রেকর্ড টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিলো বাংলাদেশ ব্যাংক, ৫০ বছরে সর্বোচ্চ

রেকর্ড টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিলো বাংলাদেশ ব্যাংক, ৫০ বছরে সর্বোচ্চ

ছবি: সংগৃহীত

চলতি অর্থবছরের শুরুতেই রেকর্ড পরিমাণ টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে বাজেট ঘাটতি মেটাতে বড় রেকর্ড গড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রকারান্তরে যা মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেবে।

এর আগে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে বেশি টাকা ধার করতো সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও করতো। তবে সেই পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম। কিন্তু এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকের সেই সক্ষমতা খুব বেশি নেই। তাই টাকা ছাপিয়ে সরাসরি সরকারকে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১৮ দিনেই ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা দিয়েছে তারা।

অথচ গত অর্থবছরের পুরো সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা ধার করেছিল সরকার। সেখান থেকে ঋণ নেয়া মানেই নতুন করে ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়া হচ্ছে। পরবর্তীতে এ টাকার পরিমাণ ৫ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এ নতুন টাকা সরবরাহের বিপরীতে চাহিদা তৈরি হবে। দ্রব্যমূল্য যা বাড়িয়ে দেবে।

আরও পড়ুন: স্বর্ণ কেনার সেরা সময় এখনই

ইতোমধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করেছে সরকার। সেখানে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। সেটা পূরণে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি ব্যাংক খাত থেকে নেয়ার পরিকল্পনা করেছে তারা।
অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা, এ ঘাটতি পূরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা ধার করতে হবে সরকারকে। কারণ, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার মতো সামর্থ্য খুব একটা নেই।

পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এ বছর টাকা ছাপানোর দরকারও বেশি হবে। তাই অবস্থাও বেশি খারাপ হবে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আলোচ্য অর্থবছরের মনিটরি টার্গেট ঠিক রেখেই সরকারকে সাপোর্ট দিচ্ছে তারা। ফলে বাজারে কোনো ধরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, প্রথমত; আমরা অনেক ডলার বিক্রি করছি। তাতে বাজার থেকে টাকা উঠে আসে। সেটা আবার বাজারে দিতে হয়। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় বেশিরভাগ পণ্যই উচ্চ দামে সরকারকে আনতে হচ্ছে। সেখানে সাপোর্ট দিতেই হবে।

তবে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দেয়ার প্রভাব এখন না হলেও ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষের ওপরই পড়বে। সেটা মূল্যস্ফীতি অর্থাৎ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যেই ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে।

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী অনেক দেশে গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি কমে এলেও বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া শ্রীলংকাও খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে পেরেছে। তবে এদেশ পারেনি।

এ অবস্থায় রেকর্ড পরিমাণ নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিলে প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক হওয়াটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তার মতে, এবার অর্থবছরের শুরুতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ যে পরিমাণ টাকা নিয়েছে, সেটি গত ৫০ বছরে মোট মিলিয়েও নেয়নি সরকার।

অবশ্য এভাবে নতুন টাকা ছাপিয়ে নেয়ার মাধ্যমে সরকার দুইভাবে সহায়তা পাবে। একটি হলো ঘাটতি মোকাবিলায় কম সুদের ঋণ। আবার সরকারকে ধার দিয়ে যে সুদ বা লাভ কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাবে, সেটি ফের প্রফিট হিসেবে সরকারকেই দেবে।

তিনি বলেন, সরকার সবচেয়ে সহজ পন্থা বেছে নিয়েছে। কারণ এবার রাজস্ব ঘাটতি অনেক বেড়েছে। কিন্তু তারল্য সংকটের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারকে যথেষ্ট সহায়তার দেয়ার সক্ষমতা নেই। এছাড়া সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে সরকার টাকা ধার করলে সেখানে তারল্য সংকট তৈরি হবে। ফলে বেসরকারি খাত প্রত্যাশা অনুযায়ী ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সংকটে পড়তে পারে। অর্থনীতিতে যা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে।

এসব বিবেচনাতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করার সহজ পথ বেছে নিয়েছে সরকার। এ অবস্থা তৈরি হয়েছে মূলত টাকা পাচার, ব্যাংকের অর্থ লুটপাট ও দুর্নীতিসহ নানা কারণে ব্যাংক খাত দুর্বল হয়ে পড়ায়।
তাছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা ব্যাংক থেকে এভাবে ঋণ নেয়াটা কমাতে হলে সরকারকে রাজস্ব খরচ অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু নির্বাচনের বছরে সেটিই বা কতটা সম্ভব হবে – তাও হবে দেখার বিষয়।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের শেষ নাগাদ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, জনতুষ্টির নানা প্রকল্পে বিপুল অর্থ ব্যয় করবে সরকার। যদিও এভাবে টাকা ছাপিয়ে বাজারে দেয়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে সেটি প্রকারান্তরে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে মানুষের জীবনকেই আরও দুর্বিষহ করে তুলবে।

মূলত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার বিশ্লেষণ করে কিছু সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন টাকা ছাপানোর কাজ করে থাকে। যদিও এমন কোনো বিধিনিষেধ বা ধরাবাঁধা নিয়ম নেই যে, এত টাকা ছাপানো যাবে বা এর বাইরে ছাপানো যাবে না।

তবে পুরো বিষয়টি নির্ভর করে দেশের অর্থনীতির ওপর। বাজারে অর্থের প্রবাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দ্রব্যমূল্য বাড়তে পারে। মানুষের জীবনযাত্রার খরচ যা বাড়িয়ে দেয়। যে কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপানোর ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্যের নীতি অনুসরণ করে থাকে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা