আওয়ামী লীগ অনেক দিক দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সফল হয়েছে। বিরোধী দলকে মাঠে দাঁড়াতেই দিচ্ছে না। গত তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। কাউকে পাত্তা না দিয়ে নিজেদের মতো করেই দুটি নির্বাচন করে ফেলেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে একচেটিয়াভাবে জিতে এসে সরকার গঠন করেছে। দু-দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করার পরও আওয়ামী লীগের অবস্থান কেউ টলাতে পারেনি। আওয়ামী লীগ যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। এর মধ্যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা সেতুর তলদেশ দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। বিএনপি অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের অবস্থান অনড়। অক্ষয় কি না, এখনো সেটা বলার সময় আসেনি।
আওয়ামী লীগের সাফল্যের তালিকা আরও লম্বা হতে পারে। উন্নয়নের অনেক বিবরণ আওয়ামী লীগের লোকজন হাজির করতে পারবেন। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কতটা সফল হলো? ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠাননির্ভর একটি সংগঠনে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সমাজ, খেলাধুলা—সবকিছুই এখন আওয়ামী লীগের দখলে।
রাজনীতির মাঠ থেকে খেলাধুলার অঙ্গন—সর্বত্রই আওয়ামী লীগের একচেটিয়া দাপট। রাজনীতির মাঠে বিরোধী মতের জন্য জায়গা বেশ সংকুচিত হয়ে গেছে। বিরোধী পক্ষ মানে বিএনপির প্রতিটি সভা-সমাবেশের আগে ধরপাকড় এখন নিয়মিত ঘটনা। ধরপাকড়ের চিত্রটি কমবেশি একই ধরনের।
বিএনপি মহাসমাবেশ বা মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে। কর্মসূচির দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলেই বিরোধী নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হানা দিতে শুরু করেন গোয়েন্দারা। রাতবিরাতে আটক করে ধরে আনা হয়।
কর্মসূচির দিন যথারীতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনুষ্ঠানস্থলে নানা বাহানায় হামলা করে। আগে র্যাব বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব পালন করত। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্তির পর এই দায়িত্ব এখন পুলিশ পালন করছে। সাদাপোশাকে বা পুলিশের পোশাক পরেই হামলা করছে। মারধর করছে।
এরপর পরবর্তী ধাপের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কর্মসূচির দিন ঘটনাস্থল থেকে তো আটক করাই হয়; এর পরের কয়েক দিনও ব্যাপক ধরপাকড় চলে। এখন তো বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের অধিকাংশ নেতারাই কারাগারে। পুলিশের ভয়ে বাকিরা পালিয়ে রয়েছেন। অনেকে বাসায় তল্লাশি অভিযান চালানো হয়েছে এবং হচ্ছে।
তল্লাশির সময় গোয়েন্দা পুলিশের লোকজন সিসিটিভির ফুটেজ ও কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক খুলে নিয়ে যান। এতে বোঝা যায়, পুলিশের লোকজন তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ে খুব বেশি দক্ষ নন। এখন কেউই গোপনীয় দলিল বা লেখাজোকা কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে সংরক্ষণ করেন না। নানা ধরনের সার্ভারে বিনা পয়সায় সংরক্ষণ করা যায়। এ ধরনের দলিলাদি সেসব সার্ভারেই রাখা হয়। ফুটেজ ও ডিস্ক নিয়ে এসব পুলিশ কর্মকর্তা বেশ কর্মতৎপরতা দেখান বটে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।
রাজনৈতিক কর্মসূচির আগের কয়েক দিন ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। এতে অরাজনৈতিক লোকেরাও সংকটের মুখে পড়েন। বিশেষ করে যাঁরা আউটসোর্সিংয়ের কাজ করেন, তাঁরা বেশে বিপাকের মধ্যেই থাকেন। পল্টনে বিএনপি সমাবেশ করলেই ওইখানে ইন্টারনেট সংযোগ থাকে না। টেলিফোন সংযোগও নিরবচ্ছিন্ন থাকে না।
সমাবেশে আসার পথে মুঠোফোন চেক করে পুলিশ। এটা খুবই গর্হিত অপরাধ। বিনা পরোয়ানার পুলিশ কারও মুঠোফোনে গণহারে চেক করতে পারে না। ৫৪ ধারায় করতে পারে, তবে যদি তথ্য থাকে, ওই ব্যক্তি কোনো অপরাধ করতে পারে। কিন্তু গণহারে তল্লাশি করা সংবিধানের ৩৬ ধারার সরাসরি লঙ্ঘন।
এ ছাড়া সারা বছরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে বিরোধী মতের লোকজনের ওপর নজরদারি করা হয়। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ছাড়াও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন নজরদারি পরিচালনা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য বা কোনো কিছু লিখলে, মন্তব্য করলে অবমাননার অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন আটক করে নিয়ে যান।
অনেক সময় আটকের বিষয়টি পুলিশ বা র্যাব স্বীকার করে। কখনো স্বীকার করে না। আবার কয়েকজনকে দীর্ঘ সময় গুম করে রাখার পর আটকের কথাটি স্বীকার করা হয়।
এভাবে নানা কায়দায় রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ উপকৃত হচ্ছে। ইচ্ছেমতো বিরোধী দল ও মতকে দমন করতে পারছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় নিজের অবস্থান অটুট রাখতে পেরেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ দল হিসেবে তার রাজনৈতিক চরিত্র হারাচ্ছে। কারণ, যে কাজ রাজনৈতিকভাবে করা উচিত, আওয়ামী লীগ তা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে করছে। রাজনীতির মাঠে দলটি এখন পুরোপুরিই রাষ্ট্রনির্ভর, আরও পরিষ্কার করে বললে পুলিশনির্ভর দলে পরিণত হয়েছে।