‘রাজপথে ফয়সালা’ ঘিরে উৎকণ্ঠা

অক্টোবর-নভেম্বর ঘিরে অনেক দিন ধরেই রাজনীতির মাঠে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল– কী হবে ওই সময়ে? এমন আবহে ২৮ অক্টোবর বিএনপি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশের ডাক দেওয়ার পর ধীরে ধীরে তা আরও ডালপালা মেলে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতাদের পাল্টাপাল্টি কথার লড়াইয়েও উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে। দু’দলের কেউ কাউকে যেন ছাড় দিতে নারাজ। এতে আরও উত্তপ্ত হতে থাকে রাজনৈতিক অঙ্গন।

এ পরিস্থিতিতে শনিবার রাজপথে কী ঘটছে– এ নিয়ে জনমনেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। মাত্র দেড় কিলোমিটারের মধ্যে বড় দু’দলের সমাবেশ ঘিরে সবার চোখও থাকছে রাজপথে। দুপুর ২টায় নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ থেকে দেওয়া হবে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি। এর মধ্য দিয়েই নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের মহাযাত্রা শুরুর ঘোষণা দেবে বিএনপি। বাধা-প্রতিবন্ধকতা ও গ্রেপ্তার আতঙ্ক উপেক্ষা করে দলীয় নেতাকর্মী জড়ো করে রাজপথে শক্তি-সামর্থ্য দেখাতে চায় দলটি। আর রাজপথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার ঘোষণা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে সরকারি দল আওয়ামী লীগও। দুপুর ২টায় বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি ও উন্নয়ন নামে সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। জাতীয় নির্বাচনের আগে তারাও রাজপথ দখলে রাখতে নিজেদের প্রভাব বলয়ের বার্তা প্রদর্শন করতে চায়। এতে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে দেশি-বিদেশিদের সংলাপের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার পরিবর্তে ‘রাজপথে ফয়সালা’র পথেই হাঁটার বার্তা দিচ্ছে প্রধান দুই দল।

সমাবেশ সফল করতে কয়েক দিন ধরেই ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে দু’দল। সমাবেশের ব্যাপারে পুলিশের সঙ্গে করেছে চিঠি চালাচালিও। কর্মসূচির ১৮ ঘণ্টা আগে গতকাল শুক্রবার রাত ৮টায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, দু’দলকে প্রায় অভিন্ন ২০ শর্তে তাদের পছন্দের ভেন্যুতেই সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে কর্মসূচি পালনের অনুমতি পায়নি

জামায়াতে ইসলামী। তারপরও শুক্রবার আবারও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দুপুর ২টায় শাপলা চত্বরের পাশে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে দলটি।

অনুমতি দেওয়ার আগ থেকেই সমাবেশের স্থান দুটিতে নেতাকর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। নয়াপল্টনের সড়কে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করেন। রাতে নেতাকর্মীর মাঝে খাবার বিতরণও করা হয়। স্লোগানে স্লোগানে পুরো এলাকা মুখর রাখেন তারা। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতেও কিছু নেতাকর্মী রাত যাপন করেন।

এ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে পুলিশ-র‍্যাব নিয়েছে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্তত ২০ হাজার সদস্য মাঠে থাকছেন। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এ ছাড়া ব্যাটালিয়ন আনসারও প্রস্তুত থাকবে।

বিএনপির দাবি, মহাসমাবেশের আগে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে তাদের দুই সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পথে পথে চলছে তল্লাশি। অনেকের বাড়িতে চালানো হচ্ছে অভিযান। এদিকে গতকালও রাজধানীর প্রবেশমুখ ও দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন থামিয়ে যাত্রীদের পরিচয় ও গন্তব্যস্থল জানতে চাওয়া হয়েছে। কয়েকটি জেলা থেকে ঢাকাগামী যান চলাচলও বন্ধ রয়েছে। ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান সমকালকে বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে বেশ কিছু শর্তসাপেক্ষে কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সুশৃঙ্খলভাবে তারা সমাবেশ করবে। যদি কেউ বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করে, তাহলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নগরবাসীর নিরাপত্তায় পুলিশের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রয়েছে।

সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বিএনপি নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছিল ১৮ অক্টোবর। এর পর আওয়ামী লীগও একই দিন ঘোষণা দেয়– তারা ২৮ অক্টোবর বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ করবে। এই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে উত্তেজনাকর বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। বিএনপি মহাসমাবেশের ঘোষণার তিন দিনের মাথায় ২১ অক্টোবর পুলিশকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানায়। পুলিশের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার বিএনপিকে চিঠি দিয়ে মহাসমাবেশের জন্য দুটি বিকল্প জায়গা ভাবতে বলা হয়। এর পাশাপাশি জানতে চাওয়া হয় সাত ধরনের তথ্য। তা হলো– লোকসমাগমের সংখ্যা, সময়, বিস্তৃতি, কোন কোন স্থানে মাইক লাগানো হবে, অন্য দলের কেউ উপস্থিত থাকবে কিনা। বিএনপি একই দিন পুলিশকে চিঠি দিয়ে জানায়, তারা সমাবেশ নয়াপল্টনেই করবে। আওয়ামী লীগ পৃথক চিঠিতে পুলিশকে জানায়, বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে তারা সমাবেশ করবে। কর্মসূচির এক দিন আগে গতকাল শুক্রবার পুলিশ ভেন্যুর বিষয়টি দু’দলকে জানায়। তবে গতকাল ছুটির দিনেও রাজধানীতে পুলিশ ও র‍্যাবের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। প্রবেশ পয়েন্টে ছিল বাড়তি নিরাপত্তা ও চেকপোস্ট। নয়াপল্টন এলাকায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ৫০টির বেশি সিসি ক্যামেরা বসিয়েছে পুলিশ। মোহাম্মদপুর, আদাবর, ধানমন্ডি, কলাবাগান, নিউমার্কেট, হাজারীবাগ, শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় র‍্যাবকে টহল দিতে দেখা গেছে।

মহাসমাবেশ থেকে মহাযাত্রার শক্তি দেখাতে চাইবে বিএনপি

বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নানা বাধাবিপত্তি এড়িয়ে আজ নয়াপল্টনে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় মহাসমাবেশ করবে দলটি। লক্ষ্য অর্জনে সব প্রস্তুতিও নিয়েছে দলটি। লাখো মানুষের সমাগম ঘটিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনে নিজেদের শক্তিমত্তা দেখানো ছাড়াও দাবি মানতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশলও রয়েছে। এ ছাড়া দেশে-বিদেশে নিজেদের জনপ্রিয়তা আর সমর্থনকেও তুলে ধরা হবে এই মহাসমাবেশ থেকে। একই দিন সমমনা অন্য আরও ৩৪টি দল একই দাবিতে পৃথকভাবে রাজধানীতে মহাসমাবেশ করবে। তারাও নিজেদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। এখান থেকেই ঘোষণা করা হবে সরকার পতনের চলমান এক দফা আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি। এর মধ্য দিয়ে আন্দোলনের মহাযাত্রায় দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করবে দলটি। নতুন কর্মসূচিতে আগামী ৩০ অথবা ৩১ অক্টোবর সচিবালয় অথবা নির্বাচন কমিশন কার্যালয় অভিমুখে একাধিক স্থান থেকে পদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে। এদিকে সমমনা দলগুলোও পৃথক স্থানে সমাবেশ করবে। অনুমতি না পেলেও সমাবেশ করবে জামায়াতে ইসলামী। যদিও দলটির যুগপৎ কর্মসূচি বিএনপির সমমনা নয়।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশের উদ্দেশ্যই হচ্ছে– সরকারকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করা। যাতে সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হয়। এক দফা দাবি মেনে নিয়ে নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে একটা নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।

দলটির নেতাকর্মীরা জানান, এক দফা দাবি আদায়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে আরও চাপে ফেলতে চায় বিএনপি। এ লক্ষ্যে গত ২৮ জুলাইয়ে রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশকে ছাড়িয়ে এবার আরও বড় জমায়েত ঘটাবে দলটি। এ কর্মসূচি সফলে প্রস্তুতি সভা, মতবিনিময় সভা ছাড়াও সারাদেশের নেতাকর্মীকে ঢাকামুখী করতে গঠন করা হয় ১০ সাংগঠনিক কমিটি। সমাবেশে বাধা আসতে পারে, বিভিন্ন গণপরিবহন বন্ধ হতে পারে আশঙ্কায় অনেক নেতাকর্মী পূজার ছুটিতেই ঢাকামুখী হন। এর বাইরে তিন দিন ধরে বিভিন্ন কৌশলে, নানা পথ ঘুরে ঢাকায় আসেন তৃণমূল নেতাকর্মীর বড় অংশ। পথে পথে বাধা, তল্লাশি আর গ্রেপ্তারের আতঙ্কের মধ্যেও পরিবর্তনের আশায় তারা মহাসমাবেশে আসছেন বলে জানান বরিশালের বাকেরগঞ্জের ছাত্রদল সভাপতি নেয়ামুল হক নাহিদ। তিনি জানান, সারাদেশে বিএনপির ৪৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এক লাখের ওপর মামলা। এই মহাসমাবেশকে তারা মামলার হাজিরা হিসেবে নিয়েছেন। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায়, ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়ার আশায় তারা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। এবারে পরিবর্তন না হলে তাদের কেউই বাঁচতে পারবে না। ঘরে থাকলেও রক্ষা নেই।

বিএনপি নেতারা জানান, মহাসমাবেশ সফল করতে গতকাল রাতেও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন। বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতা, যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিক দল ও জোটগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে মতামত নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। মহাসমাবেশ সফলের লক্ষ্যে তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আগ বাড়িয়ে কিছু না করে নেতাকর্মীকে শান্তিপূর্ণভাবেই মহাসমাবেশ পালনের নির্দেশ দিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। পুলিশের দিক থেকে অনুমতি মেলার আগে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই মহাসমাবেশের মঞ্চ তৈরিতে সম্ভাব্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। এ জন্য আটটি বড় ট্রাক প্রস্তুত করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক বলেন, সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশ সফলের লক্ষ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি দেখাবে সমমনারাও

সমাবেশের অনুমতি পাওয়া যাবে– এমন গুঞ্জনে সকাল থেকেই দলটির নেতাকর্মীরা ছিলেন নয়াপল্টনমুখী। তবে শৃঙ্খলা রক্ষায় দলের পক্ষ থেকে মাইকে নেতাকর্মীকে সরে যেতে বলা হলেও তাতে তেমন সফল হয়নি। রাতে সমাবেশের অনুমতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকাজুড়ে নেতাকর্মীর মধ্যে আনন্দের জোয়ার বইতে শুরু করে। বিকেলের পর থেকে এই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানো হয়। এদিকে সরকার হটানোর ‘এক দফা’ আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে শনিবার ঢাকায় ১০টি স্থানে মহাসমাবেশ করবে বিএনপিসহ সমমনা জোট ও দলগুলো। সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গণতন্ত্র মঞ্চ বিকেল ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে, ১২ দলীয় জোট দুপুর ২টায় বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্ক মোড়ে, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট পুরানা পল্টন আলরাজী কমপ্লেক্সের সামনে, গণফোরাম ও পিপলস পার্টি দুপুর ১২টায় মতিঝিল নটর ডেম কলেজ উল্টো দিকে গণফোরাম চত্বর, এলডিপি বিকেল ৩টায় কারওয়ান বাজার এফডিসি সংলগ্ন এলডিপি অফিসের সামনে, গণঅধিকার পরিষদ (নুর) বেলা ১১টায় বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্ক মোড়, এনডিএম বিকেল ৩টায় মালিবাগ মোড়, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য দুপুর ১২টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে, গণঅধিকার পরিষদ (রেজা) বিকেল ৩টায় পুরানা পল্টন কালভার্ট রোডে, লেবার পার্টি বিকেল ৪টায় পুরানা পল্টন মোড়, এবি পার্টি বেলা ১১টায় বিজয়নগর হোটেল ৭১ সামনে (বিজয় ৭১), জনতার অধিকার পার্টি দুপুর ২টায় বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্ক মোড়, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ বিকেল ৩টায় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে ও জাতীয়তাবাদী পেশাজীবী পরিষদ বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করবে।

‘পাল্টা শক্তি’ দেখাতে সর্বাত্মক প্রস্তুত আওয়ামী লীগ

শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশের জন্য সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত আওয়ামী লীগ। নানা নাটকীয়তা শেষে শুক্রবার রাতে পুলিশের অনুমতি মেলার পর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেটে এই সমাবেশের সব প্রস্তুতি শেষ করেছে ক্ষমতাসীন দলটি। সমাবেশের জন্য মঞ্চ ও প্যান্ডেল নির্মাণ ছাড়াও সমাবেশস্থল এবং এর আশপাশের কয়েক বর্গকিলোমিটারজুড়ে মাইক লাগানো হয়েছে। এর আগে পুলিশের অনুমতি পাওয়ার আগেই এদিন সকাল ৯টা থেকে সমাবেশের মঞ্চ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। যদিও বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে গুলিস্তান থানা পুলিশের আউটবক্সের ইনচার্জ ওবায়দুর রহমান মঞ্চের কাজ বন্ধ করে দেন। পরে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঞ্চ তৈরির কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে বলেন, ‘আমরা শান্তি সমাবেশ করার জন্য পুলিশের অনুমতি চেয়েছি। যখনই অনুমতি পাব, তখনই আমাদের কার্যক্রম শুরু করব।’ পরে রাত ৮টার দিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেটে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার কথা জানানো হলে ফের মঞ্চ তৈরির কাজ শুরু করা হয়। মধ্যরাতে এই মঞ্চ তৈরিসহ সমাবেশের প্রস্তুতির কাজ শেষ করা হয়।

আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, দুপুর আড়াইটায় ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ব্যানারে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। তবে সকাল ১০টা থেকেই নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে জড়ো হবেন এবং বেলা ১১টা থেকে সমাবেশমঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলবে। পরে মূল সমাবেশ শুরু হলে সেখানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেবেন। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমানের সভাপতিত্বে ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের পরিচালনায় সমাবেশে দলের কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা বক্তব্য রাখবেন। আজকের শান্তি সমাবেশে বিশাল জনসমাগম ঘটানোর মাধ্যমে রাজধানীতে আরেক দফা শোডাউন করার প্রস্তুতি শেষ করেছেন সরকার সমর্থকরা। ঢাকা মহানগরীর সব থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট ছাড়াও গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদীসহ ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা ও উপজেলা থেকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী সমাবেশে যোগ দেবেন। ঢাকা মহানগরসহ এসব জেলার সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিদের সর্বোচ্চ সংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থককে সমাবেশে জড়ো করার বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ২ লাখ নেতাকর্মী এই সমাবেশে উপস্থিত হবেন বলে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। গতকালের সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এই সমাবেশ হবে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় সমাবেশ।

শান্তি সমাবেশের প্রস্তুতির পাশাপাশি বিএনপি ও তার মিত্রদের মহাসমাবেশ ঘিরে সম্ভাব্য সন্ত্রাস-নৈরাজ্য ঠেকাতে রাজধানীর রাজপথ দখলের তৎপরতা আরও জোরদার করেছে সরকার সমর্থকরা। বৃহস্পতিবার থেকে রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড ও এলাকায় নেতাকর্মীরা জড়ো হচ্ছিলেন। কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর রাজপথে নেতাকর্মীর অবস্থান আরও জোরদার করা হয়। দ্বিতীয় দিনের মতো শুক্রবারও রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে দলীয় নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে মিছিল-সমাবেশ হয়েছে। রাজধানীর অলিগলি ও পাড়া-মহল্লায় নেতাকর্মীর সতর্ক অবস্থানও অব্যাহত ছিল। গোটা রাজধানীতেই মিছিল-সমাবেশের মাধ্যমে নিজেদের শক্তির জানান দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। রাজধানীর চারপাশের সব প্রবেশপথে নেতাকর্মীর পাহারাও বসানো হয়েছে।

অন্যদিকে, দুপুরের পর থেকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীর ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। ঢাকার বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড থেকে মিছিল নিয়ে সেখানে এসে জড়ো হন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী। সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, গুলিস্তান, শহীদ নূর হোসেন স্কয়ার এবং বায়তুল মোকাররম এলাকা জনারণ্যে পরিণত হয়। প্রায় সারারাতই নেতাকর্মীর এই ভিড় দেখা গেছে। এদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ ও শোভাযাত্রা করেছে যুবলীগ। এ সমাবেশ থেকে শুধু আজ শনিবারের বিএনপির কর্মসূচিই নয়, বরং নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মাঠে থেকে বিএনপিকে প্রতিহত করতে নেতাকর্মীকে নির্দেশ দেওয়া হয়। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাইনুদ্দিন রানার সভাপতিত্বে ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এইচএম রেজাউল করিম রেজার সঞ্চালনায় সমাবেশে যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্ পরশ ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলসহ কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা বক্তব্য দেন। আজকের শান্তি সমাবেশকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের অপপ্রচার ও গুজবও ছড়াতে দেখা গেছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই ‘আওয়ামী লীগের সমাবেশ এক দিন পিছিয়ে ২৯ অক্টোবর নির্ধারণ করা হয়েছে’ এই মর্মে জাল স্বাক্ষর-সংবলিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ছাত্রলীগের প্যাড ও স্বাক্ষর জালিয়াতি করেও বিভ্রান্তিকর নানা তথ্য ছড়ানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুপুরে আওয়ামী লীগের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এগুলোকে গুজব ও মিথ্যাচার উল্লেখ করে নির্ধারিত সময়েই শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। বিকেলের সংবাদ সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও এমন বিভ্রান্তিকর গুজব ও মিথ্যাচারের জন্য বিএনপিকে দায়ী করেন।

সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির বক্তব্য প্রচার নয়

আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি বা তার কোনো বক্তব্য সমাবেশে প্রচার করা যাবে না– এমন ২০ শর্তে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে পছন্দের জায়গায় সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। অন্য শর্তগুলো হলো– অনুমোদিত স্থানের মধ্যেই সমাবেশের যাবতীয় কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। ধর্মীয় অনুভূতির ওপর আঘাত আসতে পারে এমন কোনো বিষয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন, বক্তব্য প্রদান বা প্রচার করা যাবে না।

দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে সমাবেশের সার্বিক কার্যক্রম অবশ্যই শেষ করতে হবে। সমাবেশে ব্যানারের আড়ালে কোনো ধরনের লাঠিসোটা বা রডসদৃশ কোনো বস্তু ব্যবহার করা যাবে না।