রুশ-ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে যা চলছে

  • রিন্টু আনোয়ার
  •  ২৮ মার্চ ২০২২, ২০:২৮

– ছবি : এএফপি

অধর্মের ধর্ম-কর্ম, প্রকৃত ধর্মের অন্তরায়। পৃথিবীর কোনো ধর্মই অন্যায়-অবিচার-নিষ্ঠুরতা সমর্থন করে না। প্রখ্যাত সংস্কৃতিতাত্ত্বিক মরহুম মোতাহের হোসেন চৌধুরী তার ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন- ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম। সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কালচারের উদ্দেশ্য নয়, উপায়।’ তার লেখায় জর্জ বার্নার্ড শ’র উক্তি (Beware of the man whose God is in the skies) উল্লেখ করে মোতাহের হোসেন চৌধুরী আরো লিখেছেন, ‘কেননা, তার দ্বারা যে কোনো অন্যায় ও নিষ্ঠুর কাজ হতে পারে।’

অপর দিকে, কালচার্ড লোকেরা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে অন্যায় আর নিষ্ঠুরতাকে; অন্যায় নিষ্ঠুরতাকে তো বটেই, ন্যায় নিষ্ঠুরতাকেও। কেননা, মূলত ধর্মের সার্বিক ক্ষতির খলনায়ক তারাই, যারা ধর্মকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন এবং তখনই সেটা অধর্মের রূপ নিয়েছে তাতে ব্যক্তির লাভ হলেও ধর্মের কোনো লাভ হয়নি বরং ধর্ম সেখানে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। অন্যায়ভাবে অন্যের কাছে ধর্ম সমালোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে। ধর্মকে ব্যবহার করে কিংবা ধর্মকে সামনে রেখে ক্ষমতা, যুদ্ধ, জোরজবরদস্তি, রাষ্ট্রদখল কিংবা অন্যের হক মেরে ধর্মকে কারণ হিসেবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করার হীন প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে যে ক্ষেত্রে, ঠিক সেখানেই তখন ধর্ম সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষের সংস্কৃতিকে আঘাত করে, জোর জবরদখল করে, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিয়ে তাদের বাধ্য করে, ধর্মান্তরিত করার প্রয়াসকে এবং ক্ষেত্রবিশেষ পরাজিত দেশের মানুষকে যা ইচ্ছা তাই কাজে ব্যবহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করাকে যেভাবেই আখ্যায়িত করা যাক না কেন, এমন আচরণে ধর্মের উন্নতি হয়েছে, তা বলাটা সমীচীন নয়। বরং অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতনের মাধ্যমে যেসব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের আর্তচিৎকার ওই ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, এমনকি তাতে ধর্মই অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ধর্ম খোঁজার বাতিক চলমান রুশ-ইউক্রেন সঙ্ঘাতেও লক্ষ করা যাচ্ছে। কোন দেশে কোন ধর্মাবলম্বী কমবেশি? কোন দেশ কোন ধর্মের পাশে থাকে? কোন দেশে কয়টি মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা- এ সংক্রান্ত তথ্য তালাশ কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের আরো বহু দেশে। কেবল মুসলিম নয়, অন্যান্যও। এ সংক্রান্ত বুঝমতোই অনেকের বোধ ও মতিগতি। আবার এটাই বিশ্ব-বাস্তবতা। আরো নিষ্ঠুর বাস্তবতা হচ্ছে- একাত্তরে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়া রাশিয়া আজ ইউক্রেনের সাথে যা করছে, পাকিস্তানও তাই করেছিল আমাদের সাথে। আবার যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তানে তাই করেছে। ধর্ম দেখে যুদ্ধ বিচার করা এখন এক কালচারে পরিণত হয়েছে।

বোধ না থাকার কারণে নৈতিকতা-মানবতাবাদ এখন ধর্ম-শ্রেণী দিয়ে বিচার করা হয়। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যুদ্ধ বা কোনো ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণে যেতে আমাদের সময় লাগে না। কিন্তু, ইউক্রেনে রুশ হামলার বিচারে যেতে সময় লেগেছে। শুরুতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সমালোচনার কিছুটা তেজ দেখা গেলেও পরে থিতু হয়ে যায়। ইউক্রেন একটি ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ তা জানতে কিছুটা সময় লেগেছে উচ্চশিক্ষিত ও সচেতন অনেকেরও। তাই রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে ‘মুসলিম বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা’ ভাবতে তাদের দেরি হয়েছে। এ শ্রেণীটি ইউক্রেনের ধ্বংসে এখন আর ব্যথিত নয়। তাদের খাস কথা হচ্ছে, দেশে-দেশে মুসলিমদের মেরেছো, এখন তোমরাও মরার কষ্ট বোঝো।

চার কোটি ৪৩ লাখ জনসংখ্যার দেশ ইউক্রেনে যে ইহুদি জনগোষ্ঠী মাত্র ৪৩ হাজার, দেশটিতে ১০ লাখ মুসলিমের বাস- এ তথ্য তাদের না জানলেও চলে। তাদের এটাও জানার দরকার নেই, ইউক্রেনে প্রায় ৯৭ শতাংশ জন্মসূত্রে খ্রিষ্টান। এর মধ্যে ৭২ শতাংশ ‘প্র্যাকটিসিং’। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ইহুদি হয়েও সবার কাছে জনপ্রিয়। প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন অবাধ নির্বাচনে ৭৩ শতাংশ ভোটে। ধরা যাক, ওপরের তথ্য ঠিক নয়। ইউক্রেনের সবাই ইহুদি। তাদের প্রেসিডেন্ট ফিলিস্তিনে ইসরাইলি নিপীড়নের ঘোর সমর্থক। তারপরও তার বা তার দেশের অমঙ্গল কামনা কোনো মুসলিমের কি শোভা পায়? তা কি ইসলামের শিক্ষা?

মানুষ হওয়ার আগেই ‘মুসলমান’ হয়ে যাওয়াদের কাছে এ প্রশ্ন বেমানান। তাদের কাছে এটিই ঠিক। নৈতিক-অনৈতিক অর্থহীন। তা ছাড়া এটি ধর্মযুদ্ধ নয়। আগ্রাসনটি রাশিয়ার জন্য অপরিহার্য। আবার ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়া জরুরি। ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়া মানে পুতিনের ঘাড়ে আমেরিকার নিঃশ্বাস ফেলা। পুতিন তা হতে দেবেন কোন দুঃখে? পুতিন ইউক্রেনে হামলা না করলে যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো ইউক্রেনকে ব্যবহার করে রাশিয়ার কোন দশা করত পুতিনের তা জানা। যুক্তরাষ্ট্র এর আগে ভিয়েতনাম, লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তানসহ বহু দেশে যা করেছে এখন রাশিয়া সেই পথেই। মোট কথা, যুক্তরাষ্ট্রের ফর্মুলা যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই চালাচ্ছে রাশিয়া। ওই ফর্মুলায় জিওপলিটিক্যালি ‘বলির পাঁঠা’টা হয়ে গেছে ইউক্রেন ও দেশটির সাধারণ জনগণ। এখানে ধর্ম সাবজেক্ট নয়, অবজেক্টও নয়।

এরপরও রুশ-ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে ধর্মীয় বিচার-ব্যাখ্যা চলছে। তা অশিক্ষিত, কম শিক্ষিত পর্যায়েই শুধু নয়। উচ্চ শিক্ষিত পর্যায়েও কম নয়। এ ক্ষেত্রে খুব প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি’ আফসোসটি। আবার কবি নজরুল লিখে গেছেন, ‘হিন্দু না, ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারী! বলো, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার’।

রবীন্দ্র-নজরুলের বেদনা-অনুভূতি মূলত বাঙালিকে নিয়ে। কিন্তু, যুদ্ধকে ধর্ম দিয়ে বিচারের মানসিকতা বাঙালিকে ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে ঘটে চলছে। হতে পারে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কাব্যে কোনো যুদ্ধের কিছু যায়-আসে না। যুদ্ধ আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ। সময় গেলে আরো পরিষ্কার হবে কে আসল নাটের গুরু, কে-কারা বেনিফিশিয়ারি? এরপরও মানুষের গরজ কম নয় রুশ-ইউক্রেন নিয়ে। রাশিয়া না ইউক্রেন কে শক্তিশালী- এ বিতর্কে বাংলাদেশের এক গ্রামে মারামারিতে পাঁচজন গুরুতর আহত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকার মানুষ হাজার হাজার টাকা তোফা দিয়ে হুজুর এনে রাতভর যুদ্ধের বয়ান শোনে। না জেনেও তথ্য দিতে পারেন তারা। সেই তথ্য শুনিয়ে মাতম তুলে দিতে পারেন। আবার শোনা কথায় মাতমে মত্ত হওয়ার লোকেরও অভাব নেই।

লক্ষণীয় ব্যাপার- ধর্মাশ্রয়ী কৌশলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও কম যাননি। ভিডিও বার্তায় বিশ্বের কাছে সাহায্য চাইতে গিয়ে তিনি বিশেষ আবেদনটি রেখেছেন ইহুদিদের কাছে। তাদের মধ্যে আবেগ তৈরির লক্ষ্যে কিছু ধর্মীয় ইতিহাস টেনে এনেছেন। হলোকাস্টের মেমোরিয়ালে রাশিয়ার আক্রমণের অভিযোগ করে বলেন, নাৎসি আক্রমণের সময় ওই অঞ্চলে ৩৩ হাজার ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের স্মরণ করেই ওই মেমোরিয়াল তৈরি হয়েছিল। গোটা বিশ্ব তখন জানিয়েছিল, আর কোনো দিন এমন বর্বর আক্রমণ হবে না। কিন্তু রাশিয়া হলোকাস্ট মেমোরিয়ালে আক্রমণ চালিয়ে ফের একই কাজ করল। এসব মন্তব্যের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় এই শ্রেণীটির মধ্যে চেতনা জাগানোর চেষ্টা করেছেন জেলেনস্কি।

কালের বিবর্তনের অনেক ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে। যুদ্ধ বাঁধাতে বা যুদ্ধ থেকে বাঁচতে ধর্মকে অপব্যবহারের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। তবে, এর পরিণতি ভালো হওয়ার ইতিহাস নেই। বরং যুগে যুগে অনেক স্থানে ধর্মও ‘হারিয়ে গেছে’ এর পরিণামে। কোনো কোনো ধর্মের অনুসারীরা হয়ে গেছেন কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা দেশের জনগোষ্ঠী। ধর্মের নামে অধর্ম যেমন সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, একইভাবে ধর্মের সৌন্দর্য, দর্শন, মাহাত্ম্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জেনে রাখা দরকার, অধর্মের ধর্ম-কর্ম ধর্মের বড় অন্তরায়।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট
[email protected]