- ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
- ০৫ মে ২০২০
কাণ্ড অনেক ঘটে গেছে, ঘটে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এসব কাণ্ড শুরু হয়েছিল ক্যাসিনো দিয়ে। তা নিয়ে কত যে কথা হয়ে গেল। আমরা সংবাদপত্রের পাতা ভরে রিপোর্ট করতে থাকলাম। একেকজন সম্রাট, তার সহযোগীদের নিয়ে নানা তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করল। শত শত কোটি টাকার কারবার। যুবলীগের সম্রাট ছিল সত্যিকারের সম্রাট। শত শত কোটি টাকা নিয়ে সে সিঙ্গাপুরের জগদ্বিখ্যাত ক্যাসিনোতে জুয়া খেলতে যেত। সেখানে তার ছিল বিশাল খ্যাতি ও প্রতিপত্তি। বিমানবন্দর থেকে তাকে মোটরসাইকেলের বহর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো হোটেলে। সেখানে তার তরুণী-বান্ধবী ছিল। যারা তাকে নিয়মিত সঙ্গ দিত। সম্রাটই ছিল বটে যুবলীগের ওই নেতা।
তিনি শুধু একা নন। যুবলীগে তার সাঙ্গোপাঙ্গরাও ছিলেন শত শত কোটি টাকার মালিক। কারও কারও ছিল (অনেকের সম্ভবত এখনও আছে) সিন্দুকভর্তি টাকা আর কেজি কেজি সোনা। কেউ কেউ কেউ অবৈধভাবে অর্জিত এসব সম্পদ রাখার জন্য ছোট বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন। ভেতরে সিন্দুকে টাকা আর স্বর্ণালঙ্কার। বাইরে ২৪ ঘণ্টার জন্য সশস্ত্র পাহারাদার। ক্যাসিনো চালিয়ে সম্রাট এই শত শত কোটি টাকা আয় করেছিলেন। তা কি তিনি একাই খেয়েছেন? না, সবাইকে দিয়ে থুয়েই খেয়েছেন। মতিঝিল পাড়া থেকে ঢাকার অভিজাত এলাকা, কলাবাগান- সব স্থানেই বিস্তৃত হয়েছিল ক্যাসিনো ব্যবসা।
হাজার হাজার কোটি টাকার নির্মাণ-টেন্ডার বাগিয়ে নিয়েছিলেন সরকারের কাছ থেকে। তিনি যুবলীগের জি কে শামীম। তার বাসভবনে পাওয়া গেছে শত শত কোটি টাকা আর অবৈধ অস্ত্র ও মদ। জি কে শামীমের ছিল তরুণী বাহিনী। তিনি বিভিন্ন প্রভাবশালীকে টাকা তো দিতেন, সাথে দিতেন সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গ। যুবলীগের নেতা জি কে শামীম বলেছেন, একজন প্রধান প্রকৌশলীকেই তিনি দেড় শ’ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন। গণপূর্ত বিভাগের বড় বড় সব টেন্ডার এমনভাবে সাজানো হতো, যেন সেটি জি কে শামীমই পান। এ ঘটনা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ঘটেছে নির্বিঘেœ।
জি কে শামীম বা গোলাম কিবরিয়া শামীম যখন এক কর্মকর্তাকেই দেড় শ’ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন, তা হলে অন্যান্য প্রভাবশালীকে কত টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন, তা সহজেই অনুমেয়। ফলে অতি সঙ্গোপনে হাইকোর্টে ঘটে দু’টি ঘটনা। গত ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ জি কে শামীমকে ৬ ফেব্রুয়ারি অস্ত্র মামলায় ছয় মাসের এবং অপর একটি বেঞ্চ মাদক মামলায় এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন। যদিও গত বছর ২৭ নভেম্বর একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তার জামিন নামঞ্জুর হয়ে গিয়েছিল। জি কে শামীমের জামিন সম্পর্কে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, শামীমের জামিনের খবর তিনি খবরের কাগজ থেকে জেনেছেন। জামিনের তথ্যাদি পর্যালোচনা করে তারা মন্তব্য করবেন। এ দিকে, শামীমের আইনজীবী শওকত ওসমান বলেছেন, এই জামিনের ক্ষেত্রে কোনও জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়নি। যথাযথ শুনানি শেষে হাইকোর্ট তার জামিন মঞ্জুর করেছিলেন।
সম্রাট বা শামীম তো কান মাত্র। টানপড়ায় মাথাও সামনে এলো। সম্রাটরা গ্রেফতার হওয়ার পর বললেন, ক্যাসিনো থেকে বা ঠিকাদারি থেকে তারা যে আয় করেছেন, তার ভাগ দলের ও প্রশাসনের উচ্চ মহলেও বিতরণ করেছেন। একলা খাননি, দিয়ে থুয়েই খেয়েছেন। তার প্রমাণ পাওয়া গেল যুবলীগ সভাপতি সরকারপ্রধানের নিকটাত্মীয় ওমর ফারুক চৌধুরীর ক্ষিপ্ত বক্তব্যে। র্যাব, পুলিশ যখন এসব ক্যাসিনো ক্লাবে অভিযান চালাতে শুরু করল, তখন ওমর ফারুক বলে বসলেন, ‘আপনারা এতদিন কী করছিলেন? বসে বসে আঙ্গুল চুষছিলেন। আমাদের ধরবেন, আমরাও ছেড়ে দেবো না। আমরাও ব্যবস্থা নেবো। এই ক্যাসিনোকাণ্ড সম্ভবত এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া সরকারের শীর্ষ মহলের সামনে আর কোনও পথ ছিল না।
তবে অনুমান করা গিয়েছিল যে, সরকার দলের যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগের এত বড় বড় চাঁই এর সাথে জড়িত যে, তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির দায়ে কোনও ব্যবস্থা নেয়া হবে না। হবে যে না, তার উদাহরণ তো হাতের কাছেই ছিল। এর আগে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে ৮৬ কোটি টাকা ঘুষ দাবি করেছিলেন। এই ঘুষ দাবির আগে তারা ভিসির কাছ থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা নিয়েছিলেন ঈদের বখশিশ হিসেবে। এরপর ছাত্রলীগের সম্মেলনে তাদের পদ গেছে বটে, তবে ঘুষ দুর্নীতির দায়ে কেউ গ্রেফতার হননি বা কারও বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারাও জানতেন, সরকার দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তার পক্ষে ওই নেতাদের বিরুদ্ধে কোনও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে না। ফলে এদের গলা বড় ছিল। পরে পদ অনেকেরই গেছে, কিন্তু তাদের ঘুষ-দুর্নীতি-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আইনগত কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। টাকা তারা মেরেছেন তো কী হয়েছে। পদ গেছে। যা করার তারা তো তা করেই নিয়েছেন। এ দিকে, সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত নাম সম্রাটকে বেশি দিন জেলখানায় থাকতে হয়নি। তিনি এখন বিএসএমএমইউতে আছেন বলে সর্বশেষ খবর।
এরপর আওয়ামী চোঙ্গাবাজদের সে কি দাপট! তারা সারা দিন-রাত ঢেরা পেটাতে থাকলেন যে, শেখ হাসিনা সরকার কোনও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় না, দুর্নীতিবাজদেরও না। নিজ দলের লোকদের বিরুদ্ধেও তিনি কঠোর ব্যবস্থা নেন। সে কঠোর ব্যবস্থা হলো, মাত্র কয়েকজনের লোক দেখানো পদচ্যুতি, দুর্নীতির বিচার নয়। সে রকম বিচার করতে গেলে আওয়ামী লীগের কোনও অস্তিত্বই থাকবে না। সবাইকে নানা মেয়াদে সাজা দিয়ে জেলে ঢোকাতে হবে। তাই কি হয়! আর সে কারণেই ক্যাসিনোকাণ্ড আস্তে আস্তে ফিকে হতে হতে এখন আর আলোচনায় নেই। হাওয়ায় উড়ে গেছে। ধারণা করি, আওয়ামী আমলে আর ক্যাসিনোকাণ্ডের বিচার হবে না।
ওমর-ফিরোজ-পঙ্কজদের ঘটনা আস্তে আস্তে পেছনে পড়ে গেল। এর মধ্যে সামনে এলো বালিশকাণ্ড, পর্দাকাণ্ডসহ আরও নানান কিসিমের দুর্নীতি। যখন এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তখন আওয়ামী চোঙ্গাবাজরা চুপ হয়ে যান। তখন তারা একটি টেকনিক্যাল ভাষা ব্যবহার করেন। আর সেটা হলো, অপরাধী যেই হোক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বাংলাদেশে এর অর্থ হলো, ব্যাপারটা শেলফে তুলে রাখা হলো। এরপর সাড়া জাগানো ঘটনা ঘটল নরসিংদীর মহিলা দলনেত্রী পাপিয়াকে নিয়ে। নব্য বিত্তবান, উঠতি ব্যবসায়ী, তরুণ এমপি, সরকারের প্রভাবশালী আমলাদের মনোরঞ্জনের জন্য তিনি গড়ে তোলেন এক মধুকুঞ্জ। ক্লায়েন্টের আর্থিক সঙ্গতির কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন মানের বাসা ছিল তার। পাঁচতারকা হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুট থেকে শুরু করে, ইন্দিরা রোড বা শ্যামলী এলাকায় তার ছিল নিরাপদ ফ্লাট। তার ক্লায়েন্টদের মনোরঞ্জনের জন্য দেশীয় সুন্দরী তরুণীরা ছাড়াও থাই ও রাশিয়ার মেয়েদের নিয়ে আসতেন তিনি। প্রধানত গুলশানের একটি পাঁচতারকা হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুট তিনি বুকিং দিতেন মাসের পর মাসের জন্য। কোনও কোনও দিন ওই হোটেলে এক দিনেই তিনি মদের বিল দিয়েছেন আড়াই লাখ টাকা। স্যুট ভাড়া দিয়েছেন কোটি টাকা। হোটেলের মালিকও আওয়ামী লীগার। ক্লায়েন্টরা যখন রুমে যেতেন, তখন পাপিয়া লাঠি হাতে বাইরে বসে থাকতেন। কোনও মেয়ে অসহযোগিতা করলে তাকে দেয়া হতো কঠোর শাস্তি। কোনও কোনও মধুকুঞ্জে ক্লায়েন্ট ও মেয়েদের নিয়ে যেতেন মধ্যরাতে। থাকতেন সকাল পর্যন্ত। তিনি এমপি হতে চেয়েছিলেন। তার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করেছেন। মহিলা দলের নেত্রীসহ দলের সর্বস্তরের নেতাদের সাথে ছিল তার ওঠা-বসা। তার স্বামী ব্যাংককে বার-ডিসকো স্পার ব্যবসা করতেন। সে সূত্রে সেখান থেকে নিয়ে আসা হতো থাই ও রাশিয়ার তরুণীদের। আর এসব কাণ্ডের গোপন ভিডিও করে তা দিয়ে ব্ল্যাকমেইলও করতেন পাপিয়া।
পাপিয়ার ঘটনা ও উত্থান নিয়ে মিডিয়ায় নানা ধরনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবেই তার ক্লায়েন্টদের ব্যাপারে তেমন কোনও খবর প্রকাশ পায়নি। পাপিয়া যদি নারী সরবরাহকারী হিসেবে দোষী হয়ে থাকেন, তবে তার ক্লায়েন্টরাও সমান দোষী। কিন্তু প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে তারা প্রভাবশালী বলে তাদের পরিচয় প্রকাশ হবে না- এটাই ছিল স্বাভাবিক। ফলে পাপিয়া ও তার স্বামীকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল। ওই পর্যন্তই। ক্লায়েন্টরা আছেন নিরাপদেই। পাপিয়ার ক্লায়েন্টদের ব্যাপারে যখন আভাস পাওয়া গেল, তখনই বোঝা যাচ্ছিল যে, শেষ পর্যন্ত পাপিয়াকাণ্ড আর বেশি দূর এগোবে না। এগোয়নি। তার মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতি দিয়ে পাপিয়া সম্পর্কিত খবর প্রকাশে সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানায়। সবাই বোঝেন, সে আহ্বান উপেক্ষা করার শক্তি বা ইচ্ছা কোনও মিডিয়ারই নেই। প্রথমত, সব সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিক সরকারি দলের লোক। যা-ও অতি সামান্য ব্যতিক্রম আছে, তারাও থাকেন কম্পমান। ফলে চাপা পড়ে গেছে পাপিয়াকাণ্ড।
ক্যাসিনো বা পাপিয়াকাণ্ড আমার আজকের লেখার ভূমিকা। আমি আসলে লিখতে বসেছি সরকারি লোকদের সেবা প্রদর্শনী নিয়ে। কিছু দিন আগে ঢাকায় রাস্তা ঝাড়– দেয়ার টিভিশোর আয়োজন দেখেছিলাম। সামনে একজন মন্ত্রী বা এমপি, দামি পোশাক-আশাক, গগলস। হাতে ঝাড়–। কিন্তু রাস্তায় ময়লা নেই। কী ঝাড়– দেবেন? তখন সুইপার দিয়ে ময়লা এনে ফেলা হলো। তারপর ভিআইপি ব্যক্তিরা এমনকি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পাশে নিয়ে ঝাড়– দেয়ার অভিনয় করলেন। ডজন ডজন টিভি ক্যামেরা। তারা ঝাড়– দেয়ার অভিনয় রেকর্ড করলেন। ক্যামেরা অন, মিনিট কয়েক। তারপর অভিনয় পর্ব শেষ। ক্যামেরা বিদায়। এলাকা জনজটমুক্ত। সরকারি মন্ত্রী-এমপিরা এভাবেই দুর্যোগের দিনে লোক হাসান।
সর্বশেষ তারা লোক হাসালেন কৃষকের ধান কাটা নিয়ে। হাওর এলাকায় ধান পেকেছে। কাটতে হবে। কিন্তু শ্রমিক নেই। শ্রমিক নিয়ে আসার যানবাহন নেই। তার মধ্যে আছে করোনার ভয়। শেষ পর্যন্ত শ্রমিক পাঠানোর ব্যবস্থা হলো। তারপর এলেন মন্ত্রী-এমপিরা। তারা কাঁচি হাতে ধান কাটার অভিনয় শুরু করলেন। সুন্দর পোশাক, দামি শাড়ি পরে তারা এলেন ধান কাটতে। তাদের সাথে এলো একদল সমর্থক। তারা কেটে ফেলল কৃষের কাঁচা ধান। যারা দু’চার গুচ্ছ পাকা ধান কাটল, তারাও তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখল এখানে-সেখানে। কৃষক হতাশ মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, ওনারা কাটলেন আমার কাঁচা ধান। আর দু’এক গুচ্ছ পাকা ধান ছড়ানো-ছিটানো। কৃষক বললেন, এসব ধান গোছাতেও তার অনেক সময় লাগবে। কারণ রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হলো সারা। ক্যামেরা অফ। মন্ত্রী-এমপিদের বিদায়। এই নাটক আর কতকাল!
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com