গত অর্থবছর ছিল দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয়ের বছর। পুরো অর্থবছরজুড়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময় ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে ১৩ শতাংশের বেশি। রেকর্ড পরিমাণ ডলার বিক্রি ও বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ মুনাফা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ৪৯ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুনাফার রেকর্ড। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২২ হাজার ২০০ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল।
২০২২-২৩ অর্থবছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন গতকাল প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেখা যায়, বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার অনর্জিত পুনর্মূল্যায়ন আয় হয়েছে ১৯ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। একই খাত থেকে ১৭ হাজার ৫২ কোটি টাকার অর্জিত আয় হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার অর্জিত আয় হয়েছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি থেকে। কারণ প্রতি ডলার ৯৩ থেকে ১০৬ টাকায় বিক্রি করা হলেও এসব ডলার অনেক কম মূল্যে বাজার থেকে কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
ডলার বিক্রি বাবদ আয় ছাড়াও গত অর্থবছরে বিভিন্ন ব্যাংক ও সরকারকে ঋণ দিয়ে ভালো মুনাফা পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ খাত থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আয় ছিল ৯ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। সরকারের বিভিন্ন বন্ড, সিকিউরিটিজ থেকে প্রাপ্ত সুদ ও ব্যাংকগুলোকে দেয়া ঋণের সুদ খাত থেকে এ আয় হয়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাত থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আয় ছিল ২ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা।
বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়াগ করেও গত অর্থবছরে ভালো মুনাফা পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ খাত থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আয় করেছে ৫ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা আয় করেছিল। বিদেশী বিভিন্ন বন্ড, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি নোট, বৈদেশিক মুদ্রায় বিভিন্ন ব্যাংককে দেয়া ঋণের সুদসহ অন্যান্য খাত থেকে এ আয় করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অন্যদিকে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে থাকা স্বর্ণের পুর্নমূল্যায়নজনিত আয়ও বেড়েছে। এ খাতে আয় দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে আর্থিক প্রতিবেদনে ৪৯ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা আয় দেখিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পেশাদার হিসাববিদরা বলছেন, কম্প্রিহেনসিভ ইনকাম বা সমন্বিত আয় হলো কোনো প্রতিষ্ঠানের সব খাতের অর্জিত সম্মিলিত মুনাফা।
ইতিহাসের সর্বোচ্চ মুনাফার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানো আয়ের পুরোটাই প্রকৃত মুনাফা নয়। ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়া ও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের আয় বেড়েছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শতভাগ মালিকানা সরকারের। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্জিত মুনাফাও সরকারি কোষাগারে জমা হয়।’
মেজবাউল হক বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি ও জিডিপির আকার অনেক বড় হয়েছে। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের আকারও এখন অনেক বড়। ব্যাংক খাতের অবয়ব ও সম্পদের পরিমাণও বাড়ছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফা বাড়বে, এটিই স্বাভাবিক।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের গত সাত বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুনাফা ছিল ৬ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ মুনাফা বেড়ে ৮ হাজার ৪৯২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফা কমে ৬ হাজার ৬২৫ কোটি টাকায় নেমে যায়। এরপর ২০১৯-২০ বছরে মুনাফা হয় ৮ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ৯ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করে। এরপর ডলারের বিনিময় হার অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া শুরু হয়। একই সঙ্গে বাজারে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফা ২২ হাজার ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ওই অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৭৪১ কোটি বা ৭ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। ডলারের বিনিময় হার ৮৪ টাকা থেকে বেড়ে ৯৩ টাকায় গিয়ে ঠেকে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরুতে দেশে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা। গত বছরের জুন শেষে এ বিনিময় হার ১০৬ টাকায় উঠে যায়। পুরো অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ১৩ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে। ক্রয় মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দরে ডলার বিক্রি করার কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফায় উল্লম্ফন হয়েছে। ২০২২ সালের ৩০ জুন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের ৩০ জুন গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। অর্থবছরটিতে রিজার্ভের ক্ষয় হয় ১০ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
বনিক বার্তা