- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ৩০ মে ২০২৩, ২২:১১
বাংলাদেশের জন্য নতুন মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর রাজনীতির প্রধান আলোচনা এখন কূটনীতি। রাজনৈতিক দলগুলো দেশের পরবর্তী কূটনৈতিক পদক্ষেপ সম্পর্কে যেমন কৌতূহলী তেমনি দূতাবাসগুলোও এর প্রভাব সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।
দূতাবাসগুলোর সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ যেমন বাড়ছে তেমনি দূতাবাসগুলো রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ বাড়িয়েছে। সরাসরি ও অনলাইন দুইভাবেই এই যোগাযোগ বাড়ছে।
জানা গেছে, এই যোগোযোগের দিক দিয়ে আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার কয়েকটি দেশ প্রাধান্য পাচ্ছে। যোগাযোগের মাধ্যমে দুই পক্ষই সর্বশেষ আপডেট এবং মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একই অবস্থানে আছে। মার্কিন ভিসা নীতির পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে ২০২৬ সালের পর জি-প্লাস সুবিধা পেতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের শর্তের কথা বলেছে। অন্য দিকে এশিয়ার কয়েকটি দেশ পরিস্থিতি সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
মঙ্গলবার ইউরোপের একটি দেশের দূতাবাসের এক কর্মকর্তার সাথে এই প্রতিবেদকের প্রায় ঘণ্টাব্যাপী অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় এ বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়। তার কথায় স্পষ্ট যে এবার নির্বাচনের পরিস্থিতি বুঝতে নির্বাচনী পর্যবেক্ষদের ওপর জোর দেয়া হবে। তারা বাংলাদেশে নির্বাচনের আগেই কাজ শুরু করবেন। তার আগে দূতাবাসগুলো নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নিতে চাইছে। নতুন মার্কিন ভিসা নীতি নির্বাচনের সাথে যুক্ত পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে তাও জানতে চাইছে। বুঝতে চাইছে নির্বাচন কমিশন তা কতটা আমলে নেবে ।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনের আগের দিন মার্কিন ভিসা নীতির ব্যাপারে টুইট করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিদেশি কূটনীতিকেরা মনে করেন, গাজীপুরের নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। তারা বাকি চারটি সিটি নির্বাচনের ব্যাপারেও আগ্রহী। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফলের সাথে ভিসা নীতির কোনো যোগসূত্র আছে, না তা কেবল কাকতালীয় তারা বোঝার চেষ্টা করছেন।
ডয়চে ভেলের প্রতিনিধির সাথে এশীয় একটি দেশের দূতাবাসের একজন কর্মকর্তারও সরাসরি আলোচনা হয়েছে। তারা বাংলাদেশের নির্বাচন সংক্রান্ত ঘটনাগুলো সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তারা বুঝতে চাইছেন পরিস্থিতি কোনদিকে যায়। সবারই একটি বিষয়ে আগ্রহ আর তা হলো রাজনৈতিক সহিংসতা বাংলাদেশ এড়াতে পারবে কিনা। আর বিএনপি বিদ্যমান কাঠামোর নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা।
ঢাকায় বিশিষ্ট নাগরিকদের একজন এরইমধ্যে অ্যামেরিকা ও ইউরোপের তিনটি দেশের কর্মকর্তাদের সাথে অনানুষ্ঠানিকভাবে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, তিনটি দূতবাসের কর্মকর্তারাই প্রধানত এখন বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী। দূতাবাসগুলোর কর্মকর্তারা বড় দুই রাজনৈতিক দল ছাড়াও আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে অনুষ্ঠানিক আলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। এই আলাপে দুই পক্ষেরই আগ্রহ আছে।
মার্কিন ভিসা নীতি প্রকাশ্যে আসার পর দিন আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিরা মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সাথে বৈঠক করেন। এরপর পিটার হাস পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনের সাথে তার অফিসে দেখা করেন। দুইটি বৈঠকেই বিষয় ছিলো ভিসা নীতি নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র এর লক্ষ্য একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলে জানানো হয়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মো: হুমায়ুন কবির বলেন, “যোগাযোগের বিষয়টি তো প্রকাশ্যেই আমার দেখতে পাচ্ছি। ভিতরে নিশ্চয়ই এই যোগাযোগ আরো হচ্ছে। আমরা মনে হয় সামনে এই যোগাযোগ আরো বাড়বে। আমাদের অভ্যন্তরীণ বা নিজস্ব প্রক্রিয়া যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা সক্ষমতা হারায় তখনই এই ধরনের কূটনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এটা কতটুকু কাজে আসবে জানি না তবে সব পক্ষকে সাথে নিয়ে তারা চেষ্টা করছে।”
বাংলাদেশের বড় দুইটি রাজনৈতিক দলই ভিসা নীতিকে তাদের জন্য ভালো এবং প্রতিপক্ষের জন্য খারাপ বলে অভিহিত করছে। ফলে ভিসা নীতি নিয়ে প্রকাশ্যে কারো কোনো অনুযোগ বা অভিযোগ নেই। এরইমধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাকযুদ্ধের ধার কিছুটা হলেও স্তিমিত হয়ে এসেছে।
ভিসা নীতির পর বিএনপি নেতারা এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না ধরনের কোনো বক্তব্য দেয়নি। তারা বলছে, এই সরকারই সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে প্রধান বাধা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সোমবার বলেছেন, “আওয়ামী লীগ কয়দিন আগেও কত লাফালাফি করেছে, এখন লাফালাফি কমে এসেছে। এখন আমরা লড়াই করছি, লড়াই চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে। অগ্নি-সন্ত্রাস করবে তারা, দোষ দেবে আমাদের। তাই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে হবে।”
আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সেমবার বলেছেন, “কেরানীগঞ্জ এবং খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন স্থানে বিএনপি অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগের ওপর দোষ চাপানোর নাটক করেছে। এসবের মধ্য দিয়ে তারা ভুল বার্তা দিচ্ছে। তবে নেতাকর্মীদের বলব, আপনারা শান্তভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন। আমরা আগ বাড়িয়ে কিছু করব না।”
রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, “মার্কিন ভিসা নীতির পর এখন বিএনপির একটি বিষয় স্পষ্ট করতে হবে যে তারা নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারই চায়, না এই সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে। সেটা স্পষ্ট না হলে পরবর্তী আরো অনেক বিষয় পরিষ্কার হবে না। আর সরকারকেও অতীতের মতো মিছিল সমাবেশে বাধা না দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।”
তার কথা,”গাজীপুরের নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে না থাকার পরও ভোটার উপস্থিতি ভালো ছিলো। কিন্তু এটা যে জাতীয় নির্বাচনেও হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ জাতীয় নির্বাচনে স্টেইক লেভেল অনেক হাই। জাতীয় নির্বাচনে অনেক ঘটনা ঘটতে পারে যা বিদেশীদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নাও হতে পারে। লোকাল অনেক বিষয় থাকে।”
তিনি বলেন, “এখানে নির্বাচনে জেতা মানে পুরোপুরি জেতা। হারা মানে পুরোপুরি হারা। তাই নির্বাচনে না জিতলে মার্কিন ভিসা দিয়ে কী হবে। ফলে এই কয়েকদিনে যে একটু স্বস্তি তা কতটা থাকবে তা এখনই বলা যায় না।”
তিনি মনে করেন, “এখন নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিতে যে প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য কূটনীতি চলছে তার ফল এখনই বোঝা যাবে না। বিএনপি এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে এলে হয়তো ছাড় দেবে সরকার। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনঢ় থাকলে ভিসা নীতির চাপ তেমন ফল দেবে বলে মনে হয় না।” সূত্র : ডয়চে ভেলে