রাজস্ব আদায়ের তুলনায় সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে চলেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যত টাকার রাজস্ব আদায় করছে, তার অর্ধেকের বেশি পরিমাণ অর্থ আবার সরকারকে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ করতে হচ্ছে। প্রতিবছরই সরকারের উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আদায় না হওয়ার কারণে সরকারকে ঋণ করে বাড়তি খরচ মেটাতে হচ্ছে। ফলে রাজস্ব আদায়ের অনুপাতে সরকারের ঋণের হার বাড়ছে, পাশাপাশি বাড়ছে ঋণ পরিশোধের চাপও।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, দেশে কর-জিডিপি অনুপাত এখনো ১০ শতাংশের নিচে। দুই দশক ধরেই কর-জিডিপি অনুপাত পরিস্থিতি ভালো নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর আদায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। জিডিপির আকার যেভাবে বাড়ছে, সেই গতিতে রাজস্ব আদায় বাড়ছে না। জিডিপির তুলনায় কর আহরণের দিক থেকে বিশ্বে যেসব দেশ সবচেয়ে পিছিয়ে আছে, বাংলাদেশ তার একটি।
বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান, চীন, রাশিয়া, ভারতের মতো দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে বেশি ঋণ নেয়। বেশির ভাগ ঋণ নেওয়া হয় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য। আর অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে মূলত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বেশি ঋণ করে সরকার। এ ছাড়া অর্থের বাড়তি চাহিদা মেটাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে এবং বন্ড ছেড়েও টাকা ধার নেওয়া হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে অর্থাৎ ১০ বছর আগে সরকার দেশি-বিদেশি সংস্থা থেকে সব মিলিয়ে ৫৩ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। ওই বছর এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। কিন্তু অনুন্নয়ন ব্যয় মেটাতে ও উন্নয়ন বাজেটে টাকার জোগান দিতে সরকারকে এনবিআরের আয়ের বাইরেও অতিরিক্ত অর্থ ঋণ করতে হয়েছিল, যা ছিল এনবিআরের আয়ের প্রায় ৪৪ শতাংশের সমান। পরের এক দশক সময়ে এই হার শুধু বেড়েছে।
সর্বশেষ গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে সব মিলিয়ে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭২ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। এই অর্থবছরে এনবিআরের আদায় ছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এনবিআর যে পরিমাণ অর্থ আদায় করতে পেরেছিল, খরচ মেটাতে তার তুলনায় অতিরিক্ত আরও ৫৩ শতাংশ অর্থ ঋণ করতে বাধ্য হয়েছিল সরকার।
দেশি-বিদেশি ঋণ কীভাবে চাপ বাড়াচ্ছে—সে বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রাজস্ব আদায় কম এবং ঋণ বেশি নেওয়ার ফলে বাজেটের ওপর চাপ হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশি-বিদেশি ঋণের সুদাসল পরিশোধে যে পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশকে খরচ করতে হচ্ছে, তা রাজস্ব আদায় ও অনুদানের ৭১ দশমিক ৮ শতাংশের সমান। চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে ১০১ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। একটি দেশের যত রাজস্ব আদায় হয়, এর সমপরিমাণ অর্থ যদি ঋণের সুদাসল পরিশোধে চলে যায়, তা হলে উন্নয়ন ও অন্যান্য খরচ চালাতে প্রতিনিয়ত ঋণ নিতে হবে।
জাহিদ হোসেনের মতে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিলে বিনিয়োগের গতি কমে যাবে। আবার বিদেশি ঋণ বেশি নিলে তা সুদাসল পরিশোধ করতে গিয়ে বিদেশি মুদ্রা চলে যাবে। ফলে অর্থনীতির ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এই পরিস্থিতি নিরসনে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর বিকল্প নেই।
এনবিআরের আদায় বেড়েছে আড়াই গুণের বেশি
সরকার প্রতিবছর বাজেটের মাধ্যমে অর্থ খরচ করে থাকে। এই খরচের তিন ভাগের দুই ভাগের বেশি জোগান আসে এনবিআরের রাজস্ব আদায় থেকে। এই সংস্থাই সরকারের জন্য আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এক দশক ধরে সরকারের ব্যয় যতটা বেড়েছে, এই সংস্থা সেই হারে শুল্ক-কর আদায় করতে পারেনি। রাজস্ব আদায়ের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, গত ১০ বছরের মধ্যে কোনো বছরই এনবিআর লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। ২০১৩-১৪ অর্থবছর ছাড়া অন্য কোনো বছরে সংশোধিত লক্ষ্যও অর্জন করতে পারেনি এই সংস্থা।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত এক দশকে এনবিআরের রাজস্ব আদায় বেড়েছে আড়াই গুণের কিছুটা বেশি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে শুল্ক-কর আদায় হয়েছিল ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। পরে তা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। পাঁচ বছরের মাথায় রাজস্ব আদায় ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে আদায় হয় ৩ লাখ ২৫ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। কিন্তু ওই বছরেই রাজস্ব ঘাটতি হয় ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এনবিআরকে প্রতিবছর বিশাল লক্ষ্য দেওয়া হয়। কিন্তু সংস্থাটির সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ তেমন একটা নেই। কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত কয়েক বছরে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হয়নি। তবে আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণে এখন এনবিআরে নানা ধরনের সংস্কার হচ্ছে। এর সুফল আগামী দু-এক বছরের মধ্যে পাওয়া যাবে।
প্রকল্পে বিদেশি ঋণ বেড়েছে তিন গুণের বেশি
সরকারি ঋণের মধ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নেওয়া বিদেশি ঋণ অন্যতম। এতে দেশে ডলারসহ বিদেশি মুদ্রা আসে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ভালো হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া যায়। তবে এ ক্ষেত্রে বড় অসুবিধা হলো, ঋণ পরিশোধ ব্যবস্থাপনা।
গত এক দশকে বছরওয়ারি হিসাবে প্রকল্পের জন্য বিদেশি ঋণছাড় তিন গুণের বেশি বেড়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩০৮ কোটি ডলার ছাড় হয়েছিল। তখন ডলারের দর ৭৮ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার কোটি টাকার মতো। পাঁচ বছরের মাথায় অর্থছাড় ৬০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। সর্বশেষ গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) ছাড়ের পরিমাণ ছিল ৯২৭ কোটি ডলার। বর্তমান বাজার দরে এর পরিমাণ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। মূলত চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকে নেওয়া অর্থছাড়ের পরিমাণ বেড়েছে।
তবে বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে যেসব ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেসব ঋণের অনেকগুলোর গ্রেস পিরিয়ড তুলনামূলক কম এবং ঋণ পরিশোধের মেয়াদও কম। এখন এমন অনেকগুলো ঋণ পরিশোধের সময় চলে এসেছে। ফলে সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধও বেড়েছে।
গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ২৬৭ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ পরিশোধ হয়েছে। ১০ বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ পরিশোধও আড়াই গুণ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে প্রকল্পের জন্য দেওয়া বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ প্রথমবারের মতো ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছে ইআরডি।
জিডিপি বেড়েছে চার গুণ, রাজস্ব আড়াই গুণ
গত এক দশকে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বেড়েছে চার গুণ। কিন্তু এর বিপরীতে শুল্ক-কর আদায় বেড়েছে আড়াই গুণ। অর্থাৎ এই সময়ে জিডিপি যত দ্রুত বেড়েছে, শুল্ক-কর আদায় সেই গতিতে বাড়েনি। ফলে কর-জিডিপি অনুপাত আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে। সাম্প্রতিক কয়েক বছরের হিসাবে দেখা গেছে, কর-জিডিপি অনুপাতের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে প্রায় সর্বনিম্নে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জিডিপির আকার ছিল ৭ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকায়। তবে অর্থনীতি বড় হওয়ার পুরো সুফল ঘরে তুলতে পারেনি এনবিআর। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১ লাখ ২০ হাজার ৩ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছিল রাজস্ব দপ্তর। ১০ বছরে তা বেড়ে কেবল সোয়া ৩ লাখ কোটি টাকা হয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধারের চাপ কমাতে অবশ্যই রাজস্ব আদায় বাড়ানো উচিত। অর্থনীতি সম্প্রসারিত হচ্ছে, মানুষের আয় বাড়ছে। রাজস্ব আদায় বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে।’ বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি এম এ মান্নান মনে করেন, দেশি-বিদেশি ধারের টাকা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা উচিত। তাহলে কর্মসংস্থান বাড়বে, অর্থনীতি আরও এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তা না হলে বরং ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়বে।
prothom alo