রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আরেকটু স্বচ্ছতা–সততা আনা উচিত, দুদক থেকে বেরিয়ে বললেন খালিদী
‘জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ অর্জনের’অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) নোটিশ পেয়ে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে ফিরে এসেছেন অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী। আজ সোমবার সকালে তিনি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হন।
সেখান থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে ভিত্তিহীন উল্লেখ করেন বিডিনিউজের প্রধান সম্পাদক খালিদী। তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আরেকটু স্বচ্ছতা, সততা আনা উচিত, ন্যায়নিষ্ঠতা থাকা উচিত বলেও মন্তব্য করেন।
গত ৫ নভেম্বর দুদকের এক চিঠিতে তাঁকে দুদকে এসে বক্তব্য দিতে বলা হয়। দুদক থেকে ফিরে যাওয়ার সময় তৌফিক ইমরোজ খালিদী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। দুদকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য সময় চেয়ে আবেদন করার পরও কেন দুদকে এসেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি সময় চেয়ে আবেদন করেছিলাম, কিন্তু তারা আনুষ্ঠানিক কোনো উত্তর দেননি। আমি নিয়ম মানতে চেয়েছি। খবর পেয়েছি তদন্তকারী কর্মকর্তা এখনো এসে পৌঁছাননি। কিছুক্ষণ আগে তদন্তকারী কর্মকর্তার ঊর্ধ্বতন পরিচালক, তিনি জানিয়েছেন যে আজকে বক্তব্য নেওয়া হবে না। আমি আইন-কানুন মেনে চলার চেষ্টা করি। যদি না সময়-সীমা বাড়ানো হয় তাহলে কী হতো? আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে যেহেতু জানানো হয়নি। কাজেই আমাকে আসতে হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদকের মুখপাত্র প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, উনি সময়ের আবেদন করেছিলেন বৃহস্পতিবার বিকেলে। ওই দিনই অনুসন্ধান কর্মকর্তা তাঁর আবেদনটি গ্রহণ করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পরের তারিখ জানানো হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। তারপরও কেন তিনি হাজির হয়েছেন তা বোধগম্য নয়।
গত ৫ নভেম্বর দুদকের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছিল, তৌফিক ইমরোজ খালিদীর নিজের এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হিসাবে ‘বিপুল পরিমাণ টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে অবস্থান গোপন’ এবং বিভিন্ন ‘অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ’ অর্জনের অভিযোগে তার বক্তব্য জানা প্রয়োজন।
তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে সে প্রসঙ্গে আরেক প্রশ্নের জবাবে তৌফিক ইমরোজ খালিদী সাংবাদিকদের বলেন, ‘অভিযোগটা কী সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। আমাকে বলা হয়েছে যে অবৈধ সম্পদ অর্জনের…. যেটা হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে একটি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে। এই বিনিয়োগের একটি অংশ হচ্ছে আমরা নতুন শেয়ার ইস্যু করে তাদের কাছে দিয়েছি। আরেকটি হচ্ছে আমার অল্প মালিকানা যতটুকু আছে সেখান থেকে বিক্রি করেছি। তাতে আমার একেবারে সম্পদহীন (নগদ) অবস্থা থেকে সম্পদ তৈরি হয়েছে। এতে অবৈধ সম্পদ অর্জন কী করে হলো?’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে নিবন্ধিত একটি কোম্পানি আমার শেয়ার কিনে নিয়েছে। এবং তারা মিউচুয়াল ফান্ড ম্যানেজ করে করেছে। আমাদের দিক থেকে সমস্ত আইন-কানুন মেনে এই বিনিয়োগ গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো গণমাধ্যম কোম্পানি, সংবাদমাধ্যমে এই প্রথম এ ধরনের একটা বিনিয়োগ হয়েছে। আমার ধারণা কেউ কেউ এটা পছন্দ করেনি। আর আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে যেটা বলা হয়েছে এটা অত্যন্ত বেদনার। যারা আমাকে চেনে, আমার সঙ্গে যারা কাজ করে, আমার সহকর্মী, আত্মীয়-স্বজন, আমার পরিবার আমার ধারণা তাদের সবার জন্য বেদনার।’
অভিযোগ ভিত্তিহীন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভিত্তিহীন মানে… সীমাহীন ভিত্তিহীন। একেবারেই ভিত্তিহীন। আমার যেহেতু মালিকানা ছিল সেটার একটা অংশ বিক্রি করেছি। সেটা থেকে আমার অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা এসেছে। ৩ অক্টোবর সকল কাগজপত্র সই করা হয়েছে, ৬ অক্টোবর আমার অ্যাকাউন্টে টাকা এসেছে। সেই টাকার যে পরিমাণ আয়কর দিতে হবে তা আমি দেব। ২০১৯-২০ অর্থবছরের যে আয়কর হবে আমি সেটা দেব।’ খালিদী আরও বলেন, ‘আমাকে কেউ কোনো দিন বলতে পারবে না যে ঠিকমতো আয়কর দিইনি। একটা উদাহরণ দেখিয়ে কেউ বলতে পারবে না যে, আমি সারা জীবনে, যত দিন ধরে আমার আয়কর দেওয়ার সীমা এসেছে, কেউ বলতে পারবে না আমি আয়কর দিইনি। কেউ আমি জোর গলায় কথা বলছি, কারণ আমি নিয়মকানুন মেনে চলি। বাংলাদেশের যে আয়কর আইন আছে তা মেনে চলি। সমস্ত কিছু মেনে চলি।’
বিডিনিউজের প্রধান সম্পাদক বলেন, ‘৬ অক্টোবরের আগে আমার অ্যাকাউন্টে টাকা ছিল না। আমি আমার শেয়ার বিক্রি করেছি, এটা আমার অধিকার। আমার নামে সম্পদ যা আছে সেটা বিক্রি করার অধিকার আমার আছে, সেটা আমি করেছি।’
পদ্মা ব্যাংকের এমডির কাছে অর্থ দাবি করেছিলেন, এমন একটা গুঞ্জন আছে-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গুঞ্জন নিয়ে তো আমি কোনো কথা বলব না। পদ্মা ব্যাংকের বিষয়ে একজন ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে বলে আমি শুনেছি। পদ্মা ব্যাংকের এমডিকে আমি চিনি না, তার নামও আমি জানি না। জানার চেষ্টাও করি না। খেয়াল করে দেখবেন ফেসবুকে যে পোস্ট দেওয়া হয়েছে সেই পোস্টের কোনো জবাবও দিইনি। জবাব দিতে আমার রুচিতে বেঁধেছে। কার সঙ্গে আমি ঝগড়া করব, কোন টাইপের লোকের সঙ্গে আমি ঝগড়া করব।’
এলআর গ্লোবাল নামের যে প্রতিষ্ঠানটি বিডিনিউজে বিনিয়োগ করেছে, সে প্রতিষ্ঠান বিএসইসি কর্তৃক পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ বলে শোনা যাচ্ছে। এরা বিনিয়োগ করতে পারে না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা এসইসিকে জিজ্ঞেস করতে হবে। আমি জানি না এসইসি কর্তৃক নিষিদ্ধ কিনা। ওরা যখন আমার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট সাইন করতে আসে… আমরা এক মাস ধরে আলোচনা করেছি। ওরা আমাদের প্রত্যকটি হিসাব-নিকাশ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখেছে। আমি তো বিস্মিত হয়ে গেছি, তারা এত খুঁটিনাটি দেখেছে যে আমি এক ধরনের বিরক্ত হয়ে গেছি। একদম আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড। যে ভদ্রলোক এই কোম্পানি চালান তিনি আমেরিকাতে বড় হয়েছেন। আমেরিকান সবচেয়ে বড় কোম্পানিতে উনি চাকরি করেছেন। সেই ভদ্রলোক তার টিম নিয়ে আমাদের সমস্ত কাগজপত্র দেখেছেন। এরপর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যেদিন স্বাক্ষর করার জন্য আসা হয় সেদিন তিনজন উকিল…ব্যারিস্টার নিয়ে এসেছেন। তাদের কারও বাবাকে আমি চিনতাম, তাদের বলেছি যে, তোমরা দেখেছ ঠিকমতো, সবকিছু ঠিক আছে তো, আইন-কানুন মেনে কাজ করছি তো? আমাদের লোকেরাও ছিল, এরপর আমি সাইন করেছি। এখন তারা নিষিদ্ধ কী নিষ্দ্ধি নয় তা এসইসি কে জিজ্ঞেস করতে হবে। আমার ধারণা এটা নিষিদ্ধ নয়। নিষিদ্ধ থাকলে তাদের ব্যবস্থাপনায় থাকা যে ছয়টি মিউচুয়াল ফান্ড আছে, সেই মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তিনি ট্রান্সফার করতে পারতেন না। সেই কোম্পানি পারত না বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অ্যাকাউন্টে এবং আমার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে, যেটা সম্ভবপর হতো না।’
হঠাৎ করে কেন অভিযোগ উঠল এ প্রশ্নের জবাবে খালিদী বলেন, ‘আমিও বিস্মিত। আমি একেবারে বিস্মিত হয়ে গেছি। আমি চমকে গেছি। এই প্রথম আমি প্রকাশ্য কথা বলছি। আমি একেবারেই বিস্মিত হয়ে গেছি। আমরা সহকর্মীরা যখন বলছেন যে এই চিঠি (দুদকের চিঠি) এসেছে। আমি তখন তাদের বলেছি যে, এটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমি আমার পদ থেকে পদত্যাগ করতে প্রস্তাব দিয়েছি। যেহেতু আমি এখন খবরের মধ্যে আছি, আমার সহকর্মীদের বলেছি তোমরা আমাকে প্রশ্ন করতে পারো। সেই প্রশ্ন তারা করেছে আমি বলেছি, সেগুলো ছাপাও হয়েছে।’
কেন অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে সে বিষয়ে সাংবাদিকদের অনুসন্ধান করতে বলেন খালিদী। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিক হিসেবে আপনারা ইনভেস্টিগেশন করেন যে, কেন হয়েছে। কোন খবর নিয়ে হয়েছে। কোনো খবরে যদি আমাদের ভুল থাকত, একটি শব্দ, একটি বাক্য, একটি তথ্য, তাহলে আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারত। মামলা করেনি। এই পথ কেন নিল। আমাকে বলা হয়েছে আসার জন্য, আমি এসেছি। আমাকে এমন প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে যে, এটা ঠিকঠাক করে দেওয়া যায়। বিভিন্নজন বিভিন্ন রকমের প্রস্তাব দিয়েছে। আমি বলেছি না, চিঠি যেহেতু ইস্যু করা হয়েছে, কে চিঠি লিখেছে তাও আমি জানি না।’
বিডিনিউজের প্রধান সম্পাদক বলেছেন, কারা চিঠি লিখে বলেছে যে, আমার নাকি অবৈধ সম্পদ আছে! অভিযোগ এসেছে আমি ডিফেন্ড করব এবং যত দূর যেতে হয় আমি ডিফেন্ড করব।’ তৌফিক ইমরোজ বলেন, এই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আরেকটু স্বচ্ছতা আনা উচিত। আরেকটু সততা থাকা উচিত। আরেকটু ন্যায়নিষ্ঠতা থাকা উচিত।