রিজার্ভ থেকে অর্থ জমা রেখে আইটিএফসি থেকে ঋণ

ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) সঙ্গে ২১০ কোটি ডলারের একটি ঋণ চুক্তি করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। এ চুক্তির আওতায় জ্বালানি তেল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে পারবে বাংলাদেশ। আইটিএফসির সঙ্গে এ ঋণ চুক্তিতে উল্লিখিত অর্থের ৭৬ শতাংশের অর্থের জোগান দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এজন্য ঋণ তহবিলটিতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে জমা হবে ১৬০ কোটি ডলার। আর আইটিএফসির কাছ থেকে পাওয়া যাবে বাকি ৫০ কোটি। প্রসঙ্গত, সদস্য মুসলিম দেশগুলোর জ্বালানি খাতে ঋণসহায়তা দিয়ে থাকে আইটিএফসি। এক্ষেত্রে সংস্থাটি সবসময় অর্থায়ন করে কো-ফাইন্যান্সের ভিত্তিতে। এজন্য ঋণ তহবিলে গ্রহীতা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থায়ন থাকতে হয়।

সংস্থাটির সঙ্গে গতকালের চুক্তিটি সইয়ের পর এটিকে স্বাগত জানিয়েছেন জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা। যদিও অর্থনীতিবিদ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি হলো অনেকটা নিজেদের রিজার্ভ থেকেই নিজেরা ঋণ নেয়া। এ চুক্তির আওতায় অতিরিক্ত হিসাবে আইটিএফসির কাছ থেকে প্রকৃতপক্ষে ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে কেবল ৫০ কোটি ডলার। যেখানে দেশের রিজার্ভ আটকা পড়বে ১৬০ কোটি ডলার। নতুন এ চুক্তির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ আরো চাপে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, আইটিএফসির ঋণ চুক্তিটি মূলত সিন্ডিকেশন ফাইন্যান্স। সংস্থাটি প্রধানত তহবিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে। এ ঋণ চুক্তির আওতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানি ব্যয় মেটানো হবে। সই হওয়া চুক্তিটি এখন অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে যাবে।  সেখান থেকে অনুমোদন মেলার পর ঋণের অর্থ ছাড়ের প্রক্রিয়া শুরু হবে।

ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, স্বল্পমেয়াদি এ ঋণের মেয়াদ ছয় মাস। এ ঋণের সুদহার হবে সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেটের (এসওএফআর) সঙ্গে ২ শতাংশ হারে। বর্তমানে এসওএফআর রেট ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। যে সময়ে ঋণ নেয়া হবে, তার ছয় মাস পর এটি শোধ করে দিতে হবে। পরে আরো ছয় মাস মেয়াদে এ ঋণ তহবিলের অর্থ জ্বালানি কেনার কাজে ব্যবহার করা যাবে।

সচিবালয়ে গতকাল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইটিএফসির সঙ্গে এ ঋণ চুক্তি সই হয়। এতে জ্বালানি বিভাগের পক্ষে সই করেন জ্বালানি সচিব নূরুল আলম। আর আইটিএফসির পক্ষে সংস্থাটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা এম নাজিম নুরদালি সই করেন।

জ্বালানি তেল আমদানির জন্য আইটিএফসির কাছ থেকে ১৫ বছর ধরে ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও সংস্থাটির সঙ্গে বিপিসির ১৪০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি হয়েছে। গতকালের চুক্তির মাধ্যমে আইটিএফসির কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহকারী সংস্থার তালিকায় যুক্ত হলো পেট্রোবাংলাও। আগে অর্থ সংকটের কারণে এলএনজি আমদানি বাবদ সরকারের কাছ থেকে অর্থ পেত সংস্থাটি। মূলত গ্যাসে ভর্তুকি হিসেবে পাওয়া অর্থ দিয়ে এলএনজির দাম সমন্বয় করা হতো। বিগত বছরগুলোয় অর্থ সংকটের কারণে এলএনজি আমদানিতে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) ব্যবহার করেছে পেট্রোবাংলা। দেশে এলএনজি আমদানি হচ্ছে ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে। গত পাঁচ বছরে ১ হাজার ৬২৯ বিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে পেট্রোবাংলার ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার।

আইটিএফসির সঙ্গে এ ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। চুক্তি স্বাক্ষর শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি মাইলফলক। আমরা অনেকদিন ধরেই আইডিবির সহযোগিতা নিচ্ছি। এতদিন তাদের সহায়তা ছিল শুধু জ্বালানি তেল কেনার জন্য। এবার ৫০ কোটি ডলার গ্যাস কেনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারবে পেট্রোবাংলা। বাকি অর্থ তেল কেনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করবে বিপিসি। ২১০ কোটি ডলারের মধ্যে ১৬০ কোটি ডলার সহায়তা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাকি ৫০ কোটি ডলার দেবে আইটিএফসি। নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানির ক্ষেত্রে এটা বড় একটা ভূমিকা রাখবে।’

নতুন এ ঋণ চুক্তির ফলে দেশের নিট রিজার্ভ চাপে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘এ চুক্তির বেশির ভাগ অর্থই বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে জোগান দেবে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ আরো সংকুচিত হতে পারে। বাংলাদেশকে জ্বালানি আমদানি করতেই হবে। আইটিএফসি বহুদিন থেকেই এজন্য ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। গাজাসহ মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে পারে। চুক্তিতে সুদহারের সঙ্গে জ্বালানি তেল ও এলএনজির দাম উল্লেখ থাকলে সেটি ভালো। অন্যথায় এটি নিয়ে কোনো মন্তব্য না করাই উত্তম।’

২০২১ সালের আগস্ট থেকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত ক্ষয় হচ্ছে। ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন পদ্ধতিতে গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। ধারাবাহিকভাবে কমে গত ৩১ জানুয়ারি গ্রস রিজার্ভ ২৫ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) ওইদিন দেশের গ্রস রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে নিট রিজার্ভ রয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলারেরও কম। আইএমএফ থেকে ঋণ প্রাপ্তির শর্ত হিসেবে গত ৩১ ডিসেম্বর নিট রিজার্ভ ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার থাকার কথা ছিল। এ শর্ত পূরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ১ বিলিয়নের বেশি ডলার কিনে নিয়েছিল। কিন্তু তার পরও আইএমএফের শর্ত পূরণ করা সম্ভব হয়নি।

বিপিএম৬ মূলনীতি অনুযায়ী, যেকোনো দেশের রিজার্ভের হিসাবায়নের ক্ষেত্রে ঋণ ও বিনিয়োগকে বাদ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এর আগে রিজার্ভের অর্থে রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) গঠন করেছে। কভিড-১৯-এর সময় এ তহবিলের আকার ৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়েছিল। এছাড়া রিজার্ভ থেকে গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ডে (জিটিএফ) ২০ কোটি ডলার, লং টার্ম ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) তহবিলে ৩ কোটি ৮৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে ৬৪ কোটি, বাংলাদেশ বিমানকে ৪ কোটি ৮০ লাখ ও শ্রীলংকাকে ২০ কোটি ডলার দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ইডিএফ তহবিলের আকার এখন ২৯০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। শ্রীলংকাকে দেয়া ২০ কোটি ডলার সমন্বয় হয়েছে। আর অন্যান্য খাতের বিনিয়োগও কিছুটা কমেছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন পদ্ধতি এবং বিপিএম৬-এর মূলনীতির আলোকে রিজার্ভের ব্যবধান কমে এসেছে। এখন সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইটিএফসিতে বিনিয়োগ বাড়ালে দেশের নিট রিজার্ভ থেকে সেটি বাদ যাবে। এতে নিট রিজার্ভের ওপর চাপ আরো বাড়বে।

আইটিএফসির সঙ্গে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তাকে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে বক্তব্য জানাতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই। সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জেনে জানাতে হবে।’

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর আইটিএফসির সঙ্গে গতকালের ঋণ চুক্তিটিকে তুলনা করছেন ‘ডুবন্ত মানুষের তৃণখণ্ড ধরে বাঁচার চেষ্টার’ সঙ্গে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দেশে ডলারের সংকট এখনো বেশ তীব্র। এ কারণে সরকার যেকোনো অংকের ঋণ সহায়তাকেই স্বাগত জানাবে, এটিই স্বাভাবিক। তবে আইটিএফসির কাছ থেকে ঋণ সহায়তা নতুন কিছু নয়। জ্বালানি খাতে সবসময়ই সংগঠনটি ঋণ দিয়ে থাকে। কিন্তু দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন বেশ নাজুক। জানুয়ারিতে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে। এ অবস্থায় রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কতটুকু আছে, সেটিও দেখতে হবে। ঋণ দেয়া অর্থ জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যবহৃত হবে। তাতে সেটি আর নিট রিজার্ভের অংশ নাও থাকতে পারে।’

বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ক্রয় বাবদ আইটিএফসির কাছে বিপিসির ঋণ ছিল ১ হাজার ১২৬ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন ডলার। ওই অর্থবছরে ১ হাজার ৯৪ দশমিক ৯১ মিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধও করেছে বিপিসি। চলতি অর্থবছরে আইটিএফসির অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ১৪০ কোটি ডলারের ঋণ রয়েছে বলে বিপিসি সূত্রে জানা গেছে।

দেশে জ্বালানি তেলের বার্ষিক চাহিদা ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টন। এর ৯২ শতাংশ আমদানিনির্ভর। বিপিসির বার্ষিক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিপিসি জ্বালানি তেল আমদানি করেছে ৬৮ লাখ ৬৭ হাজার টন। এতে ব্যয় হয়েছে ৬২ হাজার ১৩২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জ্বালানি তেলের চাহিদার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭৮ লাখ টন। বিপুল পরিমাণ এ আমদানিতে ব্যয়ের প্রাক্কলন সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য প্রকাশ না করা হলেও সংশ্লিষ্ট আরেক প্রাক্কলনে দেখা গেছে এতে ব্যয় হতে পারে ৬৫ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা। জ্বালানি তেল বিক্রি বাবদ এখন প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার মুনাফায় রয়েছে বিপিসি।

bonik barta