রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর আর্থিক চাপ আরো বাড়িয়ে তুলছে টাকার অবমূল্যায়ন

বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি নানাবিধ ব্যয় নির্বাহের জন্য নিয়মিতভাবে বিদেশী সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ঋণ নেয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে নেয়া এসব ঋণের পরিমাণ ২০২১-২২ অর্থবছর (জুলাই-জুন) শেষে ছিল ৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন (৬৯০ কোটি) ডলারের কিছু বেশি। গত অর্থবছরের শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ বিলিয়ন (৭০০ কোটি) ডলারে। বিদেশী এসব ঋণকে এখন সংস্থাগুলোর জন্য বড় ধরনের আর্থিক চাপের কারণ করে তুলেছে ডলারের বিপরীতে টাকার ক্রমাগত অবমূল্যায়ন। টাকার অংকে ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় বাড়ছে সংস্থাগুলোর। ব্যয় বাড়ছে বিদেশ থেকে পণ্য ও যন্ত্রপাতি আমদানিসহ আনুষঙ্গিক অন্য অনেক ক্ষেত্রেও।

২০২২ পঞ্জিকাবর্ষের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২৯ শতাংশ। টাকার অবমূল্যায়নের ফলে সংস্থাগুলোর আর্থিক ব্যয় বেড়েছে অনেক। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সংস্থাগুলোর আর্থিক বিবরণীতেও টাকার অবমূল্যায়নজনিত বড় অংকের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি উঠে এসেছে।

দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রয়েছে ৪৮টি। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩-এর তথ্যানুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাময়িক হিসাব অনুসারে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর মোট ১৩ হাজার ৭৪১ কোটি ৫১ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর বড় একটি অংশে অবদান রেখেছে টাকার অবমূল্যায়ন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন শেষে সংস্থাগুলোর মোট বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২২ সালের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল ৬ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার।

ডলারের বিপরীতে টাকার মান দুর্বল হতে শুরু করে গত বছরের শুরুতে। সে সময় (২০২২ সালের জানুয়ারি) দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৬ টাকা। আর সর্বশেষ গতকালের বাজারে প্রতি ডলারের দর ছিল ১১১ টাকা। সে অনুযায়ী, এ সময়ের মধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২৯ শতাংশের বেশি। এতে আর্থিক বিপত্তি বেড়েছে বিদেশী ঋণগ্রহীতা সংস্থাগুলোর। টাকার অংকে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এর সঙ্গে বেড়েছে ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধের ব্যয়ও। বাড়তি এ ব্যয় একদিকে লাভে থাকা সংস্থাগুলোর মুনাফাকে সংকুচিত করে তুলছে, অন্যদিকে আর্থিক ক্ষত বাড়াচ্ছে লোকসানি প্রতিষ্ঠানের।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে বড় অংকের ঋণ রয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি)। ২০২২ সালের জুন শেষে সংস্থাটির দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৭ হাজার ১৮৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিদেশী ঋণ ১২ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। এছাড়া এক বছরের মধ্যে পরিশোধযোগ্য বিদেশী ঋণ ছিল ১ হাজার ৬৮৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরে টাকার অবমূল্যায়নজনিত লোকসানের পরিমাণ ছিল ৬১১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এ সময়ে সংস্থাটির কর-পরবর্তী নিট লোকসান হয়েছে ৩ হাজার ২৩২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। বিপিডিবির ২০২২-২৩ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশিত না হওয়ায় এ সময় সংস্থাটির বিনিময় হারজনিত ক্ষতির পরিমাণ এখনো জানা যায়নি। তবে গত অর্থবছরে সংস্থাটির টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতির পরিমাণ আগের অর্থবছরের চেয়ে আরো বেড়েছে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিপিডিবির পরিচালক (জনসংযোগ) মো. শামীম হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আমাদের যেহেতু বিদেশী ঋণ রয়েছে, ফলে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব পড়বে। এটি একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা। এ সংকট প্রশমনে আমরা চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তাও নেয়া হচ্ছে। সামনের দিনগুলোয় কী হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তাই কঠিন পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই আমাদের নীতিগুলো সে অনুযায়ী নির্ধারণের চেষ্টা করছি।’

বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ঋণের পরিমাণ ২০২৩ সালের জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকায়। জাহাজ কেনার জন্য জাপান ও চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে জাপানি ঋণের পরিমাণ ৫৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আর চীনা ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৫০০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ২০২২-২৩ হিসাব বছরে বিএসসির শুধু চীনা ঋণ পরিশোধ বাবদ আর্থিক ব্যয় বেড়েছে ১৫ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ২০২২ সালের জুন শেষে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৩৩০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ১৭০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, যেখানে এর আগের অর্থবছরে বিদেশী ঋণ ছিল ৬ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। সংস্থাটির আর্থিক প্রতিবেদনে বিনিময় হারজনিত ক্ষতির বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।

২০২২ সালের জুন শেষে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বিদেশী ঋণ ছিল ৫ হাজার ২৬১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। বিনিময় হারজনিত কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসান হয়েছে ৩৯৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা। যেখানে আগের অর্থবছরে এ বাবদ কোনো লোকসান দিতে হয়নি প্রতিষ্ঠানটিকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিপিসির কর-পরবর্তী নিট লোকসান হয়েছে ২ হাজার ৭০৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। যেখানে আগের অর্থবছরে সংস্থাটির ৯ হাজার ৯২ কোটি ৬১ লাখ টাকা কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছিল।

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) ২০২২ সালের জুন শেষে ১১ হাজার ১৯৭ কোটি ১৯ লাখ টাকার দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ ছিল। বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের বিপরীতে এ ঋণ নিয়েছে সংস্থাটি। সংস্থাটির আর্থিক প্রতিবেদনে বিনিময় হারজনিত কারণে কী পরিমাণ মুনাফা বা লোকসান হয়েছে, সে তথ্য দেয়া হয়নি।

বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাবের বিষয়ে জানতে বিআরইবির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

২০২২ সালের ৩০ জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ ছিল ৬ হাজার ৮৮৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর আগের অর্থবছর সংস্থাটিতে দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪৫৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের আর্থিক হিসাব এখনো প্রকাশ করেনি বেবিচক।

ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি বেবিচকের বৈদেশিক ঋণে কোনো ধরনের চাপ তৈরি করছে না বলে মন্তব্য করেছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌বেবিচক সরকারের একটি লাভজনক সংস্থা। রাজস্ব হিসেবে টাকার পাশাপাশি সরাসরি ডলারেও আয় হয়। ফলে বেবিচকের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় এবং বৈদেশিক ঋণের মধ্যে সব সময় একটা ভারসাম্য থাকে। ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়া বেবিচকের বৈদেশিক ঋণে কোনো চাপ তৈরি করবে না।’

তবে চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের বৈদেশিক কেনাকাটায় প্রভাব পড়ার কথা জানিয়েছেন বেবিচক চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘‌ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন ধরনের এলসি খুলতে অসুবিধা হচ্ছে। প্রত্যেক প্রকল্পেই বেবিচকের কিছু বৈদেশিক কেনাকাটা আছে। ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় এসব বৈদেশিক কেনাকাটায় আমাদের বেগ পেতে হচ্ছে। যদিও কক্সবাজার রানওয়ে, রাডার ক্রয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বৈদেশিক কেনাকাটার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। অন্য প্রকল্পগুলোয় অসুবিধা হচ্ছে।’

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর বিদেশী ঋণের বড় একটি অংশ নেয়া হয়েছে সড়ক ও যোগাযোগ অবকাঠামো। এখন পর্যন্ত নিজেদের ওয়েবসাইটে সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরের আর্থিক হিসাব প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সংস্থাটি বিদেশী ঋণ ছিল ৭৯৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৩৫৬ কোটি ৮০ লাখ ও বিশ্বব্যাংকের (আইডিএ) ৩৭৩ কোটি টাকা ৭৫ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে।

বর্তমানে সংস্থাটিতে বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। বেশির ভাগ প্রকল্পই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বিদেশী ঋণে। এর মধ্যে গত ২৮ অক্টোবর উদ্বোধন হয়েছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর নিচে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। টানেলটি তৈরিতে খরচ হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। এ ঋণের মেয়াদ ২০ বছর।

সেতু কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়নাধীন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। সাভারের ইপিজেড থেকে আশুলিয়া-বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর হয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে এ উড়ালসড়ক। জিটুজি পদ্ধতিতে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে অর্থায়ন করছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। গত বছরের ২৬ অক্টোবর করা ঋণ চুক্তি অনুযায়ী, ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য চীন সরকার বাংলাদেশকে ১১২ কোটি ৬৯ লাখ ডলার বা প্রায় ৯ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। প্রেফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটের (পিবিসি) আওতায় দেয়া এ ঋণ পাঁচ বছরের রেয়াতকালসহ ২ শতাংশ সুদে ২০ বছরের মধ্যে শোধ করতে হবে।

২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৬০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। বাস ও ট্রাক কিনতে গিয়ে নরডিক ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (এনডিএফ), ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ডসহ (ইডিসিএফ), ভারত, ইতালি, যুক্তরাজ্য, সুইডেনের মতো দেশগুলোয় ঋণ করেছে বিআরটিসি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদেশী ঋণের প্রয়োজন ছিল তাই নেয়া হয়েছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ নিয়েছে তারা মুনাফা করছে এবং সেখান থেকেই ঋণ পরিশোধ করবে। প্রয়োজন হলে ঋণ পুনঃতফসিল করা হবে, সমস্যা তো নাই।’

বনিক বার্তা