রাস্তায় সংঘাত এবং অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনা

শুক্রবার আগস্ট ৪, ২০২৩ ১১:০১ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: শুক্রবার আগস্ট ৪, ২০২৩ ১১:০১ পূর্বাহ্ন

দেশের চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে, আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল রাস্তায় চূড়ান্ত সংঘাতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এটাকে কি গণতন্ত্র বলা যায়? বিরোধী দল যখনই সমাবেশের কর্মসূচি দিচ্ছে তখনই পাল্টা কর্মসূচি কতটা যুক্তিপূর্ণ, সেটাও আবার একই দিনে? এতে কি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম হবে, না আরও সংকট তৈরি করবে? নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসছে, সম্ভাব্য বিভীষিকাময় পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মনে আতঙ্ক ও আশঙ্কা তত বেশি বাড়ছে।

আমরা হয়তো দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে নদীর নিচে টানেল তৈরি করেছি, বিশ্বের সবচেয়ে খরস্রোতা নদীগুলোর অন্যতম পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণ করেছি, কৃষিকাজ, তৈরি পোশাক খাত ও রেমিট্যান্সে বিপ্লব ঘটিয়েছি, অন্যান্য আধুনিক শহরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদি তৈরি করেছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে আমরা বিন্দুমাত্রও অগ্রসর হতে পারিনি। মর্মান্তিকভাবে এখানেই আমরা ব্যর্থ হয়েছি।

জাতীয় সংসদ এক সময় ‘জনগণের সংসদ’ হিসেবে পরিচিত হলেও এখন এটি ক্ষমতাসীন সরকারের একটি বর্ধিত অংশে পরিণত হয়েছে, যা আমাদের এই ব্যর্থতার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কোনটি গণতন্ত্র আর কোনটি গণতন্ত্র নয়, তা নির্ধারণের বিষয়টি এখন পুরোপুরি নির্ভর করছে যে দল সরকার গঠন করেছে, তাদের ওপর। এটি এখন সহিংসতায় পূর্ণ এক প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) মতো আইনের কারণে মত প্রকাশের স্বাধীনতা পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। ভিন্নমত পোষণের সংস্কৃতিকে এখন এতটাই খারাপ দৃষ্টিতে দেখা হয় যে, ভিন্নমত পোষণকারীদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেন তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ নয়।

নির্বাচন এমন একটি সময় যখন ভোটাররা ‘রাজা’ হিসেবে গণ্য হওয়ার কথা, যখন রাজনৈতিক নেতারা ‘জনগণের আদালতের’ সামনে নতজানু হয়ে আগের ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়ার কিংবা কেন তাদের ওপর ভরসা রাখা উচিত, সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার কথা। অথবা শুধুই নির্বাচনে তাদেরকে সমর্থন জানানোর কথা বলবেন। এটা হচ্ছে সেই সময় যখন ক্ষমতা সাধারণ মানুষের কাছে থাকে। আমাদের দেশে ৫ বছর পর পর নির্বাচন হয়। এ সময় জনগণই সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকার কথা। এটা সেই মুহূর্ত যখন ‘প্রজাতন্ত্র’ তার প্রকৃত রূপ দেখায় এবং সামগ্রিক ও ব্যক্তিগতভাবে মানুষ অনুভব করতে পারে যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আসলে কীরকম।

কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এরকম কিছুই ঘটছে না। ‘রাজার’ মতো অনুভব করা তো দূরে থাক, আমরা সারাক্ষণ হুমকির মধ্যে থাকছি। আগেও আমাদেরকে যেভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখা হয়েছে ও আমাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করা হয়েছে, এখনো পরিস্থিতি একই রকম। নির্বাচনের সময়ে এসেও ভোটারদের ক্ষমতায়নের মতো কোনো অনুভূতি পাওয়া যাচ্ছে না এবং মনে হচ্ছে, আদতে কিছুই বদলায়নি।

শুরুতেই বলেছি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—উভয় দলই সংলাপে না বসার ও কোনো ধরনের ছাড় না দেওয়ার যে অবস্থান নিয়েছে, তার পরিণতি হচ্ছে চলমান পরিস্থিতির মীমাংসা হবে সড়কে এবং শুধু পেশিশক্তি প্রদর্শনীর মাধ্যমেই তা সম্ভব।

যখন রাজনীতির অর্থ হয়ে দাঁড়ায় সড়কে নেমে একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়ানো, তখন প্রশ্ন জাগে, উভয় দলের কোন ধরনের নেতাকর্মীরা এক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন? এসব ক্ষেত্রে যারা সংযত, ভদ্র, রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন ও কিছুটা সংস্কৃতিমনা, তারা সাধারণত পিছিয়ে পড়েন। আর যারা উদ্ধত, পেশিশক্তি প্রদর্শনীতে দক্ষ, রাস্তায় মারামারিতে অভিজ্ঞ, অভ্যস্ত ও অস্ত্রের ব্যবহারে পারদর্শী, তারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তারা পরবর্তীতে সংঘাতকে আরও বেশি উসকে দেন। কারণ এতে শক্তি, ক্ষমতা ও অর্থ বাড়ে। যত বেশি সংঘাত, দুষ্কৃতিকারীরা ততই উপরে উঠতে থাকেন এবং উভয় পক্ষের মধ্যে সহিংসতা আরও বাড়তে থাকে। এরপর খুব দ্রুতই সহিংসতা একটা নিজস্ব গতি পায় এবং এর মাত্রাও বাড়তে থাকে।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিশেষত বিক্ষোভের আয়োজন ক্রমাগত ‘বুদ্ধিবৃত্তিক’ চর্চার চাইতে ‘পেশির’ ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল হতে শুরু করে। আর এ ক্ষেত্রে তারাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়, যারা চিন্তাশক্তির ব্যবহারের চেয়ে সহিংসতায় বেশি পারদর্শী। ফলে প্রকৃতপক্ষে যারা রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে সহিংসতা কমাতে পারতেন, তারাও দৃশ্যপট থেকে আড়ালে চলে যেতে বাধ্য হন। যারা প্রতিপক্ষকে মারধরে পারদর্শী এবং কখনো কখনো মেরেও ফেলতে পারে, রাজনীতির অঙ্গনে তাদের সামনে এগিয়ে আসার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন থেকে সৃষ্টি নেওয়া ‘হেলমেট বাহিনী’। ছাত্রলীগের মধ্যে যারা সংযত, তারা ধারাবাহিকভাবে প্রভাব ও নেতৃত্ব হারিয়েছেন। কেউ কেউ বলেন, তাদের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন।

রাস্তায় এরকম সহিংসতা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে সার্বিকভাবে রাজনীতির এবং সুনির্দিষ্টভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুণগত মান কমতে থাকে। আমরা জাতি হিসেবে এ বিষয়টির উদাহরণ।

এই সংঘাতের পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে উভয় দলই উদাসীন। বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকায় ইতোমধ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দেশ অনেক পিছিয়ে পড়েছে এবং সংঘাত বেড়েছে। আগামী দিনগুলোতে তা আরও বাড়বে। তাদের এই উদাসীনতা দেশের জন্য কখনোই ভালো হতে পারে না। যদিও তারা প্রতিনিয়ত দেশের স্বার্থ নিয়ে কথা বলার ভান করছেন।

কেন আমরা ভোটাররা এই পরিস্থিতি মেনে নিতে বাধ্য হব? আমরা ভোট দেওয়ার সুযোগ পেতে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিষয়ে আমাদের মত প্রকাশ করতে; যারা আগামীতে ক্ষমতায় আসতে চাইছে, তাদের কার্যকলাপ যাচাই করতে; পরিকল্পনা ও নীতিমালার বিষয়ে আমাদের ফয়সালা জানাতে; যে বিষয়গুলো আমরা একেবারেই ঘৃণা করি, সেগুলো নিয়ে অসন্তুষ্টির কথা জানাতে এবং একইসঙ্গে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎকে যেভাবে দেখতে চাই, সে বিষয়ে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি জানাতে ৫ বছর অপেক্ষা করি। এসব তখনই সম্ভব হয়, যখন দেশের মানুষ একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।

ক্ষমতার সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয়গুলোর অন্যতম হলো, যারা দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখে, তারা তাদের নিজেদের বানানো জগতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সত্যকে উপেক্ষা করার মধ্য দিয়ে এটি শুরু হয় এবং পরবর্তীতে তারা নিজেদের বাগাড়ম্বর বিশ্বাস করতে শুরু করে। তারা দাবি করতে থাকে, তারা কোনো ভুল করছে না। শিগগির তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে, তাদের কোনো ভুল হতে পারে না এবং এক পর্যায়ে, তাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে বাস্তবতার ব্যবধান দেখা দিতে শুরু করে। অনিবার্যভাবে তারা নিজেদের প্রচার-প্রচারণায় মজে যায়। ফলে তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বাস্তবতা দেখানোর মতো বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যমগুলো একে একে বন্ধ হতে থাকে। এই ক্রান্তিলগ্নে নাগরিক সমাজ, তৃণমূল পর্যায়ের এনজিও, পেশাদার গবেষণা সংস্থা ও স্বাধীন গণমাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় তাদের ‘শত্রু’; যাদের মতামত শুধু নাকচ করাই হয় না, তাদেরকে দমন করা হয় এবং বিভিন্ন অপবাদ দেওয়া হয়। যেহেতু প্রকৃত সত্যের চেয়ে প্রোপাগান্ডাকে এগিয়ে রাখতে হয়, তাই সরকারি ‘সংস্থাগুলোকে’ এক্ষেত্রে নামানো হয়। তারাই তখন ঠিক করে দিতে থাকে কে কী বলবে। ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগীরা তখন সত্যের বেসাতি হন এবং প্রকৃত সত্যবাদীরা হন ভুক্তভোগী।

উন্নয়নশীল দেশগুলো এই মুহূর্তে যেসব বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বাস্তবতাকে আড়াল করে দিয়ে ক্রমাগত মিথ্যা প্রচার চালানো। বাংলাদেশের পরিস্থিতিও এর থেকে ভিন্ন নয়।

রাস্তায় সহিংসতা থেকে শুরু করে অসত্য বয়ান তৈরি করা পর্যন্ত সব মিলিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন অস্তিত্ব সংকটে। কিন্তু যারা এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে পারেন তারা হয় এ সম্পর্কে হয় পুরোপুরি উদাসীন কিংবা বিষয়টি নিয়ে মোটেও চিন্তিত নন।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান