করোনা-পরবর্তী চাহিদা বৃদ্ধি এবং গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়। তবে এরই মধ্যে বেশ কিছু দেশ কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে।
কেন মূল্যস্ফীতি কমানো যাচ্ছে না, তা জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঢাকা সফররত প্রতিনিধি দল। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ঋণের সুদহার আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে তারা। এ ছাড়া শর্ত অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রাজস্ব আহরণ না হওয়ায় উদ্বেগ জানিয়েছে প্রতিনিধি দল।
বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করার পর আইএমএফ চলতি বছরের প্রথমার্ধে যেসব শর্ত দিয়েছিল, তা বাস্তবায়ন ও দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ঢাকায় এসেছে সংস্থাটির এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি মিশন। তারা গতকাল বুধবার প্রথম দিন অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। আগামী ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত তারা থাকবেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গতকাল মিশনের প্রথম বৈঠক হওয়ায় সুনির্দিষ্ট খাতভিত্তিক আলোচনার আগে অর্থ সচিব মো. খায়রুজ্জামান মজুমদারসহ অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রাজস্বে শর্ত পূরণ না হওয়ায় উদ্বেগ জানায় মিশন। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির প্রসঙ্গটি তোলে। মিশনের কর্মকর্তারা বলেন, এরই মধ্যে বেশ কিছু দেশ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে আছে, তার কারণ জানতে চান।
এর জবাবে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ার অন্যতম কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং ডলারের সঙ্গে টাকার মূল্যমান কমে যাওয়া। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের ব্যয় কমায় বাজারে চাহিদা কমছে। একই সঙ্গে সরকারের ঋণ আগের তুলনায় কমেছে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ির পাশাপাশি সুদহার বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গত জুলাই থেকে ধীরে ধীরে ব্যাংক ঋণে সুদহার বাড়ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, গত সেপ্টেম্বরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হার ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। গত মার্চ মাস থেকে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে, যা বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে।
এদিকে গতকাল অর্থ বিভাগের বাজেট অনুবিভাগ এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসংক্রান্ত টেকনিক্যাল টিমের সঙ্গেও মিশনের বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে সরকারের ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ ছাড়া বাজেট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা, যা ১ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার নিচে রাখার শর্ত ছিল। এ ছাড়া বাজেট বাস্তবায়নের হারও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে।
রাজস্ব আহরণে পিছিয়ে থাকার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাজস্ব আদায় বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে। ভ্যাট আহরণে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ইএফডিএমএস) চালু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এসব উদ্যোগে আগামীতে রাজস্ব বাড়বে বলে আশা করা যায়। আজ বৃহস্পতিবার এনবিআরের সঙ্গে আইএমএফ মিশনের বৈঠকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
বৈঠকে অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮ লাখ ৪০ হাজার ৭৩৭ পেনশনভোগীকে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) মাধ্যমে পেনশনের অর্থ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় প্রায় ৩ কোটি ৭১ লাখ ৫৫ হাজার উপকারভোগীকে ইএফটির আওতায় আনা হয়েছে, যা মোট জনগণের প্রায় ২২ শতাংশ। এসব কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করেছে মিশন। সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দ থেকে পেনশনভোগীদের পৃথক করার শর্ত ছিল আইএমএফের। তবে তা করেনি সরকার। এ ক্ষেত্রে আইএমএফ কিছু বলেছে কিনা জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, পেনশনের অর্থ বাদ দিলেও এ খাতে বরাদ্দ আইএমএফের শর্তের চেয়ে বেশি রয়েছে। তাই এ বিষয়ে তেমন কোনো আপত্তি জানায়নি মিশন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক
আইএমএফের অন্যতম শর্ত ছিল, চলতি বছরের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে রাখতে হবে। ওই সময় রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। সেপ্টেম্বর শেষে ন্যূনতম রিজার্ভ রাখার শর্ত ছিল ২৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। তবে ওই সময় দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার। শর্ত পূরণ সম্ভব না হওয়ার কারণ মিশনকে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের উপস্থিতিতে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, আইএমএফ ঋণ অনুমোদনের সময় কিছু শর্ত দিয়েছিল। এর মধ্যে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করা হয়েছে। দু-এক জায়গায় ব্যর্থতা আছে। রিজার্ভ কিছু কম আছে। রাজস্ব আহরণ কম হয়েছে। তবে অনেক কিছু বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশের কথা ছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করেছে। আইএমএফের বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী রিজার্ভ হিসাবায়ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাজারভিত্তিক বিনিময় হার প্রবর্তন করা হয়েছে। সুদহারের নতুন নিয়ম চালু করা হয়েছে।
শর্ত পূরণ না হওয়া নিয়ে আইএমএফের পক্ষ থেকে কী বলা হয়েছে– এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, বৈঠক কেবল শুরু হয়েছে। তারা (আইএমএফ) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে বসে আলোচনা করবে। প্রথমে তথ্য নিচ্ছে, তার পর আবার বৈঠক করবে। আগামী ১৯ অক্টোবর শেষ বৈঠক, সেখানে তাদের মতামত জানাবে। তার পর বিষয়গুলো গণমাধ্যমকেও জানানো হবে।
আইএমএফ গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে। এর তিন দিন পর প্রথম কিস্তিতে ছাড় করে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। দ্বিতীয় কিস্তির প্রায় ৬৬ কোটি ডলার ছাড় হওয়ার কথা আগামী মাসে। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট সাত কিস্তিতে পুরো অর্থ দেওয়ার কথা।
সূত্র : সমকাল