১৭ জুন ২০২৩, ০৪:২৪ পিএম
• হঠাৎ সমাবেশের অনুমতি
• নির্বাচনী জোটে থাকতে পারে প্রাধান্য
• ভিসানীতির প্রভাব দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন কার্যত ‘অনুপস্থিত’ থাকা জামায়াতে ইসলামী আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে। গত শনিবার এক দশক পর প্রকাশ্যে সমাবেশ করেছে দলটি।
নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানো জামায়াতের এই প্রত্যাবর্তন নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা। নির্বাচনের আগ দিয়ে দলটির এই তৎপর হয়ে ওঠা এবং উঠতে পারার ব্যাখ্যায় নানা যুক্তি দিচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরেই জামায়াতকে কোনো সভা, সমাবেশ কিংবা জনসভার অনুমোদন দেয়নি। শুধু অনুমোদনই নয়, একসঙ্গে কয়েকজন জামায়াত নেতা এক হলেই গ্রেপ্তার করা হতো। সেই জামায়াত প্রকাশ্যে সমাবেশ করছে, তাও আবার পুলিশের কাছ থেকে মৌখিক অনুমোদন নিয়ে, এটা তো সব দলেরই ভাবনার বিষয়। এটা আওয়ামী লীগের কৌশল হতে পারে।
তারা আরও বলছেন, অতীতে জামায়াতের বিষয়ে আওয়ামী লীগ যে শক্ত অবস্থানে ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির পর সেখানে কিছুটা নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি, গাজীপুরের নির্বাচন ও জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ- তিনটি বিষয়কেই একসূত্রে গাঁথতে চাইছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন বলছে তারা (জামায়াত) অবৈধ নয়, তাহলে এতদিন তাদের (আওয়ামী লীগ) এই বোধ কোথায় ছিল? জামায়াতকে এখন সামনে আনার উদ্দেশ্য নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগে। আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত হয়েছে কি না আমরা তো জানি না। নেপথ্যে কী কাণ্ড হয়েছে সে বিষয়েওে আমাদের প্রশ্ন জাগে।
ভিসা নীতির প্রভাব পড়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটাও হতে পারে, অথবা এটা আওয়ামী লীগের কোনো কৌশলও হতে পারে।
২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে সবশেষ বিক্ষোভ মিছিল করেছিল জামায়াত। এরপর মাঝের সময়টাতে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অনুষ্ঠান বা সমাবেশের অনুমতি চায়নি তারা।
চলতি মাসে সমাবেশের অনুমতি চাইলে প্রথম দফায় অনুমতি না দেওয়া হলেও পরে তাদের মোখিকভাবে সমাবেশের অনুমতি দেয় পুলিশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ জুন পুরো শক্তি নিয়ে আইইবি মিলনায়তনে সমাবেশ করে জামায়াত। যথারীতি এ সমাবেশ থেকে সরকারবিরোধী নানা বক্তব্য এসেছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত বুধবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারটা উচ্চ আদালতে আটকে আছে। সেখানে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যেহেতু সেখান থেকে কোনো নিষেধাজ্ঞা আসেনি। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জামায়াতকে নিষেধাজ্ঞা করার দাবি আছে।
তিনি আরও বলেন, ইলেকশন কমিশনকে তো আওয়ামী লীগ সরকার বলে দেবে না যে, অমুককে নিবন্ধিত করো, অমুককে নিবন্ধিত করো না। এমন কোনো নিদের্শ-আদেশ আদালতকে যেমন করা হয় না, নির্বাচন কমিশনকেও করা হয় না।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। বিপরীতে তারা একটি আপিল করেছে, কোর্টে সেই আপিলটা পেন্ডিং আছে। দেশে নিবন্ধনহীন দল অনেক আছে। জোনায়েদ সাকী, মাহমুদুর রহমান মান্না, নুরুল হক নূর, তাদের দলগুলোরও নিবন্ধন নেই। তারাও তো রাজনীতি করছে, নিবন্ধনের সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।
তিনি আরও বলেন, জামায়াতের এই শোডাউনের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণ হলো তারা এখনও সক্রিয় রয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশে নিষিদ্ধ দল না হলে তাকে তো নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। নিজের নামে না হোক, স্বতন্ত্রভাবে ইলেকশন করতে পারে। সেই সুযোগ তাদের দিতে হবে। কারণ, তাদের এখনও নিষিদ্ধ করা হয়নি।
সাবেক এই উপাচার্য আরও বলেন, ড. আব্দুর রাজ্জাক সাহেব যেটা বলেছেন সেটা কৌশল হতে পারে। আর কৌশল কি না তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। জামায়াতকে নির্বাচনের জন্য সরকার একটা সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু জামায়াতের বক্তব্য শুনে কিন্তু তা মনে হয়নি। সেদিন যা বক্তব্য এসেছে তা সরকারকে হুমকি দেওয়ার মতো। তবে সরকারের সাথে জামায়াতের আঁতাত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। নীতিগতভাবেও এই সরকারের সাথে জামায়াতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং বিএনপির সাথে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
গত শনিবার জামায়তের সমাবেশের পর ক্ষমতাসীন দলের নেতারা নানা রকম বক্তব্য দিয়েছিলেন। সমাবেশের পরদিন রোববার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের বিচারের চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত জামায়াতকে দোষী বলা যাবে না। অন্যদিকে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামী যেহেতু নিষিদ্ধ দল নয়, তাই তাদের সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে জামায়াতকে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই বক্তব্যের কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান অবশ্য সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।
সরকারের পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য বা ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, তাতে জামায়াতের সঙ্গে সরকারের এক ধরনের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে বলে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন।
এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন।
দল হিসেবে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে তদন্ত শেষ করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট অনুযায়ী, সংগঠনের বিচার ও সাজার বিষয়টি সুস্পষ্ট না থাকায় জামায়াতের বিচার কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। তবে শুধু নিবন্ধন বাতিল নয়, জামায়াতকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করার দাবি আছে বিভিন্ন মহলের। এ ক্ষেত্রে সরকারি তরফে বরাবরই আদালতের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশেও নিষিদ্ধ করতে পারে জামায়াতে ইসলামীকে। নজির হিসেবে তারা বলছেন, জেএমবি, হুজিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনকে নির্বাহী আদেশেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল গণমাধ্যমে বলেন, সরকার যখন জামায়াতকে সভা-সমাবেশের অনুমতি দিচ্ছে, তখন এটা বোঝা যায় যে নির্বাচন সামনে রেখে মৌলবাদীদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে যায়। জামায়াতকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া মানে জাতিকে বিপদের দিকে নিয়ে যাওয়া।
এ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল এ দলটাকে (জামায়াত) যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে আইন, সে আইনে দলের বিচার করার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই বলা হয়েছিল, আইনটা সংশোধন করে যুদ্ধাপরাধী দলের বিচার করবে। সে আইনটা গত ৯ বছরে সংশোধন হয়নি।
হঠাৎ জামায়াতের প্রকাশ্যে সমাবেশ করা থেকে আন্তর্জাতিক মহলে কী বার্তা গেল- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অন্যরা যেভাবে রাজনীতি করছে তারাও রাজনীতি করতে পারবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তা চায়। সমাবেশের অনুমতি না দিলে ভিসানীতির যে আইন সে আইনের মধ্যে পড়তে পারে। আইনগতভাবে যে দলটা নিষিদ্ধ নয় তাকে তো সভা-সমাবেশ করার সুযোগ দিতে হবে। এরা হয়তো যেরকম বিধ্বংসী, মারামারি, পিটাপিটি যেগুলো আগে করত, হয়তো বলছে এগুলো করব না, সেটাও হতে পারে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়তো আশ্বস্ত হয়েছে যে, আগে যেমন জ্বালাওপোড়াও হয়েছে, এবার হয়তো তা করবে না। এ রকম কোনো কমিটমেন্ট করেছে কি না এটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলতে পারেন।