রাজা কেন কিভাবে এবং কখন ভিখিরি হয়ে যান
- গোলাম মাওলা রনি ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০
ভারতবর্ষের মতো প্রায় একই সমস্যা হয়েছিল তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের কয়েকজন নামকরা সুলতানেরও। সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট, সুলতান তৃতীয় সেলিম এবং তৃতীয় মুরাদের মতো ইতিহাস বিখ্যাত শাসকদেরও অর্থসঙ্কটে নাস্তানাবুদ হয়ে ইহুদি বেনিয়া, ইউরোপের খ্রিষ্টান ব্যবসায়ী এবং নিজ দেশের ধড়িবাজ সুদের কারবারিদের ফাঁদে পড়তে হয়েছিল। অন্য দিকে ফ্রান্সের সম্রাট চতুর্দশ লুইকে অর্থসঙ্কটের কারণে ইতিহাস বিখ্যাত ফরাসি বিপ্লবর কবলে পড়ে পরাজিত এবং পরিবার পরিজনসমেত অত্যন্ত নির্মমভাবে পতিত হতে হয়েছিল।
আমি আমার নিজের অর্থবিত্ত-ব্যবসাবাণিজ্যের সম্ভাবনা ও সঙ্কট নিয়ে যেমন ভাবি তেমনি পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, সমাজ-সংসার ও রাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে বিস্তর চিন্তাভাবনা করি। কারণ বর্তমান জমানায় কোনোভাবেই কেউ একা ভালো থাকতে পারেন না বা পারবেন না। সমাজে যদি দুর্ভিক্ষ এবং দুর্বৃত্তপনা দেখা দেয় তবে সচ্ছল এবং নিরীহ প্রকৃতির মানুষেরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন। দুর্ভিক্ষের সময় রাষ্ট্রক্ষমতা, বন্ধুকের গুলি কিংবা জনবল কোনোটাই কাজে লাগে না বরং হিতে বিপরীত হয়ে পড়ে। কারণ ক্ষুধাপীড়িত মানুষের সব ক্ষোভ গিয়ে পড়ে প্রাসাদের মধ্যে বসবাসরত হিম্মতওয়ালা কিংবা হিম্মতওয়ালিদের ওপর। সমাজের এই চিরাচরিত প্রাকৃতিক নিয়মের ভয়াবহতার কবলে যারা পড়েছেন কেবল সেই ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন কত ধানে কত চাল এবং কোন চালে কী ধরনের পিঠা-পায়েস তৈরি হয়।
আমি যাতে দুর্ভিক্ষ আঁচ করতে পারি সে জন্য প্রায়ই প্রান্তিক মানুষ অর্থাৎ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সাথে একান্তে মেলামেশা করি। তাদের আয়রোজগার খাবার-দাবার হাসি-কান্না, প্রেম-ভালোবাসা এবং অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার চেষ্টা করি। অন্য দিকে, সমাজের ধনিক শ্রেণীর বেলাল্লাপনা, নির্দয়তা, উল্লাস, অশ্লীলতা এবং নীচতার ব্যারোমিটারের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করি আর্থিক সঙ্কটের ধরন ধারণ ও প্রকৃতি। এ ব্যাপারে সাধারণ নিয়ম হলো অর্থনীতি যখন ভালো অবস্থায় থাকে তখন ধনীরা খুব ব্যস্ত থাকেন, তাদের মেজাজ-মর্জিও চমৎকার অবস্থায় থাকে। ভালো কর্ম, দান-সদকা ইত্যাদিতে দরাজ দিল হয়ে পড়েন। অন্য দিকে, মন্দ অর্থনীতিতে এই শ্রেণীটি দাম্ভিক, অহঙ্কারী ও কৃপণ হয়ে পড়ে। তাদের চরিত্রের সব মন্দ দিক বের হয়ে পড়ে। তাদের মুখ থেকে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক হাসি চলে যায়। তারা অহেতুক হাসি-তামাশার জন্য অঢেল অর্থ ব্যয় শুরু করে এবং প্রায়ই বেসামাল কথাবার্তা আচরণ ও কর্মকাণ্ডে নিজেরা বেঁচে আছেন এমনটি প্রমাণের জন্য নিরন্তর চেষ্টা করতে থাকেন।
সমাজে যদি অর্থনৈতিক সঙ্কট প্রবল হয় তবে দরিদ্র জনগণ বেপরোয়া এবং বেয়াদব হয়ে পড়ে। তারা ছোট মুখে বড় বড় কথা বলতে আরম্ভ করে এবং বড় বড় অপরাধের সাথে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজন জড়িয়ে পড়ে। তারা ধনীর দুলালীদের অপহরণ ও ধর্ষণের মতো কুকর্মের স্বপ্ন দেখে এবং ধনীদের বাড়িঘরে ঢুকে লুটপাট করার কথা ভাবে। তারা ধনীদের মারধর করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে এবং নিজেদের স্বাভাবিক কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে অলস হয়ে পড়ে। তাদের মেজাজ-মর্জি ও স্বভাবে হঠাৎ করে রাগচালের আলামতগুলো ফুটে ওঠে। তারা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে সারাক্ষণ খিস্তিখেউড় করে এবং সব সময় নিজেকে নির্দোষ এবং অন্যকে পাপী বলে জ্ঞান করতে থাকে। তাদের শরীরের ক্ষুধা এবং কামভাব মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। ফলে চলনে বলনে তারা বেসামাল হয়ে পড়ে।
সমাজের বুদ্ধিমান শ্রেণীটি অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় বোবা এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তাদের চিন্তাশক্তিতে ঘুণ পোকার আক্রমণ প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে তারা বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা বন্ধ করে দেয়। দেশ-জাতি রসাতলে গেলেও তারা দু’কলম লেখে না অথবা দেশ জাতির কল্যাণে সত্য কথা বলে না। একধরনের আত্ম প্রবঞ্চনা, মৃত্যুভয় অথবা বেইজ্জতি হওয়ার ভয় তাদের সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ায়। ফলে মানুষের চিন্তার রাজ্যে রীতিমতো দুর্ভিক্ষ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় হঠাৎ নিত্যনতুন ভুয়া বুদ্ধিজীবীদের উত্থান হয়, যাদের কারণে এমন সব আজগুবি চিন্তা, তথ্য, তত্ত্ব, কথাবার্তা এবং আচার অনুষ্ঠানের বন্যা বইতে আরম্ভ করে যা কি না সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তি, হতাশা, ক্ষোভ-বিক্ষোভ এবং যন্ত্রণার প্রান্তসীমায় নিয়ে যায়। চার দিকে শব্দ সন্ত্রাস, বাক্য সন্ত্রাস, তথ্য সন্ত্রাস ইত্যাদি ঘটিয়ে প্রকৃত সত্যের কবর রচনা করা হয়।
দেশ ও রাষ্ট্রে যখন অর্থনৈতিক সঙ্কট সর্বগ্রাসী ভাইরাসরূপে জীবন-জীবিকার প্রতিটি স্তরে আক্রমণ করে বসে ঠিক তার আগে মানুষের মন থেকে মায়া-দয়া উঠে যায়। মানুষের বিবেক বলতে কিছু থাকে না। কিছু মানুষের কর্মকাণ্ড বিষাক্ত কীটপতঙ্গ অথবা হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের মতো হয়ে যায়। নির্ভরতা, বিশ্বাস-আস্থা অথবা শ্রদ্ধা-ভালোবাসার মতো পরিবেশ-পরিচিতি থাকে না। সমাজ থেকে সুবচন উঠে যায়, অশ্লীল গালিগালাজ-অঙ্গভঙ্গি এবং বেহায়াপনা নিদারুণভাবে জনপ্রিয় হয়ে পড়ে। চরিত্রহীন মানুষগুলো চরিত্রের সার্টিফিকেটের মালিক বনে যায়। সবচেয়ে বড় চোরকে দায়িত্ব দেয়া হয় আমানত রক্ষার, ধর্ষণকারীরা নারীর ইজ্জতের জিম্মাদার বনে যায়। কুলটা রমণীরা সাধারণ নারীদের কাছে আকর্ষণীয়া হয়ে ওঠে। দুশ্চরিত্র নারী-পুরুষের গলা লম্বা হয়ে যায়। তারা বড় বড় নীতিকথা আওড়াতে থাকে এবং সেগুলো শোনার জন্য লোকজন ভিড় করতে থাকে।
অর্থনৈতিক মহাসঙ্কটের প্রাক্কালে বাজারব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। দ্রব্যমূল্য, দ্রব্যের সরবরাহ ইত্যাদি সব কর্মে ভানুমতির খেল শুরু হয়ে যায়। বাজারভর্তি পণ্য থাকে কিন্তু ক্রেতার অভাবে সেগুলো বিক্রি হয় না। ফলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা নিঃস্ব হতে হতে একসময় দেউলিয়া হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে না পেরে শারীরিক ও মানসিক দৈন্যে ভুগতে থাকে। তাদের শরীরে পুষ্টির অভাব দেখা দেয় এবং মনের মধ্যে হীনম্মন্যতা দিনকে দিন প্রকট হতে থাকে। ফরে পুরো জাতিগোষ্ঠীর বিরাট অংশ ধীরে ধীরে অনুৎপাদনশীলতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।
মানুষের সঞ্চয় করার সাধ মিটে যায় অথবা ধনসম্পদ সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করার চিরন্তন মানবিক রূপটি নষ্ট হয়ে যায়। মানুষ যখন বুঝতে পারে যে তার কষ্টার্জিত অর্থ দেশের কোথাও নিরাপদ নয়, তখন সে অপরিকল্পিত বিনিয়োগ করে নতুবা ভোগ-বিলাসে অপব্যয় আরম্ভ করে দেয়। মানুষের মধ্যে ঋণ করার বা ঋণ দেয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। যারা ঋণ নেয় বা ধারকর্জ করে তারা অভিনব ও জাদুকরী প্রতারণার ফন্দি-ফিকির আবিষ্কার করে এবং লোকজনকে অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে তাদের সর্বস্ব লুট করে নেয়। অন্য দিকে যারা সারা জীবন পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করেছে এবং সঞ্চয় গড়ে তুলেছে তারা অবস্থার প্রেক্ষাপটে অলস-লোভী ও স্থবির হয়ে পড়ে। ফলে প্রতারকরা খুব সহজেই এসব সঞ্চয়ধারীদের অর্থবিত্ত কুক্ষিগত করার সুযোগ পায়।
উল্লিখিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে ঠগ, বাটপাড়, লুটেরা এবং ধুরন্ধররা সমাজের বাবা-মারূপে আবির্ভূত হয়। সব ক্ষমতার কেন্দ্রে এসব লোকের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। বিচারের জন্য নিভৃতে কাঁদতে আরম্ভ করে এবং সুশাসন জঙ্গলে চলে যায় ও জংলি আইনকানুন সমাজে চালু হয়ে যায়। অন্যকে আঘাত করা, প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা এবং সব কিছুতেই আমিত্বের নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়; যার পরিণামে জীবন-জীবিকার সর্বস্তরে দারিদ্র্য মারাত্মকভাবে আঘাত হানতে আরম্ভ করে।
এখন প্রশ্ন হলো- এসব কেন হয়! অথবা আলোচনার শুরুতে যেটি বলেছিলাম অর্থাৎ সব রাজা-বাদশাহ সিংহাসনে বসে রাজার মতো জীবনযাপন না করে কেন ভিক্ষুকের মতো অভাবী এবং সাহায্যপ্রার্থী হতে বাধ্য হয়েছিলেন।
সমাজবিজ্ঞানীদের বহু যুগের গবেষণার ফল হলো কারো উত্থান-ক্ষমতায় আরোহণ এবং কর্মকাণ্ডের মধ্যে যদি অবৈধতা থাকে, নীতিহীনতা থাকে, অপরাধ থাকে অথবা অসৎ উদ্দেশ্য থাকে তবে তার আশপাশে অবশ্যই পাপী-তাপী, অপরাধী এবং নিকৃষ্ট লোকের সমাবেশ ঘটবে। লোকটি হোক সে পরিবারপ্রধান অথবা সমাজের নেতা কিংবা রাষ্ট্রের কর্ণধার তাতে কিছু আসে যায় না- তার ক্ষেত্রে অবশ্যই নিয়তির আইন এবং প্রকৃতির স্বাভাবিক কার্যকারণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রযোজ্য হতে থাকবে। তিনি যদি খুব বেশি জ্ঞানী-গুণী-ধার্মিক হন অথবা খুবই জঘন্য প্রকৃতির হন তাতে পরিস্থিতির হেরফের হয় খুব অল্প। অর্থাৎ সর্বাবস্থায় তার উত্থান-ক্ষমতা লাভ অথবা ক্ষমতা পরিচালনার নেপথ্যের অবৈধতা তাকে তাড়া করতে থাকে।
আমরা যদি উপরিউক্ত নীতিমালার বাস্তব প্রয়োগ- কিভাবে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা, সম্রাট আওরঙ্গজেব, সুলতান সুলেমান প্রমুখ রাজা-বাদশাহদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়েছিল তা ইতিহাসের নিরিখে পর্যালোচনা করি তবে সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবো। যুগে যুগে বিভিন্ন দেশ-জাতি-সমাজ কিংবা সংসারে যে অর্থনৈতিক বিপত্তি ঘটে যা কিনা মানুষকে ভিখিরি বানিয়ে ছাড়ে এবং সব কিছুকে তছনছ করে দেয় সেসবের মূলে প্রধান কারণটি হলো অবৈধ উত্থান-বেআইনি অস্তিত্ব এবং নীতিহীন কর্মকাণ্ড যা একের পর এক বিপত্তি ঘটিয়ে মানুষের জীবনকে জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়ে এবং চূড়ান্ত পতনের মধ্য দিয়েই কেবল এই ভয়ঙ্কর নিয়তি থেকে মুক্তি লাভ করা যায়।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য