু’টি ইতিবাচক কাজ হয়েছে এ ক্ষেত্রে, তা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধে জড়িত মিয়ানমারের ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা এবং জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলা। তবে আইনি প্রক্রিয়া একটি দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এমনকি মিয়ানমার যদি গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ও, সাথে সাথে বিতাড়িত রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফেরত যেতে পারবে, বিষয়টি তেমন সরল নয় বলে মনে করি।

এক্ষেত্রে আমাদের দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়াটি চালু রাখতে হবে, যাতে বাংলাদেশ সহযোগিতা করছে না- এ মিথ্যা অভিযোগের সপক্ষে মিয়ানমার কোনো রসদ না পায়। কোভিড মহামারীতে থমকে যাওয়া দ্বিপক্ষীয় আলোচনা আবার কিভাবে শুরু করা যায়, তা সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখা দরকার। এক্ষেত্রে দুই-পাঁচ শ’ পরিবারের টোকেন প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি অবশ্যই এড়িয়ে যেতে হবে। যেহেতু রোহিঙ্গারা নিজ ভূমিতে ফেরত যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছে, তাদের এই বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। এক্ষেত্রে যাদের ফেরতের তালিকায় রাখা হবে তারা স্বেচ্ছায় যেতে চাইবে না। কারণ, তারা জানে সেখানে তাদের জন্য কোনো নিরাপদ পুনর্বাসন অপেক্ষা করছে না। তাই মূল বিষয় হবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাপ সৃষ্টি করা, যাতে সব শরণার্থী নিরাপত্তার সাথে ফেরত যেতে পারে। সেই কাজে মিয়ানমার সরকার বা সেনাবাহিনীকে বাধ্য করা জরুরি।

কূটনৈতিক পর্যায়ে আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে মহামারী ও মহামারী-উত্তর অর্থনৈতিক সঙ্কটে বিপর্যস্ত পৃথিবী যেন রোহিঙ্গাদের ভুলে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে আমাদের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গাদের দুরবস্থা ও তাদের ওপর সংঘটিত নির্যাতনের প্রতিকারের বিষয়টিকে স্মরণ করিয়ে দেয়াটা জরুরি বলে মনে করি।

সর্বশেষে সমস্যা সমাধানে দীর্ঘসূত্রতায় আশাহত হলে চলবে না। আমাদের মেনে নিতে হবে যে, এ সঙ্কট নিরসনে ১০, ১৫ বা ২০ বছর লেগে যেতে পারে আর সে জন্য মানসিক এবং বাস্তব প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের। আমাদের দেখতে হবে যে শরণার্থীরা যেন একটি সহনীয় জীবন যাপন করতে পারে, সেই সাথে এই এলাকার স্থানীয় মানুষের সমস্যা সমাধানে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে তাদের মধ্যে ইতোমধ্যে সৃষ্ট অসন্তোষ ও বিরূপ মনোভাব নিরসন করা যায়।

আমরা দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। আমরা চাই না বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইসরাইলে পরিণত হোক। আমরা চাই দ্রুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সংশ্লিষ্টদের দৃশ্যমান উদ্যোগ। আর এই সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ থেকে শুরু করে সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য আমাদের প্রস্তুতি থাকতে হবে এবং আমাদের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় দেশকে সম্ভাব্য সঙ্কটের হাত থেকে রায় সংশ্লিষ্টদের অধিক সদিচ্ছা জরুরি।

লেখক : কলামিস্ট ও সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি