- পাইকিয়াসোথি শ্রাবনামুত্তু
- ২৮ মে ২০২২, ২০:১৩
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী শপথ গ্রহণ করেছেন। বিরোধী সংখ্যালঘু ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি থেকে রনিল বিক্রমাসিংহে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই শপথ নিয়েছেন। চার দশকের দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে তিনি এই পদে থেকে আরো কয়েকবার দায়িত্ব পালন করেছেন।
স্বাধীনতার পর থেকে দ্বীপরাষ্ট্রটির সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সঙ্কটের ফলে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভের মধ্যে পার্লামেন্ট স্পষ্টভাবে মনে করে যে, জাহাজ তথা রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করতে এটি একটি নকশা বা চিত্র। কিন্তু প্রতিবাদকারীদের প্রধান এবং অব্যাহত দাবি কলঙ্কিত ও আস্থাহীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবি মেনে না নিয়ে এটি নিছক ‘টাইটানিকের ডেকচেয়ার পুনর্বিন্যাস’ করা।
কলম্বো একটি টিন্ডার বক্স বা স্ফুলিঙ্গের বাক্সে পরিণত হয়েছে। দেশটি দেউলিয়া হয়ে পড়েছে, সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের তীব্র ঘাটতি ও মানবিক সঙ্কট চলছে। যেকোনো মুহূর্তে স্বতঃস্ফ‚র্ত প্রতিবাদ বিক্ষোভ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে। কারণ জীবনযাত্রার মৌলিক উপাদানগুলোর জন্য মানুষ মুখিয়ে আছে। ক্রমবর্ধমানভাবে অভিন্ন সাধারণ ধর্মঘটের ডাকে লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে এলে দেশ অচল হয়ে পড়বে। জনগণ ৭০ বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে খারাপ অর্থনেতিক সঙ্কটের জন্য প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার দুর্বোধ্য ও অশুভ শাসনকে দায়ী করেছে। কয়েক মাস ধরে তার পদত্যাগের জন্য জনগণ দাবি জানালেও রাজাপাকসে কানে তুলো দিয়ে বধিরের মতো আচরণ করেছেন এবং ফলে অনিবার্যভাবে দেশের অচলাবস্থা মারাত্মক হয়ে উঠেছে।
তার ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগ বিক্ষোভকারীদের শান্ত করতে তেমন কোনো কিছু করতে পারেনি। যদি কিছু হয়, শেষ পর্যন্ত তিনি যেভাবে চলে গেলেনÑ এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে, তার সে ধরনের আচরণ আমাদের এ সঙ্কটের দিকে নিয়ে গেছে, তার পদত্যাগের দাবিতে কয়েক মাস ধরে চলা বিক্ষোভকে অবিশ্বাস্যভাবে প্রত্যাখ্যান করে তার সরকারি বাসভবনের বাইরে তিনি সমর্থকদের সমাবেশ করেন। শেষ রক্ষা হলো না। অবশেষে তিনি দ্বীপের অপরপ্রান্তে একটি সামরিক ঘাঁটিতে পালিয়ে গেলেন। একটি আদালত এখন তাকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তিনি বলেছেন, তিনি ঐক্য সরকার গঠন করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বেরিয়ে যাওয়ার পথে তিনি ভয়ানক বীজ বপন করেছিলেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী যদিও হয়তো সরাসরি সহিংসতার আহŸান জানাননি, কিন্তু তার সহযোগীরা দ্রæত বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর চড়াও হয়, উসকানিমূলক বক্তব্য দেয় এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার জন্য তাদের তাঁবুর ছাউনির ওপর সহিংস ও বেপরোয়া হামলা চালায়। লোহার রড দিয়ে বিক্ষোভকারীদের নৃশংসভাবে পেটায়। প্রধানমন্ত্রীর ইন্ধনেই এসব হামলা চালানো হয়। এরপর বিরোধী দলগুলো ক্ষিপ্ত হয়ে পাল্টা জবাব দেয়। তারা বাস উল্টে দেয় এবং সরকারপন্থী রাজনীতিবিদদের সহায় সম্পদে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেয়। এতে ৯ জন নিহত ও দুই শতাধিক আহত হয়। পরবর্তী দিনগুলোতে দেশব্যাপী কারফিউ জারি এবং লুটেরা ও দাঙ্গাবাজদের প্রতি সেনাবাহিনীকে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেয়ায় পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে।
খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষ হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে। শ্রীলঙ্কা এখন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বের দ্বারস্থ হচ্ছে। কিন্তু এমনকি সে প্রক্রিয়াও ব্যাহত হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তারা জরুরি অর্থসহায়তার বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাথে বৈঠক করবেন। দেশটির বৈদেশিক রিজার্ভ সর্বশেষ ৫০ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। যেকোনো মূল্যে জরুরি সহায়তা প্রয়োজন। আমাদের আইএমএফ কথোপকথনকারীদের অবশ্যই জেনে রাখা প্রয়োজন যে, পার্লামেন্টে যে দলটির একটিমাত্র আসন আছে সেই দল থেকে একজনকে দ্রæত প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার জনগণের ক্ষোভ প্রশমিত হবে না, কারণ দেশের চলমান বিশৃঙ্খলা ও অচলাবস্থার কেন্দ্রবিন্দু, প্রেসিডেন্ট এখনো তার জায়গায় বহাল তবিয়তে রয়ে গেছেন।
অনিবার্য কঠোর আর্থিক ত্যাগের মাধ্যমে দেশকে একটি লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য একজন সম্মানিত ও বিশ্বাসযোগ্য নেতা এ মুহূর্তে বড়ই প্রয়োজন; অন্যথায় জনগণ এসব সহ্য করবে না। রাজাপাকসেকে অবশ্যই চলে যেতে হবে। অন্যান্য পথে অগ্রসর হলে দেশ আরো অস্থিতিশীল ও সহিংসতায় নিমজ্জিত হবে। রাজাপাকসে উপাধিসহ (নামধারী) আরো তিনজন মন্ত্রী এরই মধ্যে গত মাসে পদত্যাগ করেছেন। প্রতিবাদকারীরা শুধু তাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, তারা দীর্ঘকাল ধরে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত গোষ্ঠী দ্বারা শাসিত হয়েছে এবং এখন অবশ্যই তাদের কেউ আর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। জনগণের ব্যাপক সমর্থনপুষ্ট প্রতিবাদকারীরা কেবল প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ চান না। তারা তার অব্যাহত স্থাপনা, দুর্নীতি এবং কয়েক দশক ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ন্যায্য বিচার ও জবাবদিহিতার দাবি জানাচ্ছেন। তারা একটি নতুন শ্রীলঙ্কা চানÑ তারা শুধু বাসি পুরনো কার্ডের রদবদল চান না। কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে এ ধরনের একটি পুনর্বিন্যাস পুরনো নেতাদের এখনো একই জায়গায় বহাল রেখে করা যাবে না। রাজনীতিবিদদের অবশ্যই এমনকি রাজাপাকসেকে ইমিউনিটি বা রেহাই দেয়া বা মাফ করে দেয়ার ধারণার বিষয়টি মেনে নেয়ার ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। জনগণ এটিকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখবে।
গোতাবায়া রাজাপাকসে যত বেশি সময় ক্ষমতায় থাকবেন, আইএমএফের বেইল আউট নিয়ে আলোচনায় যত বিলম্ব হবে, তত বেশি মানুষ না খেয়ে বা ক্ষুধার্ত থাকবে। যত বেশি মানুষ অনাহারে থাকবে, তাদের বিক্ষোভ ততই অব্যাহত ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে, যত বেশি অস্থিরতা রাজাপাকসের তত বেশি সহিংসতার আশ্রয় নিতে পারেন এবং তাতে তার ঝুঁকিও আরো বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু সরকার এ নিশ্চয়তা দিতে পারে না যে, পুলিশ ও সেনাবাহিনী এ আন্দোলনের জন্য সরকারি নির্দেশ মেনে চলবে। কারণ মোটের ওপর একজন সাধারণ সৈনিক ও পুলিশ সদস্যের পরিবারও একই রকম অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। দুর্গে ফাটল দেখা দিচ্ছে। আমরা কেবল আশা করতে পারি যে, অনিবার্য পতন আমাদের সবাইকে ধ্বংস করবে না।
আলজাজিরার সৌজন্যে
ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
লেখক : সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভের নির্বাহী পরিচালক, প্রতিষ্ঠাতা