রাজপথের আন্দোলনে কখনো কখনো আদালতের রায় বদলাতে হয়। ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের লাগাতার আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামী নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় পরিবর্তন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মুখে কাদের মোল্লার রায় পরিবর্তন করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। আদেশ দেন তৎকালীন অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক এবং বর্তমান প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ওই রায়ে সন্তুষ্ট না হয়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সেদিন বিকেলে কিছু অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট শাহবাগে জড়ো হয়। শাহবাগে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। শুরু হয় টানা অবস্থান কর্মসূচি। সরকার সমর্থক ও তাদের জোট সঙ্গী দলগুলোর নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণে শাহবাগ এলাকা জুড়ে শুরু হয় লাগাতার আন্দোলন। সেই আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত সরকার ট্রাইব্যুনাল আইনে পরিবর্তন এনে রাষ্ট্রপক্ষকে আপিলের সুযোগ করে দেয়। আর সেই আপিলে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হয়। তা কার্যকর হয় ওই বছরের ডিসেম্বরে। গণজাগরণ মঞ্চের দাবিতেই এমনভাবে আইন প্রণয়ন করা হয় যাতে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনেরও বিচারের বিধান রাখা হয়। সেই আইনের কারণে জামায়াতে ইসলামীও যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে বিচারের মুখোমুখি হয়।
গণজাগরণ মঞ্চের এক দশক পূর্তি উপলক্ষে ২০২৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বিবিসি একটি প্রতিবেদন করেছিল। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশে গত এক দশকে যেসব আন্দোলন হয়েছে সেগুলোর মধ্যে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত একটি নাম। তারপরও বলতে হবে শাহবাগের ওই আন্দোলনের মুখেই আদালতের রায় পরিবর্তন হয়েছিল।
ফিরে এলো মুক্তিযোদ্ধা কোটা
বর্তমানে উচ্চ আদালতের রায়ে আবারো ফিরে এসেছে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা। মোটা দাগে বলা যায়, সরকার দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা নিয়েই আদালতের দোহাই দিয়ে ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরিয়ে আনলো। যেহেতু আপিল বিভাগ এখনো পর্যন্ত হাইকোর্ট বিভাগের রায় স্থগিত করেন নাই এবং শুনানির জন্য মুলতবি রেখেছেন অতএব ধরে নিতে হবে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রয়েছে।
উচ্চ আদালতের এই রায় বাতিল করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়কপথ, রেলপথ এবং নৌপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ অব্যাহত রেখেছে।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে গত ৪ জুলাই বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের রায় আপাতত বহাল রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল (নিয়মিত আপিল) করতে বলেছেন আপিল বিভাগ।
উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অভিজ্ঞতা খুব একটা সন্তোষজনক নয়। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ওপেন কোর্টে রায় ঘোষণার এক বছর পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছিলেন। সেই পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণার আগেই জাতীয় সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হয়ে যায়।
যা হোক সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বর্তমান ওপেন কোর্টের বিচারে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল হলো। যতদিন পূর্ণাঙ্গ রায় বের না হবে ততদিন এটা বলবৎ থাকবে।
বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদন শুনানির একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এত আন্দোলন কিসের, রাস্তায় শুরু হয়েছে? আন্দোলনের চাপ দিয়ে কি হাইকোর্টের রায়, সুপ্রিম কোর্টের রায় পরিবর্তন করবেন?’
তখন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘নো, নো (না, না)। আন্দোলনের সঙ্গে এই আবেদনের কোনো সম্পর্ক নেই। সরকারের পলিসি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। এখানে আইনের প্রশ্ন জড়িত, যে কারণে আবেদন নিয়ে এসেছি।’(প্রথম আলো, ৫জুলাই-২০২৪)। অ্যাটর্নি জেনারেল রাষ্ট্রের পক্ষে হাইকোর্টের রায় বাতিলের জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
‘এরপরও যদি আপিল বিভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার পক্ষে রায় ঘোষণা করেন তাহলে সরকারের কী করার থাকতে পারে? সরকার তো এখানে একেবারেই অসহায়। এমন একটা বয়ান সরকার দেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।’
কোটা সংস্কার বনাম কোটা বাতিল আন্দোলন
২০১৮ সালে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার করার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিল। সে সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, অনগ্রসর জেলার বাসিন্দাদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য ৫ শতাংশ আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১ শতাংশ আসন সংরক্ষিত ছিল।অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি ছিল সংরক্ষিত। মেধার বিকল্প ছিল কোটা সংরক্ষণ। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে। কারণ ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী এবং ১০ জেলা কোটার নামে মূলত মেধার বিপরীতে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দেওয়ার প্রথা চালু ছিল। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যারা উঠে আসতো তাদের ব্যাপারে এমনভাবে তদন্ত চালানো হতো যে বিরোধী দল বিএনপি কিংবা অন্য কোন দলের সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক আছে কিনা সেটাও যাচাই-বাছাই হতো। ফলে শুধু দলীয় সংশ্লিষ্টতা থাকার কারণেই অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে অযোগ্য হয়ে পড়তো। প্রশাসনে মেধাবীদের প্রবেশে এমন বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধেই মূলত শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সেসময় চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা প্রথাই বাতিল করে দেন। আর সেই কোটা প্রথা ফিরিয়ে আনার জন্য যথারীতি পুরাতন কৌশলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার একটা সুযোগ করে দেওয়া হলো। উচ্চ আদালতের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে কেমন হয়রানির শিকার হতে হয় তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। উচ্চ আদালতের বিচারকরা “শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ”- এটা তো আর আমার কথা নয়। সেই “শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদরা” সরকারের আকাঙ্ক্ষা বুঝতে অক্ষম সেটা কি বলা যায়?
মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরিয়ে আনার মধ্য দিয়ে প্রশাসনে আপনজন নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার বড় সুযোগ নিয়ে নিল। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে এমনিতেই বহু বিতর্ক চালু আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের বয়স ৮ বছর কিংবা ৯ বছর তারাও কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বলে সনদ নেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল এমএজি ওসমানীর কমান্ডে কতজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আর এখন তালিকায় কতজনের নাম আছে- সেটা যাচাই করার ক্ষমতা সরকারের বাইরে কারও নেই।আর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের যাচাই-বাছাই করবে কে?
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা
বিনা ভোটে নির্বাচিত সরকার সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকে। কোনো ফাঁক-ফোকর দিয়ে ভিন্নমতের মেধাবীরা প্রশাসনের ঢুকে পড়লে ভেতর থেকেই সংকট সৃষ্টি হতে পারে। সেজন্য একেবারেই ৩০ শতাংশ অর্থাৎ বিরাট একটা অংশ নিয়োগের ক্ষমতা হাতে রাখা এবং বাকি ৭০ শতাংশের মধ্য থেকেও যদি অর্ধেকটা নেওয়া যায় তাহলে সেই অনুপাত ৬৫ শতাংশে পৌঁছায়। দীর্ঘ মেয়াদে প্রশাসনে এমন ক্যাডার থাকলে পরে কত সুবিধা হয় সেটা দেখা গেছে ১৯৯৬ সালে। সে সময় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ব্যানারে যে জনতার মঞ্চ তৈরি হয়েছিল সেখানে কতজন জমায়েত হতো সেটা তো একেবারেই চোখে দেখা।
রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আন্দোলন যখন হালে পানি পাচ্ছিল না তখনই প্রতিবাদ উঠলো প্রশাসন থেকে। সচিব কুলের শিরোমণি মহিউদ্দিন খান আলমগীরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সচিবালয় থেকে প্রশাসনের একটি বিশাল অংশ এসে যোগ দিলেন জনতার মঞ্চে। জেলায় জেলায় তৈরি হলো জনতার মঞ্চ জেলা প্রশাসকদের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে। তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে সেটা ছিল চূড়ান্ত অসহযোগ। যেসব জেলা প্রশাসক সেই সময় ওই মঞ্চ তৈরি করেছিলেন তাদের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ছিল ১৯৭৩ সালের ব্যাচ। অনেকেই ওই ব্যাচকে বলে থাকেন তোফায়েল ক্যাডার (সেই সময় তোফায়েল আহমেদ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সচিব)। সেদিনের মাসব্যাপী আন্দোলনের সুফল উঠেছিল আওয়ামী লীগেরই ঘরে।
themirrorasia