চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরজুড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির আশঙ্কা, চলতি অর্থবছরেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে যেতে পারে নিম্ন পর্যায়ে। সেক্ষেত্রে সরকারকেও আমদানি নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখতে হতে পারে। চাপ থাকবে মূল্যস্ফীতিরও। এর ধারাবাহিকতায় বাধাগ্রস্ত হবে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ। সব মিলিয়ে এ অর্থবছরেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি, রফতানি ও বেসরকারি বিনিয়োগের মতো সূচকগুলোয় উন্নতির সম্ভাবনা তেমন একটা নেই। হ্রাস পেতে পারে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও।
বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে মঙ্গলবার ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এতে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের সম্ভাব্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি, রফতানি এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়।
দীর্ঘদিন ধরেই দেশের অর্থনীতিকে চাপে রেখেছে মূল্যস্ফীতি। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ শতাংশের ওপরে। অর্থবছরের বাকি সময়েও এ ধারা অব্যাহত থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক।
দেশে মূল্যস্ফীতির হার প্রথম ৯ শতাংশের ঘর অতিক্রম করে গত অর্থবছরের মার্চে। সে সময় এর হার ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে। শেষ মাস জুনে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতির মধ্য দিয়ে শেষ হয় গত অর্থবছর। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে। এরপর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেও মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের কাছাকাছি। এর মধ্যে জুলাইয়ে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ, আগস্টে ৯ দশমিক ৯২, সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৬৩, অক্টোবরে ৯ দশমিক ৯৩ ও সর্বশেষ নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে।
রিজার্ভ সংকট এবারো দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্যকে চাপে রাখবে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির পূর্বাভাস অনুযায়ী, এবারো দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকবে নিম্ন পর্যায়ে। রিজার্ভের ক্ষয় মোকাবেলায় আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখতে হতে পারে সরকারকে। ফলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে ঋণচুক্তির শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড (বিপিএম৬) অনুসরণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ পদ্ধতি অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। এরপর আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ২৩ দশমিক ২৬ বিলিয়নে। এ নিম্নমুখিতা অব্যাহত রেখে সেপ্টেম্বর শেষে ২১ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে, অক্টোবর শেষে ২০ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ও নভেম্বর শেষে ১৯ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে রিজার্ভ। ডিসেম্বর শেষে তা ২১ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার হয়। যদিও পঞ্জিকাবর্ষের শেষে আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে নিট রিজার্ভ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ গত ৯ জানুয়ারি রিজার্ভ নেমে আসে ২০ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্যও ডলার সংকট দূর হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার হবে না। ফলে এক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্যজনক পর্যায়ে পৌঁছতে হলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার এক্ষেত্রে মুদ্রানীতির মাধ্যমে কিছু উদ্যোগ নিলেও সেটি আংশিক। তাছাড়া বাংলাদেশের বিদ্যমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতির স্থিতিস্থাপকতা বজায় থাকা কতটুকু সম্ভব হবে, সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।’
ডলার সংকটের কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে দেশের আমদানি কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে আমদানি হয়েছে ২৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার, যেখানে এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে ৩২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারের আমদানি হয়েছিল। আমদানি কমার প্রভাব পড়েছে দেশের শিল্প খাতের প্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রেও। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য ও কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। এর মধ্যে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ কমেছে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে আরো বলা হয়েছে চলতি অর্থবছরে সরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি স্থিতিস্থাপক থাকতে পারে। মূল্যস্ফীতি কমলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বাড়ার প্রত্যাশা করছে সংস্থাটি।
দেশের রফতানি পরিস্থিতি নিয়ে পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রফতানি গন্তব্যগুলো বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রত্যাশার তুলনায় শ্লথগতির বিষয়টি প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রধান রফতানি গন্তব্যগুলোয় বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ কমে যাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানেও উঠে এসেছে।
বিশ্বব্যাংকের ভাষ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি শ্লথ থাকবে। অর্থবছর শেষে তা দাঁড়াতে পারে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে। এরপর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়াতে পারে।
সংস্থাটির প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ শতাংশ। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাব অনুসারে এ সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
সার্বিক বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেনের মূল্যায়ন হলো ‘এখন পর্যন্ত আমরা যে পরিসংখ্যান দেখেছি তাতে আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। রেমিট্যান্স মোটামুটি একই। কর রাজস্ব কিছুটা বেড়েছে এবং বিদ্যুতের ব্যবহারও বেড়েছে। বিনিয়োগ পরিস্থিতি যে দুর্বল, সেটা তো পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকার অর্থনীতিতে মন্দা হবে না, তবে প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। সে কারণে এসব বাজারে রফতানি প্রবৃদ্ধি নিয়ে ঝুঁকি আছে। তবে সেখানে রফতানি বাড়ারও কিছুটা সম্ভাবনা আছে। ফলে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ঠিকই আছে বলে আমি মনে করি।’
বনিক বার্তা