রাজনৈতিক খেসারত: যে হাত মারতে আসবে সেই হাত ভেঙে দিতে হবে… এই নির্দেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।

 

  • ড. মাহবুব হাসান
  • ১০ ডিসেম্বর ২০২২

রাজনৈতিক খেসারত – নয়া দিগন্ত

যে হাত মারতে আসবে সেই হাত ভেঙে দিতে হবে… এই নির্দেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনি যে সত্য বলেন সেটিই তো আমরা দেখতে পাই। তার মুখে মিথ্যা মানায় না, তাই তিনি ভনিতা করেন না। যা সত্য তাই বলেন। এ কারণেই তিনি এত জনপ্রিয়।

বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ হলো ১০ ডিসেম্বর। কিন্তু ৭ ডিসেম্বরই নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে জড়ো হওয়া নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় মকবুল আহমেদ নামে বিএনপির এক কর্মী। আর অর্ধশতাধিক কর্মী রাবার বুলেটের আঘাতে আহত হয়েছেন। বিএনপি অফিসে ঢুকে সব নেতাকর্মীকে আটক করেছে। পুলিশের অভিযোগ ওই ভবন থেকে পুলিশের ওপর বোমা হামলা করেছে। এই অভিযোগ অস্বীকার করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সিমেন্টের বস্তায় করে বোমা নিয়ে গেছে পুলিশ। সেগুলোই বোমা উদ্ধারের নমুনা। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এতটাই ঘোলা যে, বোঝা যাচ্ছে না ঘোলা রাজনীতির চোরা জলস্রোত কোন দিকে গড়াচ্ছে। ফলে রাজধানীর বাসিন্দারা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে আছে। তার ওপর যদি সরকারপ্রধানের এই নির্মম বাণী মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের অন্তরে পৌঁছে, তাহলে তো আতঙ্ক এমন এক পর্যায়ে উঠে যায়, যা গণমানুষের পক্ষে সহ্য করা কঠিন হতে পারে।

তিনি, মানে প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান হিসেবে সব মানুষের প্রশাসনিক অভিভাবক। কিন্তু অভিভাবক হিসেবে যে রাজনৈতিক আচরণ তার করার কথা, যে ভাষায় তার বেদনা ও ভালোবাসা প্রকাশ করার কথা তা রক্ষা করা সম্ভবত তার জন্য দুরূহ হয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে তার ধৈর্যের বাঁধ অনেকটাই ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। তা হওয়ারই কথা। কারণ বিএনপি যে রকম উদগ্র আন্দোলন শুরু করেছে, তাতে করে তাদের শাস্তি পাওয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছে। সেটি আমরা বুঝতে পারছিলাম যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রাজনৈতিক বক্তৃতায় বললেন, বিএনপির সাথে খেলা হবে, তখনই।

তিনি খেলার সরঞ্জাম হিসেবে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ যত সহকর্মী আছেন তাদের সংগঠিত করছিলেন। তারই বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল পল্টনে, পুলিশি অ্যাকশনে। এই পুলিশকেই তো আমরা দেখেছি খেলতে যখন তারা বিএনপির রাজনৈতিক কর্মী হয়ে উঠেছিল। তখন আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে এরাই অ্যাকশনে ছিল। আজকে যারা নেতা হয়ে ফুরফুরে মেজাজে রাজনীতির টগবগে ঘোড়ার ওপরে বসে আছেন, সেই দিনগুলোতে তারা মাটিতে, পাকা রাস্তায় রক্তাক্ত হয়ে গড়াগড়ি গেছেন। পুলিশের সেই সময়কার মারের দাগ কি তাদের পশ্চাৎদেশে নেই? তারা ভুলে গেছেন? আজ যখন বিএনপির নেতাকর্মীদের পিটিয়ে তক্তা বানাচ্ছে পুলিশ, আওয়ামী নেতাদের মুখে আকর্ণবিস্তৃত হাসি। এই পুলিশই তাদের মেরেছিল, আজ সেই পুলিশই বিএনপিকে মারছে। মার খাচ্ছেন রাজনীতিকরা, পুলিশ থাকছে অটুট। কারণ তারা সরকারের লাঠিয়াল, কথাটি কেউ স্বীকার করুন আর নাই করুন, এটিই চরম ও পরম সত্য।

১৫ বছর পর বিএনপি জেগে উঠেছে বা বলা যেতে পারে জনগণ জেগে উঠেছে। ভোট চুরি বা ডাকাতি, কিংবা দিনের ভোট আগের রাতে সম্পন্ন করার পর ক্ষমতায় থাকা সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপিসহ সমমনা ২০ দলের জোট ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেই পারে। যেমনটি আওয়ামী লীগও অতীতে দেখেছে। এখন আওয়ামী লীগ ২০৪১ সাল নাগাদ ক্ষমতায় থাকার স্বপ্নে বিভোর। কারণ, তারা দেশের উন্নয়ন করতে চায়। সেই উন্নয়নের রূপ তো দেখা যাচ্ছেই, ঢাকার সড়কের অবস্থা দেখেই বোঝা যায়।

ফ্লাইওভারগুলো অপরিকল্পিত উন্নয়ন এই মহানগরকে যতই বসবাসের অনুপযুক্ত করে তুলুক না কেন, ক্ষমতায় থাকা সরকারের চোখে তা পড়বে না। কারণ ক্ষমতা এমনই এক জিনিস, যে লোকই ক্ষমতার মসনদে বসুন না কেন, তিনি রাজনৈতিক অন্ধ হতে বাধ্য। এর কারণ, যে শাসনপদ্ধতি, যে ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্ট্রাকচার আমরা বহন করছি, সেই ধ্যান-ধারণাই শাসককে অন্ধ বানায়। যতদিন পর্যন্ত এই স্ট্রাকচার নতুন করে পুনর্গঠন করা না হবে, ততদিন পর্যন্ত বিদ্যমান বিপর্যয় ক্ষমতাসীনরা চোখে দেখবে ঠিকই, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিতে তা হবে উন্নয়নের রোল মডেল। এই রোল মডেলই আমাদের দরকার, কেননা, আমরা কানাডা-সিঙ্গাপুরের চেয়েও অধিক উন্নতি করে ফেলেছি যে!

সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠত না, যদি সরকার দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে পারত। সরকার কাঁচাবাজারের নিয়ন্ত্রণও করতে পারেনি। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পণ্যের দাম বেঁধে দেয়ার পর কাঁচাবাজারে সেই দামে পণ্য কেনা যায় না। সরকারের দাম বেঁধে দেয়ার কথা তুললে, খুচরো দোকানি বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে থেকে কিনে আনেন। আমরা তো হোলসেল মার্কেট থেকে কিনি। তারা কম দামে দিচ্ছে না। সাধারণ ক্রেতা তো আর বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে যেতে পারে না। তাই তারা ফুঁসে ওঠে সরকারের বিরুদ্ধে। সেই বিক্ষুব্ধ মানুষই আজ বিএনপির পাশে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। গুলি খেয়ে মরছে, যেমন জীবন দিলেন মকবুল আহমেদ। ওই জীবন দানের পরও কি কাঁচাবাজারে শাকসবজির দাম কমছে? কমেছে বটে, তবে তা আয়ের সাথে মেলে না। মকবুল জীবন দেবে আর ফল ভোগ করবে রাজনীতিকরা।

বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশের অস্ত্র সক্রিয় হয়। কত কোটি টাকার সম্পদ তারা নষ্ট করেছে যে গুলি করে মানুষ মানতে হবে? আর যারা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে, ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে যোগসাজশে লুটে নিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে, তাদের জন্য তো পুলিশ নতশিরে দণ্ডায়মান থাকে। এটিই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এটিই আমাদের ভুল রাজনীতির খেসারত। এই খেসারত আর কতকাল দেবে দেশের উৎপাদক জনগণ?

আমাদের কৃষিজীবী সমাজের কর্মঠ মানুষদের কথা রাজনীতিকরা ভাবেন বলে মনে হয় না। হলে গত ৫০ বছরে কৃষি সেক্টরে প্রভূত সংস্কার করা যেত। ভূমি সংস্কার তার অন্যতম। না হয়নি, তার ছিটে ফোঁটাও। অথচ ভূমির মালিকানা নিয়ে, নামজারি নিয়ে, পরচা/খতিয়ান ইত্যাদি নিয়ে ওই সেক্টরে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে দুর্নীতি, তা আমরা নীরবে সহ্য ও বহন করে চলেছি। রাজনৈতিক সরকার এবং সামরিক সরকার, কোনো পদের সরকারই ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা সংস্কার করে উৎপাদক জনগণের পাশে দাঁড়ায়নি। বরং উল্টো করে বলে থাকে, সব জনগণ তাদের সঙ্গে আছে। তারা ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেও তারা রাজনীতিকদের সঙ্গে আছে, রিগিং করে জিতে ক্ষমতায় গেলেও সব জনতা তাদের সঙ্গে আছে। অথচ আমরা তো জানি ওই জনতা, ভোটার জনগণ রাজনীতিকদের ভেল্কিবাজির সঙ্গে নেই।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সামনে দুর্দিন আসছে, রিসেশন, মন্দা আসছে, খাদ্যসঙ্কট দেখা দেবে, দুর্ভিক্ষ হবে- তাই এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে সবাইকে। খাদ্যসঙ্কট মোকাবিলায় প্রতি ইঞ্চি জমি আবাদ করতে হবে। তার নির্দেশনাটি উপকারী, দিক-নির্দেশনামূলক, কিন্তু তিনি সম্ভবত ভুলে গেছেন যে তিনি মাগনা সার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই যে হাজার হাজার কোটি টাকা, জনগণের টাকা ভর্তুকি দেন পিডিবি, ওয়াসা, জ্বালানি খাতে বেসরকারি বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে এবং আরো বহু খাতে জনগণের টাকা খোলামকুচির মতো খরচ করেন, তা কি জনগণের জন্য? জনগণের টাকা তৃণমূলের জনগণের জন্য ব্যয় হয় না। বরং তা ব্যয় হচ্ছে লুটেরা বিদ্যুৎকেন্দ্র, ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য। তেমনি লুটেরা ঋণীদের টাকা পাচার বন্ধ করতে পারেননি বা পারেন না সরকার। কাঁচাবাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতেও ব্যর্থ সরকার। তাহলে জনগণের জন্য কী করলেন প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, প্রিয় সরকার এবং…। আমরা কি এতোটাই অন্ধ হয়ে গেছি যে জনগণের কথা ভুলে শুধু দলের ক্ষমতায় থাকার জন্য সমাজ-সংসার নরক-গুলজার করে ছাড়ছি!

আমাদের ক্ষমা করো প্রভু। এই রকম দেশ গড়তে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। আমাদের সেই প্রত্যাশিত গণতন্ত্র কোথায়, কোন রসাতলে গেছে? কেন গেছে? কারা নিয়ে গেছে সেই নীরব দুর্ভিক্ষের পাটাতনে?