
মূলত এবং মুখ্যত নব্বইয়ের দশকেই বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণে ঊর্ধ্বমুখী অগ্রযাত্রা শুরু। ১৯৯১-এর শুরুতে প্রথম তত্ত¡াবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে। বাংলাদেশে ট্রেডিং-নির্ভরতা থেকে উৎপাদনমুখী অর্থনীতির নবযাত্রা শুরু হয় সেখান থেকেই। প্রথম বছরেই মূল্য সংযোজন কর আইন পাস ও প্রবর্তিত হয়। ’৯২ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লোকবল ও কর্মকাঠামোয় প্রথম সম্প্রসারণ ও সংস্কার আনা হয়। সে সময় বাংলাদেশে ব্যবসায়-বাণিজ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় নতুন উদ্যম নতুন উদ্যোগ সংযোজিত হওয়ায় অর্থনৈতিক খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটে, এ দশকেই তিনবার (১৯৯২, ১৯৯৬ ও ১৯৯৯) ঘোষিত হয় সংশোধিত শিল্পনীতি। ১৯৯৩ সালে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন গঠন, প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড প্রতিষ্ঠা, সাউথ এশিয়ান প্রিফারেন্সিয়াল ট্রেড অ্যারেঞ্জমেন্ট (সাফটা) চুক্তি স্বাক্ষরিত এবং ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন অ্যাক্ট পাস হয়। ১৯৯৪ সালে প্রথম সেলুলার ফোন পদ্ধতি চালু, ১৯১৩ সালের কোম্পানি আইন প্রথম সংশোধন, টাকাকে চলতি হিসাবে লেনদেনের জন্য রূপান্তরযোগ্য ঘোষণা, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অর্থতহবিলের ৮ নম্বর আর্টিকেলের মর্যাদা লাভ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ও বিধিমালা জারি হয়। ১৯৯৫ সালে ইন্টারন্যাশরাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ইন বাংলাদেশ (আইসিসিবি) গঠিত হয় এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ চালু হয়। ১৯৯৬ সালে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে পাওয়ার সেল গঠন, গ্যাসাধার বিধিমালা জারি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা, প্রাইভেট এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন আইন পাস, প্রাইভেট পাওয়ার জেনারেশন পলিসি ঘোষণা হয়।
নব্বই দশকের প্রথমার্ধে ব্যবসায়-বাণিজ্য বিনিয়োগ উৎপাদন তথা আর্থিক খাতে যুগোপযোগী আইন প্রবর্তন, নীতি-নিয়ম-পদ্ধতিতে পরিবর্তন ও সংস্কার সাধিত হওয়ার ফলে রাজস্ব আহরণের উপায়ে উন্নতি দৃশ্যগ্রাহ্য হয়। মূসক আইন প্রবর্তনসহ বেশ কয়েকটি রেগুলেটরি সংস্থা প্রতিষ্ঠার ফলে কর রাজস্ব আহরণের প্রকৃতি বিস্তৃত হয় ও সার্বিক রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৭-৮৮ সালে জিডিপি ৫৯৭ বিলিয়ন থেকে ১৯৯২-৯৩ সালে ১২৫৪ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ২০০২ বিলিয়ন টাকায় উন্নীত হয় এ দশকেই। ভোগ জিডিপির রেশিও ১৯৮৭-৮৮ সালে সেখানে ছিল ৯৭ শতাংশ, ১৯৯২-৯৩ সালে তা ৮৭ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ৮২ দশমিক ৬০ শতাংশে নেমে আসে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, জাতীয় সঞ্চয় ও জিডিপির অনুপাত ১৯৮৭-৮৮ সালে ১০ দশমিক ৭০ থেকে ১৯৯২-৯৩ সালে ১৮ দশমিক ০ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ২১ দশমিক ৮০-তে উন্নীত হয় এবং মোট বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাত ১৯৮৭-৮৮ সালে ১১ দশমিক ৮০ থেকে ১৯৯২-৯৩ সালে ১৭ দশমিক ৯০ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ২১ দশমিক ৬০-তে উন্নীত হয়। এর প্রভাবের প্রতিফলন ঘটে রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতিতে। ১৯৮৭-৮৮ সালে এনবিআর অর্জিত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ যেখানে ছিল ৩৯ দশমিক ৫০ বিলিয়ন টাকা, ১৯৯২-৯৩ সালে তা ৮৬ দশমিক ৪০ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ১৩৮ বিলিয়ন টাকায় বৃদ্ধি পায়। কর রাজস্ব আয় ও জিডিপির অনুপাত ১৯৮৭-৮৮ সালের ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ থেকে ১৯৯২-৯৮ সালে ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে তা ৯ দশমিক ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়। এর পর অবশ্য কর জিডিপি ও রেশিও আর তেমন বাড়েনি, বরং কমেছে। এর অর্থ হলো অর্থনীতিতে আয় ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও কর রাজস্ব আয় সমানুপাতিক হারে বাড়েনি। সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু (এপিসেন্টার) সেখানেই।
নব্বইয়ের দশক থেকেই বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৮৭-৮৮ সালে আমদানির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৯৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ১৯৯২-৯৩ সালে তা তিন হাজার ৯৮৬ মি: মা: ড: এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে সাত হাজার ৫৪৫ মি: মা: ড:-এ পৌঁছায়। অন্য দিকে যে রফতানি ১৯৯৭-৯৮ সালে এক হাজার ২৩১ মি: মা: ড:, ১৯৯২-৯৩ সালে তা প্রায় দ্বিগুণ দুই হাজার ৩৮৩ মি: মা: ড: এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে রেকর্ড পাঁচ হাজার ১৬১ মি: মা: ড:-এ দাঁড়ায়। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের অতি প্রাগ্রসরমান এ তথ্য-উপাত্ত পরিসংখ্যান নির্দেশ করে একটি দ্রুত গতিশীল অর্থনীতির এবং সেই সাথে সৃষ্টি হয়, বৃদ্ধি পায় আমদানি শুল্ক, আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর আহরণের ক্ষেত্র বিস্তৃতির অবকাশ। কিন্তু প্রণিধানযোগ্য যে, এ দশকে আমদানি-রফতানি শুল্ক ও মূসক তথা কাস্টমস বিভাগে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেলেও আয়কর বিভাগের আয়ে অগ্রগতি সমানুপাতে আসেনি।
বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থাকে একটি স্বয়ংক্রিয় ও যুক্তিযুক্ত ভিত্তি প্রক্রিয়ার ওপর দাঁড় করানোর লক্ষ্যে নব্বই দশকের প্রথমার্ধে গঠনমূলক বেশ কিছু উদ্যোগ গৃহীত হলেও পরবর্তীকালে সে সব প্রয়াস প্রচেষ্টায় যথাযথ ফলোআপ ছিল না। ফলে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে রাজস্ব আহরণ আওতায় আনতে শুধু বেগ পেতেই হয়নি বা হচ্ছে না, এখানে বেশ কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতিও অনুপ্রবেশ করে। শুল্ক হার নিরূপণ নির্ধারণে ট্যারিফ কমিশনের তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তি সরবরাহের প্রশ্নে এনবিআরের সাথে ট্যারিফ কমিশনের মধ্যে সমন্বয়হীনতা বেড়ে যায়, যোগাযোগ হ্রাস পায়। আমদানি পণ্যের সঠিক মূল্য নির্ধারণ ও শুল্কায়নের স্বার্থে প্রাক জাহাজীকরণ ইন্সপেকশন পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকে পড়ে শুল্ক বিভাগ। এখানে বিদেশী ভেন্ডরদের বাংলাদেশে এই কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে এবং তাদের কর্মকাণ্ডে যথেষ্ট অস্পষ্টতা ও অনিয়ম এখানে যুগলবন্ধী হয়ে ওঠে। পিএসআই কোম্পানিগুলোর দায়িত্বহীনতা ও দুর্নীতির মহড়া দেখা যায়। এনবিআরের লোকবল ও কর্মপদ্ধতির উন্নয়ন অভীপ্সায় বিশেষ করে ভ্যালুয়েশন এবং শুল্কায়নে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি প্রয়োগের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং ডিএফআইডির অর্থায়নে বেশ কয়েকটি গুচ্ছ প্রকল্প (যেমন- কাস্টমস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মডার্নাইজেশন বা ক্যাম; এক্সাইজ, কাস্টমস, ট্যাক্সেশন ‘ইটাক’ ডাটা কম্পিউটারাইজেশন) বাস্তবায়নের মহড়া শুরু হয় এ দশকেই। এসব প্রকল্প মেয়াদান্তে শেষ হলেও তাদের রেখে যাওয়া সুপারিশ, প্রবর্তিত পদ্ধতি সফটওয়ার প্রয়োগ বাস্তবায়ন ফলাবর্তনে সব সময় সক্রিয়তা লক্ষ করা যায়নি। বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি ও স্ট্রাকচারাল রিফর্মস প্রোগ্রামের মধ্যে শর্ত (ট্রিগার) আরোপ করে তার বাস্তবায়নে চাপ দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক আইএমএফ বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুসরণেও ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি।
এটি লক্ষণীয়, নব্বইয়ের দশকে অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রসার প্রত্যক্ষ করা গেলেও তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাজস্ব আহরণকারী দফতর এনবিআরের সক্ষমতা ও দক্ষতা সমহারে বাড়েনি বা বাড়ানো হয়নি। অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা সংযুক্ত হলেও তার সাথে বিদ্যমান রাজস্ব আইনগুলো যুগোপযোগী করার কাজে প্রত্যাশিত মনোযোগ ও তৎপরতা একই সমতলে লক্ষ করা যায়নি। বরাবরই সীমিত লোকবল ও সীমাবদ্ধ খাত-ক্ষেত্র থেকে রাজস্ব আহরণে নিবদ্ধ থাকতে হয়েছে এনবিআরকে। একই সাথে উদীয়মান শিল্পকে সুরক্ষা দেয়ার নাম করে, বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণের উপায় ও উপলক্ষ হিসেবে ব্যাপকভাবে কর অবকাশ ও কর রেয়াত দেয়ায় পরবর্তীকালে বিদেশ থেকে ঋণ কিংবা বা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের পরিচালিত মেগা প্রকল্পগুলোতেও রাজস্ব অব্যাহতি দেয়া কাঙ্ক্ষিত ও বাঞ্ছিত কর রাজস্ব আহরণ বাড়েনি; বরং এসব উদ্যোগে করের খাত-ক্ষেত্র বিস্তৃতির পরিবর্তে সঙ্কুচিত হয়েছে। যেকোনো উদীয়মান অর্থনীতিতে শিল্প উৎপাদন বাণিজ্য বিনিয়োগ বিবরে সুরক্ষার নামে প্রথম পর্যায়ে প্রণোদনা ও কর রেয়াত প্রদানের চাপ থাকে, থাকলেও একই সাথে উদীয়মান করদাতাকে করজালের মধ্যে আনার উদ্যোগে তেমন মনোযোগ যথাসময়ে আরোপিত না হওয়াটা বা এ ব্যাপারে ব্যর্থতা বা অপারগ পরিস্থিতি বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক আবহ সৃষ্টি হয়েছে। এনবিআরের সক্ষমতা সে কারণে না বাড়নোর ফলে প্রত্যক্ষ কর আহরণ ব্যবস্থাপনা জোরদার হয়নি, যা পরবর্তীকালে পরোক্ষ করের অগ্রগতি সত্তে¡ও সমতালে বৃদ্ধি পায়নি এবং যা এখনো একমাত্র বাংলাদেশে ব্যতিক্রম, প্রত্যক্ষ কর থেকে অর্জন পরোক্ষ করের তুলনায় কম। ফলে দেশের কর জিডিপি রেশিও সামঞ্জস্যতায় আনা, সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি বা হচ্ছে না। নব্বইয়ের দশকে রাজস্ব আহরণের যে নবযাত্রা শুরু হয় তা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তবে তা থেকে উত্তরণের জন্য তৎকালীন গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সরকারগুলোর যে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাকে আরো গতিশীল রাখার সময়, সুযোগ ও অবকাশ ছিল, এখনো রয়েছে।
প্রভূত পরিসংখ্যান, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও পটভূমিতে আজ এটি স্পষ্ট হচ্ছে যে, বৈষম্য বাড়ছে অনেক ক্ষেত্রে- সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের ও নাগরিকের মধ্যে, করদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে, শিল্পমালিক ও শ্রমিকের মধ্যে, নীতি-নির্ধারকের সাথে পোষণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, উপৎপাদনকারীর সাথে খুচরা ক্রেতার, ব্যাংকের আমানতকারীদের সাথে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার, সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় প্রত্যাশার সাথে আর্থিক খরচে কর্মনৈপুণ্যের, রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার সাথে ব্যয় ব্যবস্থাপনার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সাথে সাধারণ মানুষের। সমাজে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপব্যয়ের জৌলুশের চাকচিক্যের ডামাডোলকে মনে হতেই পারে এটি পুঁজিবাদী মানসিকতা প্রস্তুত এবং বৈষম্যবিলাসী উদাসীন ঊর্র্ধ্বতনদের ইচ্ছা ও অভিলাষ উৎসারিত। এই অগ্রগতি গুণগতমান উন্নয়ন ব্যতিরেকে শিক্ষার পাসের হার বৃদ্ধির মতো সাময়িক তৃপ্তিলাভের অগ্রগতি মনে করা হতো। ভূত ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত করে নয়- সাময়িকভাবে, নিজেদের মতো করে অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সীমিতভাবে সীমাবদ্ধকরণের প্রয়াস উৎসারিত। অর্থনৈতিক বৈষম্য বিভাজন থেকে মুক্তির সংগ্রামে জয়ী একটি স্বাধীন সার্বভৌম অর্থনীতির প্রাণবায়ু যে বৈষম্য দূরীকরণে জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও ন্যায়নীতি-নির্ভরতা, নৈতিক মনোবল ও মূল্যবোধ তার সার্বিক অবস্থান ও উপস্থিতি আপাত প্রাণচাঞ্চল্যে ফিরে আসা।
এই সময় সমাজ ও অর্থনীতিতে কারো কারো অধিকতর ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে আনন্দ সর্বনাশের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ অবশ্যই রয়েছে। সমাজে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা আনয়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনে অর্পিত ক্ষমতা প্রয়োগে প্রতিশ্রুতি (পড়সসরঃসবহঃ) ও দৃঢ়চিত্ততার প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গটিও এসে যায়। যদি রাজস্ব আহরণে নিজেদের অধিক্ষেত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে গোষ্ঠী বা কোটারি স্বার্থে কর্মধারা পরিচালিত হয়, সে ক্ষেত্রে সংস্থাটি কার্যকরভাবে জবাবদিহিমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে অপ্রতিরোধ্য স্বেচ্ছাচার ও স্বচ্ছতার অস্বচ্ছতায় আকীর্ণ হয়ে উঠতে পারে, স্বেচ্ছচারিতার অজুহাত যৌক্তিকতায় সিন্ডিকেট ও স্বজনপ্রীতির পরিবেশ বা ক্ষেত্র তৈরি হয়। এ কৌশলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সৎ ও নিষ্ঠাবানদের কোণঠাসা করা এমনকি বিতাড়িত করার সংস্কৃতি চালু হতে পারে। রাজস্ব আহরণ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা। পাবলিক সার্ভিসে প্রতিটি কর্মকর্তার নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথ পরিপালনের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির সুযোগ থাকা দরকার। যারা নীতি প্রণয়ন করে, নীতি উপস্থাপন করে তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব দৃঢ়চিত্ততা এবং নীতি-নিয়ম পদ্ধতির প্রতি দায়িত্বশীল থাকা আবশ্যক। এর পরিবর্তে তার যদি চাকরি যাওয়ার বা পদোন্নতি আটকে যাওয়ার ভয় থাকলে কোনো বিভাগই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠা পায় না স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার নিশ্চয়তা আসে না। সুশাসন, স্বচ্ছতা-জবাবদিহি প্রয়োজন সবার স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে। কারণ এটি পরস্পরের পরিপূরক। আরেকটি বিষয় নীতিনির্ধারকরা বাস্তবায়নকারীদের দিয়ে, তাদের ভুল বা ব্যত্যয়ধর্মী নীতি বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করিয়ে নিতে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি কিংবা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের নানান সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিয়ে প্রলুব্ধ করতে পারেন, আবার ক্ষেত্রবিশেষে ষড়যন্ত্রের টোপে ফেলে বিব্রত করতে পারেন। ক্ষমতায় থাকার জন্য কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এ ধরনের রাজনৈতিক উৎকোচ কিংবা নিপীড়নের প্রথা প্রাচীনকাল থেকে কমবেশি ছিল বা আছে তা মাত্রা অতিক্রমণের ফলে সেটি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক পরিস্থিতির প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
নানান আঙ্গিকে পরীক্ষা-পর্যালোচনায় দেখা যায়, শিক্ষক-চিকিৎসক-আইনজীবী-ব্যবসায়ী এমনকি নির্বাহী বিভাগকে বাঞ্ছিতভাবে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয় না। অতিমাত্রায় কোটারি, সিন্ডিকেট বা দলীয় বা রাজনীতিকীকরণের কারণে পেশাজীবী, সংস্থা সংগঠন এবং এমনকি সুশীল সেবকদেরও প্রজাতন্ত্রের হয়ে দল-নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে হিমশিম খেতে হয়, গলদঘর্ম হতে হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয় যার ছত্রছায়ায় নানাভাবে অবৈধ অর্জনের পথ সুগম হতে পারে। সেবক প্রভুতে পরিণত হলে সম্পদ আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহারের দ্বারা অর্জিত অর্থ দখলের লড়াইয়ে অর্থায়িত হয়ে এভাবে একটি ঘূর্ণায়মান দুষ্টচক্র তৈরি হয়ে থাকে। সুতরাং সব ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে উচিত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সুশাসন, স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। সত্যিকার উন্নয়ন হবে না। স্বচ্ছতার অস্বচ্ছতায় যে উন্নয়ন হয় তাতে জনগণের সুফল নিশ্চিত হয় না। এ উন্নয়নের কোনো উপযোগিতা বা রিটার্ন নেই। এটি একধরনের আত্মঘাতী ভেল্কিবাজি। চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে অর্জিত নতুন বাংলাদেশে সুশাসন ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে বৈষম্যবিহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন অধরা থেকেই যাবে।
লেখক : অনুচিন্তক