রাজনৈতিক সহিংস কর্মকাণ্ডে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম।
এই অবস্থায় ব্যবসায়িক পরিবেশ স্থিতিশীল রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের ওপর জোর দিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতাদের কেউ কেউ। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলেছেন এ বিষয়ে এফবিসিসিআই ভূমিকা রাখতে পারে। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ প্রস্তাব দিয়েছেন বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এফবিসিসিআইকে বৈঠকে বসার।
রাজধানীর গুলশানে এফবিসিসিআইয়ের কার্যালয়ে গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত এক রুদ্ধদ্বার মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ী নেতারা এই পরামর্শ দেন। সভায় বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদও অংশ নেন। দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের অংশগ্রহণে এই সভা আহ্বান করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মাহবুবুল আলম।
সভায় বর্তমান রাজনৈতিক সহিংসতা, ডলার–সংকট, মূল্যস্ফীতি, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকঋণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। এফবিসিসিআইয়ের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
সভায় অংশ নেওয়া একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে তাঁদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। পাশাপাশি এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তাঁরা এফবিসিসিআইকে সক্রিয় হওয়ারও আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিংস বা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, এমন কর্মসূচি না নেওয়ার জন্য আহ্বান জানাতে এফবিসিসিআইকে অনুরোধ করেন।
সভায় এফবিসিসিআইয়ের সাবেক একজন সভাপতি বলেন, ২০১৪-১৫ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় এফবিসিসিআই দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছিল। এবারও তেমন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
সভা সূত্রে জানা যায়, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে সাদা পতাকা দেখানো, শান্তি সমাবেশ করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে এফবিসিসিআইকে পরামর্শ দেন ব্যবসায়ী নেতারা।সভায় মাহবুবুল আলম বলেন, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা জাতীয় অর্থনীতিকে শঙ্কার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি দেশের সরবরাহব্যবস্থাকে বিঘ্নিত করছে। যার প্রভাব পণ্যের উৎপাদন, বাজারমূল্য এবং রপ্তানি ও সেবা খাতের ওপরও পড়ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে সব ধরনের সহিংস কর্মকাণ্ড পরিহারের আহ্বান জানিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, কয়েক বছর ধরে দেশে অত্যন্ত স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে, যা ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির জন্য জরুরি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সহিংস কর্মকাণ্ডের কারণে দেশের ব্যবসা–বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়ছে। তৈরি পোশাক খাতেও উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
মাহবুবুল আলম বলেন, ডলার–সংকটের সমাধান ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। কারখানায় উৎপাদনব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতেও জোর দেন তিনি।
সভা শেষে যোগাযোগ করা হলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থনীতির সংকট শিগগির কাটার সম্ভাবনা কম। সে জন্য ডলারের চাহিদা কমানোর পরামর্শ দিয়েছি। এ ছাড়া আমার পরামর্শ ছিল, বিরোধী দলকে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করা। তাতে অর্থনীতিতে সুফল পাওয়া যাবে।’
সভায় পোশাক খাতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিও উঠে আসে আলোচনায়। এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, পোশাক খাতে মজুরি নিয়ে সৃষ্ট সহিংসতায় বহিরাগতরা জড়িত। প্রকৃত শ্রমিকেরা কখনো নিজ কারখানায় আগুন দিতে পারেন না। উদ্দেশ্যমূলকভাবে তৈরি পোশাক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের বিতর্কিত মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর, কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মধ্যে সমন্বয় আরও জোরদার করতে এফবিসিসিআই কমিটি গঠন করতে পারে। বিদ্যমান সহিংস কর্মসূচির বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য এফবিসিসিআইয়ের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এফবিসিসিআইয়ের আরেক সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ডলারের ওপর চাপ কমাতে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের আরও সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে আগামী ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য কম পরিমাণে আমদানি করতে হবে।
সভায় আরও বক্তব্য দেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, বর্তমান সহসভাপতি মো. আমিন হেলালী, খায়রুল হুদা চপল, শমী কায়সার, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি সামির সাত্তার, মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিটিএমএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফজলুল হক, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন প্রমুখ।
সূত্র : প্রথম আলো