রাজনীতির খেলা

রাজনীতির খেলা – নয়া দিগন্ত


নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আদায়ে যুগপৎ আন্দোলন ও নির্বাচনোত্তর জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রসংস্কার ও রূপান্তরমূলক কর্মসূচির রূপরেখা প্রায় চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত ওই রূপরেখা ও রোডম্যাপ নিয়ে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই রাজনীতির ময়দানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছে বিএনপি। এ রূপরেখা প্রণয়নের পেছনে গত ৫০ বছরের শাসনের পটভ‚মি নিহিত রয়েছে।

বিএনপির বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা যে সব বিদ্রুপাত্মক কথা বলতেন, যেমন- বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি নেই, মিটিং-মিছিলের ক্ষমতা নেই, রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই ইত্যাদি (আরো কঠিন ভাষায় ও ভঙ্গিতে), তারই জবাব তারা দিয়েছে যেন গত আগস্টের ২২ থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর দেশের ১৮টি জেলায়-উপজেলায় মিটিং-মিছিল করে। সেই সব শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ধ্বংসাত্মক অভিহিত করে পুলিশ চড়াও হয়েছে, গুলি করে মেরেছে কয়েকজনকে। রাজনৈতিক মিটিং করতে গেলেই যদি তাকে ধ্বংসাত্মক বলা হয়, ছাত্রলীগের মাস্তানদের লেলিয়ে দেয়া হয়, পুলিশকে উসকানোর কথা বলা হয়, তাহলে কি এটিই সত্য যে, দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অধিকার হারিয়েছে বিরোধী দলগুলো? আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেদিনও সংবাদ সম্মেলনে বললেন, আপনাদের মনে নেই আমরা যখন বিরোধী দলে ছিলাম তখন ক্ষমতাসীনদের অত্যাচার-নিপীড়ন, পুলিশি আক্রমণ কেমন হয়েছে? সেগুলোর কথা আপনারা বলেন না কেন? সাংবাদিকদের সেই প্রশ্ন করা হলেও, তারা কেন পাল্টা উত্তর দেননি বা পাল্টা প্রশ্ন করেননি? তার মানে তিনি যে সব অভিযোগ করেছেন, সেসব যেমন সত্য তেমনি আজকে তার সরকারের পুলিশ যা করছে তাও চরম সত্য। অর্থাৎ পুলিশের ভ‚মিকার কোনো তারতম্য হয় না। কেবল ক্ষমতায় পালাবদল হলেই পুলিশ বনে যায় তাদেরই রাজনৈতিক সহযোগী, কখনো কখনো দলীয় কর্মী!

প্রজাতন্ত্রের জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা পুলিশ বাহিনী কেবল বিরোধী রাজনীতিকদেরই আইন ভঙ্গের অপরাধ দেখে। সরকারি দলের ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের অপরাধ, অন্যায় ও অপকর্ম দেখে না। এই যে গণবিরোধী আচরণ পুলিশের, তারই ফল হচ্ছে পুলিশের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ।

আওয়ামী লীগ এখন বলছে, পুলিশকে প্রতিপক্ষ বানাবেন না। কথাটি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের। তিনি যথার্থ বলেছেন। পুলিশকে কেন প্রতিপক্ষ করবে বিরোধী দল? তারা যখন ক্ষমতায় যাবে, অতীতে যখন গেছে তখন তো গুলি করে কর্মী হত্যাকারী সেই পুলিশ তাদের স্যালুট করলেই তারা তাদের বশংবদ হয়ে যায়। অতএব, বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সরকারবিরোধী ও সরকার পতন আন্দোলনে পুলিশকে প্রতিপক্ষ করেনি বা করবে না; বরং তারা পুলিশের উদ্দেশে বলেছে, সরকারের লাঠিয়াল না হতে। কারণ তারা জনগণের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত। অবৈধ, অনির্বাচিত ক্ষমতা দখলকারী সরকারের নিরাপত্তা বিধানের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত নয়। জনগণের টাকায় তাদের বেতনভাতা হয়। তারা প্রতিপালিত হচ্ছে জননিরাপত্তার লক্ষ্যে। এটি তাদের মনে রাখতে হবে। এ জন্য সরকারের লেজুড় হওয়া তাদের চাকরির শর্ত নয়। এটি সব আমলের সব সরকারের জন্য খাটে।

অথচ সরকার বিরোধীদের ওপর লাঠিচার্জ বা তাদের নির্মমভাবে দমনের জন্য, দলিত-মথিত করতে পুলিশকে ব্যবহার করছে। সরকারের এ ধরনের রাজনৈতিক ইচ্ছা পূরণে পুলিশকে ব্যবহার না করতেই বলেছে বিরোধীরা। পুলিশকে বরং প্রতিপক্ষ করে তুলেছে সরকার, নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। দ্বিতীয়ত, তাদের ওপরও যখন পুলিশি নির্যাতন চলেছে, তখন তারাও একই অভিযোগ করেছে। সেই সরকারও তো পুলিশকে নিজেদের স্বার্থেই ব্যবহার করেছে। পুলিশকে ব্যবহারের এই রাজনৈতিক ‘অনৈতিকতা’ কি পরিহার করার সময় আসেনি? সেই ঔপনিবেশিক পুলিশি লিগেসি বহন করতে হবে? সেই ১৮৬২-৬৩ সালে গঠিত পুলিশকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে শাদা চামড়ার লুটেরা ব্রিটিশদের ব্যক্তিগত ও আইনিভাবে রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। আজো সেই ধারাই অব্যাহত। কেন এই পরিত্যক্ত লিগেসি বহন করব আমরা?
এ কারণেই কি রাষ্ট্র সংস্কারের কথা উঠেছে? আমরা বহুবারই বলেছি, কেন স্বাধীন দেশের প্রশাসন ঔপনিবেশিক প্রশাসনের ভেতরে ঢোকানো হলো? আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ্য তো ওই প্রশাসনের বিরোধী ছিল। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম করতে হলে ওই প্রশাসনই তো প্রধান বাধা। সেই বাধা অপসারণের পদক্ষেপই কি রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কারের পরিকল্পনায় স্থান দিয়েছে বিএনপি তার রূপরেখায়? আগামী নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট পেতে অবশ্যই ওই সংস্কার ইস্যুটি একটি বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হবে।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি আদর্শ উল্টে দেয়ার বহু ইতিহাস আছে। অতএব যে রাজনৈতিক ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে, তা কতটা শক্তিশালী হবে, এ নিয়ে সন্দেহ করা যায়। অতীতে আমরা দেখেছি, জামায়াতে ইসলামী দলটি বিভিন্ন সময় একবার বিএনপির কাঁধে, একবার আওয়ামী লীগের সাথে যুগপৎ আন্দোলন করেছে। বেশির ভাগ ইসলামী দলের রাজনৈতিক চরিত্রে এই দোলাচল লক্ষণীয়। আজকে জামায়াত একরকম নিষিদ্ধ। তারা অতি সম্প্রতি বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে ঘোষণা দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এ নিয়ে বিএনপি কোনো মন্তব্য করেনি। কারণ দোলাচল একটি দলকে কেন কাঁধে নিয়ে ঘুরবে বিএনপি? তার তো দেশব্যাপী, তৃণমূল স্তরে সংগঠন আছে। দেশের প্রান্তিক স্তরে বিএনপির হাজার হাজার সংগ্রামী কর্মী যে আছে, সেটি তো দেখা গেল এ বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে তৃণমূলের কর্মসূচিতে। গুলি খেয়ে মৃত্যুর ঘটনা সত্তে¡ও কর্মীদের ঘরবন্দি করে রাখা যায়নি। আবার সাধারণ মানুষও সামিল হয়েছে বিএনপির মিছিল মিটিংয়ে। কারণ, ওই সব কর্মসূচিতে ছিল জনগণের স্বার্থ রক্ষার, স্বার্থ উদ্ধারের বিষয়- দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে শুরু করে জ্বালানিসহ অপচয়, লুটপাটসহ সরকারের অব্যবস্থা ও ব্যর্থতার বিরুদ্ধে নেয়া কর্মসূচিতে। জনসম্পৃক্তি এ কারণেও ঘটেছে।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক রংপুরের সংসদ সদস্য মশিউর রহমান রাঙাকে সংগঠনবিরোধী অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কারই কেবল করা হয়নি, রাজনৈতিকভাবে পরিত্যক্ত হয়েছেন তিনি। ওই ঘটনার বিপরীতে রাঙা সাহেব নিজে সংবাদ সম্মেলন করে পার্টির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী আচরণের অভিযোগ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, টাকার কাছে নতিস্বীকার করে পার্টিপ্রধান তাকে দল থেকে বের করে দিয়েছেন। এই অভিযোগ সত্য কি মিথ্যা, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এটিই বাংলাদেশের রাজনীতির আসল চেহারা। জাতীয় পার্টি এখন রাষ্ট্রসংস্কার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আসন্ন প্লাটফর্মে যোগ দিয়েছে। এই সংযুক্তি সরকারকে চমকে দিয়েছে। কারণ, জাতীয় পার্টি সরকারের রাজনৈতিক জোটে ছিল বহু বছর। সংসদে তারা প্রধান বিরোধী দল। এই বিভক্তির সূচনাটি হয়েছে পার্টির অভিভাবক খ্যাত সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের জাতীয় সম্মেলন ডাকার কারণ থেকে। তিনি অসুস্থ হয়ে ব্যাংককে চিকিৎসাধীন। সেই অবস্থা থেকে তিনি দলের জরুরি সম্মেলন ডেকেছেন। কেন তিনি এতটা জেগে উঠলেন? রাজনীতিতে ষড়যন্ত্রের যে ধারা চলছে, এটি হচ্ছে সেই শৈলশিখরের সামান্য মাথা। পার্টিপ্রধান ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ডেপুটি প্রধান জি এম কাদের সংসদে প্রধান বিরোধী নেতা হওয়ার চিঠি দিয়েছেন তার দলের সংসদ সদস্যদের স্বাক্ষর নিয়ে। এটি আরেকটি শৈলশিখরের চূড়া। চিঠি পাওয়ার পর সংসদ নেতার অনুমোদন নিয়ে স্পিকার সেই আবেদন মঞ্জুর করবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই চিঠি অনুমোদিত হয়নি। কেন? কারণ প্রধানমন্ত্রী হয়তো রওশনকে চান, কাদেরকে নয়। কারণ এই যে, জি এম কাদের এখন রূপান্তরের প্লাটফর্মে আছেন। মূলত কৌশল যখন ষড়যন্ত্র হয়, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, রাজনীতিতে জল ঘোলা হয়ে উঠেছে।

সাধারণ মানুষ যে সরকারের উন্নয়নের ধাক্কায় অনেকটাই বিব্রত ও বিপর্যস্ত, তা স্বীকার করবেন তৃণমূলের আওয়ামী লীগ কর্মী ও সমর্থকরাও। তবে, সবচেয়ে বড় খবর হচ্ছেÑ বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যোগ করা। এটি প্রমাণ করে, বিএনপির রাজনীতিতে চিন্তা আর রাজনৈতিক স্বাধীনতার এক নতুন সমন্বয় ঘটা থেকে। প্রচলিত পাল্টাপাল্টির রাজনীতি বা দোষারোপের রাজনীতি, এক দল আরেক দলকে এলিমিনেট করার যে ‘ষড়যন্ত্র’ ও তার পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধমূলক কাজ হাতে নেয়ার মতো নারকীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সরিয়ে দিয়ে জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক শাসনের কায়েম করতে জনগণের সদিচ্ছার প্রকাশে বাধাহীন অংশগ্রহণের নীতি ও কার্যক্রম নেয়ার রূপরেখা প্রণয়ন। এই মন-মানসিকতাই বিএনপিকে নতুন আদলে দেখতে পাবে আগামীতে। জ্বালাও-পোড়াওয়ের মার্কা মারা আওয়ামী-বিএনপি-জাতীয় পার্টির প্রচলিত ধারার রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করার এই ওয়াদাই তো দেশের সাধারণ মানুষ চাইছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী নেতারা দশ মুখে বলছেন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপি ষড়যন্ত্র করছে। এ কথার জবাব একটাই, তাহলো আপনাদের রাজনীতি তো ক্ষমতায় পৌঁছানোর। সেখানে রাজনৈতিক কৌশলকে সরকারের লোকেরা ষড়যন্ত্র বলেই চিত্রিত করেন, যা রাজনীতি নয়, গণতান্ত্রিক রাজনীতির মননও নয়। জনগণের মন জানতে হলে তাদের সমস্যা-সঙ্কট কী তা জানতে তৃণমূলে যেতে হবে, সেখানেই রাজনৈতিক ক্যাম্প করতে হবে। মিশতে হবে প্রকৃত উৎপাদকের সাথে। সেই সাথে রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী নেতা ও কাউন্সিলরদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে, উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া নেতা-নেত্রীরা অন্যায় করতে দ্বিধা করেন না। কারণ সেখানে কোনো জবাবদিহিতা নেই।

জবাবদিহিশূন্য সরকার ও জবাবদিহিবিহীন রাজনৈতিক দলের কোন্দল আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পচিয়ে দিয়েছে। মনে রাখতে বলি, আপনারা যে দোষ অন্য দলের ওপর চাপিয়ে দিয়ে মুচকি হাসছেন আজ ঠিক একই কাজ আপনারাও করেছেন অদূর বা সুদূর অতীতে। ভুলে যাবেন না, সময়ই সব কিছুর সংগ্রাহক ও উপস্থাপক।