- সৈয়দ সামসুজ্জামান নীপু
- ২৮ মে ২০২১
রেকর্ড অঙ্কের ঘাটতি নিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যা কি না জিডিপির ১৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।
আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি অংশ হিসেবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। টাকার অঙ্কের ঘাটতির অঙ্ক দুই লাখ ১৪ হাজার ২৭২ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১২.৭৭ শতাংশ বেশি। আর আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সম্ভাব্য জিডিপি আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। নিকট অতীতে এর আগে আর কখনো বাজেটে ঘাটতি ৬ দশমিক ২ শতাংশ হয়নি বলে জানা গেছে। মূলত আয়ের সাথে ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতার কারণে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী ৩ জুন জাতীয় সংসদে এই বাজেট প্রস্তাবটি পেশ করতে যাচ্ছেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুস্তফা কামালের এটি হবে তৃতীয় বাজেট। এ দিন বাজেট বক্তৃতাসহ মোট পাঁচটি পুস্তিকা সংসদে দেয়া হবে। এর মধ্যে সম্পূরক বাজেট, আর্থিক বিবৃতি, মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি অন্যতম। তবে গতবারের মতো এবারো অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২১ বাজেট উপস্থাপনের দিন দেয়া হবে না। এটি তৈরি করতে আর কমপক্ষে দুই মাস সময় লাগবে বলে জানা গেছে।
এ দিকে আগামী অর্থবছরে মোট রাজস্বপ্রাপ্তি ধরা হয়েছে তিন লাখ ৮৯ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরের মূল বাজেটের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১.৮৪ শতাংশ বেশি। মোট রাজস্বের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকেই আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৩০ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। যা চলতির অর্থবছরের মূল বরাদ্দের চেয়ে ৯.৮৩ শতাংশ বেশি।
নতুন বাজেটের ঘাটতি পূরণের জন্য এক লাখ ৩৭ হাজার ২৯৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা অভ্যন্তরীণ খাত থেকে নেয়া হবে। বাকি ৮৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা বিদেশী সহায়তা নেয়া হবে। আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংকব্যবস্থা থেকেই ঋণ নেয়া হবে ৯৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এ খাতে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য রয়েছে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এর বাইরে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে যা বাড়িয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়।
করোনার কারণে আগামী অর্থবছরে সরকারের ব্যয় আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছেÑ এই কথা মাথায় রেখে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি মেটানোর জন্য বিদেশী সহায়তা প্রাপ্তির দিকে বিশেষ মনোনিবেশ করা হয়েছে। সরকার আশা করছে, আগামী অর্থবছরে বিদেশী ঋণ ও অনুদান সহায়তা বাবদ মোট এক লাখ ১৪ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে। এর মধ্যে ১৫ হাজার কোটি পূর্বে নেয়া ঋণের সুদ পরিশোধেই ব্যয় হিসেবে চলে যাবে। ফলে নিট সহায়তা পাওয়া যাবে মোট এক লাখ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে বাজেট সহায়তা হিসেবে পাওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে ২০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এই সহায়তা বাবদ প্রাপ্তি ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে ঋণ হিসেবে আসবে আরো ৮০ হাজার কোটি টাকা। এই বিদেশী সহায়তার ওপর ভিত্তি করে বাজেট ঘাটতি পূরণ করা হবে। ইতিহাসে আর কখনো এত বিপুল অঙ্কের বিদেশী সহায়তা প্রাপ্তির প্রাক্কলন করা হয়নি। এ বিষয়ে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে বলে মনে করা হচ্ছে।
করোনার কারণে চলতি বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি শেষ পর্যন্ত দুই শতাংশেরও বেশি কমিয়ে দেয়া হয়েছে। গত বছরের জুন মাসে যখন চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাজেট ঘোষণা করা হয় তখন জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়া এবং দেশব্যাপী ‘কঠোর লকডাউন’ কারণে এখন মনে হচ্ছে এই প্রবৃদ্ধি কোনোভাবে অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই গতকাল এই প্রবৃদ্ধির হার কাটছাঁট করে ৬ দশমিক ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। যা কি না বাজেটে প্রক্ষেপিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে ২ দশমিক ১ শতাংশ কম।
তবে আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির আবারো একটি উচ্চাভিলাষী প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ।
এ দিকে বিগত কয়েক বছরের বাজেট ঘাটতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক লাখ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। মূল বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেটের বিপরীতে ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল তিন লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। ঘাটতি ছিল ৬৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা।