রাইজ অ্যান্ড ফল অফ সাকিব আল হাসান

সাকিব আল হাসান

দিনটি ২২ মার্চ, ২০১২।

ক্রিকেট পাগল বাংলাদেশের মানুষের সমস্ত মনোযোগ তখন ঢাকার মিরপুর স্টেডিয়ামে। বিশ্বকাপের পরই ওয়ানডে ক্রিকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বহুদেশীয় টুর্নামেন্ট এশিয়া কাপের ফাইনাল হবে সেখানে। আর সেই ফাইনালের একটি দল বাংলাদেশ। চিরকাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ‘দুধভাত’ এই দলটা মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন থেকে মাত্র একধাপ দূরে।

খেলায় যেমন তেমনই হোক, এই দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় শক্তি এর দর্শক। দিনের পর দিন নিদারুণভাবে হেরে যাওয়ার পরও মাঠভর্তি দর্শক সমর্থন দিয়ে গেছে বাংলাদেশ দলকে। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশটিতে গর্ব করার মতো অর্জন খুব কমই আছে। আর খেলাধুলায় তো অবস্থা আরো শোচনীয়। অলিম্পিকের ইতিহাসে এতো মানুষের এই দেশটার কোনো পদক নাই। সেই রকম কোনো সম্ভাবনাও কখনো দেখা যায়নি। ক্রিকেট কেবল দশটা দেশ খেলে; তা-ও এই দেশগুলো এককালের ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোই। আর ভারত উপমহাদেশেই খেলাটা এক নম্বর জায়গা করে নিয়েছে। অন্যত্র ক্রিকেটের স্থান আরো অনেক পিছনে। ফলে এশিয়ার ক্রিকেট রাজনীতিটাও অনেক শক্তিশালী। এই সব মিলিয়েই বাংলাদেশ জায়গা করে নিয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সর্বোচ্চ স্তরে। বাংলাদেশের মানুষ এই গ্লানিকর ব্যাপারগুলো জেনেও সুনীলের কবিতা ‘কেউ কথা রাখেনি’র মতো মনে মনে ভাবে—‘একদিন আমরাও!’

আজই কি তবে সেই দিন? এতো দিনের গ্লানি থেকে মুক্তির? বাঁধভাঙা উল্লাসের? আধুনিক যুগে তো আর ঢাল তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ বাঁধে না। তারপরও জাতীয়তাবাদের বোধ খুব টনটনে। সব মিলিয়ে এই দায়টা বইতে হয় খেলাধুলাকেই। নরবার্ট এলিয়াসের মতো সমাজবিজ্ঞানী ভাবতেন, মানুষের আদি শিকারী প্রবৃত্তিকে দমন করে আধুনিক সভ্যতা। সভ্যতার আওতায় মানুষকে সুশৃঙ্খল থাকতে হয়। কিন্তু মানুষের লাখো বছরের প্রবৃত্তির অবদমন তাকে বিপজ্জনক করে তোলে; তার মধ্যে উত্তেজনা তৈরী করে। এই বোধ থেকে মুক্তি দেয় খেলাধুলা। বিশেষত দলীয় খেলাধুলা — শিকারীর মতো পরিকল্পনা, দল বেঁধে শিকার, প্রতিপক্ষ বধের বুনো আনন্দ। এলিয়াসের মতোই আরেক বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী এরিক ডানিং মনে করতেন, আন্তর্জাতিক খেলা জাতি গঠনে ভূমিকা রাখে। আশীষ নন্দী সেই কবে ‘তাও অফ ক্রিকেট’ লিখে দেখিয়েছিলেন ভারতের জাতীয়তাবাদকে কিভাবে উসকে দেয় ক্রিকেট।

আধুনিক পুঁজিবাদ ও ভোগবাদের যুগে সেলিব্রেটি খুব জরুরী। আর দিনকে দিন খেলোয়াড়রা হয়ে উঠছেন সবচেয়ে নামী সেলিব্রেটি। তাদের ব্র্যান্ডের দাম ও প্রভাব আকাশছোঁয়া। আমাদের সাকিবও এর বাইরে নন। সাকিব হয়ে উঠেন কর্পোরেট জগতের প্রিয় পোষ্টার বয়। ‘বাংলাদেশের জান’ তকমাটাও গ্রামীনফোনের দেয়া। মুক্তবাজার অর্থনীতির রমরমা সময়ে বিশ কোটি লোকের দেশে সাকিব খুব জরুরী আইকন। সাকিবের উত্থান তাই কেবল ক্রিকেটীয় নয়; বরং বুঝতে হবে পুঁজিবাদী ও রাজনৈতিক লেন্সে।

এইসব দীর্ঘ আলাপ। সারকথা হচ্ছে ক্রিকেট খেলাটা আদি যুগের মহাকাব্যর মতো হয়ে উঠতে পারে। এর নায়কেরা হতে পারেন কিংবদন্তি। আর সেই দিনটাতে বাংলাদেশের মানুষের জন্য মহাকাব্যর মঞ্চ তৈরী। মহাকাব্যর অন্যতম মূল উপাদান মহানায়কও প্রস্তুত।

সেই মহানায়ক হচ্ছেন সাকিব আল হাসান। ‘হারি জিতি নাহি লাজ’ কিংবা ‘সম্মানজনক পরাজয়’ ঘরানার পরাজিতের মন্ত্র ধারন করা দেশে সাকিব যেন তখন এক দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। ইতিমধ্যেই দুনিয়ার অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। বয়স মাত্র ২৫; ক্যারিয়ারের বয়স বছর ছয়েক। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ম্যাচ জিতিয়েছেন। টুর্নামেন্টে আছেনও ভালো ফর্মে।

কিন্তু সেইদিন সাকিব ট্র্যাজিক হিরো হয়ে গেলেন। বল হাতে ভালো করে পাকিস্তানকে আটকালেন অল্প রানে। ব্যাট হাতে দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৬৮ রান করলেন মাত্র ৭২ বল খেলে। কিন্তু, দলকে জিতিয়ে আনতে পারলেন না। শেষদিকে অন্যদের চেষ্টাতেও বাংলাদেশ পারলো না। হারলো মাত্র দুই রানে! মাত্র দুইটা রান! ব্রাজিলের মারাকানায় ১৯৫০ সালে যেমন বিশ্বকাপ হারার পর গোটা দেশ শোকাভিভূত হয়ে গিয়েছিলো, তেমনটা হয়তো বাংলাদেশে হয়নি; কিন্তু, কান্না আর কষ্টের যে বৈশ্বিক অনুভূতি তার তীব্রতা ছুয়ে গিয়েছিলো এই ব-দ্বীপের ক্রিকেটপ্রেমীদের। আর সবচেয়ে বড় কষ্টটা হয়তো পেয়েছিলেন সাকিব।

আর তাই পরদিন সংবাদপত্রে বাংলাদেশের ‘এতো কাছে তবু এতো দূরে’ পরাজয়ের গাঁথা, টুর্নামেন্টে সাকিবের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার ছাপিয়ে একটা ছবি চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

সাকিবের কান্নামাখা ছবি!

ব্রাজিলের কিংবদন্তী গোলরক্ষক মাকোইর বারবোসার গোটা দেশের স্বপ্নভঙ্গের পর যে বিষন্ন ছবি খেলাধুলার ইতিহাসে অন্যতম ট্র্যাজিক তার সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই তুলনা চলে সাকিবের ছবিটার। গোটা দেশ, দেশের আবেগ এতো দারুনভাবে ফুটে উঠার ছবি খুব কমই পাওয়া যাবে।

সেই ছবির বারো বছর পর। ২০২৪ সালে সেই মিরপুরের মাঠের সামনে সাকিবের কুশপুতুল পোড়ানো হলো। ছবিতে জুতা মারা হলো। ‘খুনী’ সাকিবের বিচার দাবীতে স্লোগান উঠলো। এই খুনী দেশে আসলে তাকে প্রতিহত করা হবে বলে আওয়াজ উঠলো।

কী ঘটলো এই ১২ বছরে, যাতে এক সময়ে গোটা দেশের মানুষের আবেগের প্রতীক হয়ে উঠা, দেশের ‘জান’ হয়ে উঠা লোকটি ধিকৃত গণশত্রুতে পরিণত হলেন? সাকিবের উত্থান পতনের এই গল্প বাংলাদেশের এক আশ্চর্য সময়ের গল্প। এই গল্পে আছে ক্রিকেট, রাজনীতি, ক্ষমতা, লোভ, অহংকার আর গণআন্দোলন। দ্যা রাইজ অ্যান্ড ফল অফ সাকিব আল হাসান যেন একটি থ্রিলার।

থ্রিলারের গল্পের নায়ক বা খলনায়ক যা-ই বলি না কেন, সাকিব বরাবরই একজন ‘স্ট্রিট-স্মার্ট’ ক্রিকেটার। ব্যাটিংটা একটু আধটু পারতেন সাথে কাজ চালানোর মতো বোলিং। দেশের একমাত্র ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ বিকেএসপিতে দেশের সেরা কোচিং পেয়েছিলেন। ক্যারিয়ারের প্রাথমিক পর্যায়ে ক্লাব বা দল পেতে অন্যদের চেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছিলেন। ফুটবলার বাপের ছেলে। অন্যদের মতোই টেপ টেনিসে খেলা তরুণ সাকিব জীবনে প্রথম ক্রিকেট বলে খেলতে নেমে প্রথম বলেই উইকেট পান ইসলামপুরের হয়ে। সেই থেকেই শুরু।

তবে সাকিবের সবচেয়ে বড় গুন ছিলো পরিস্থিতি পড়তে পারা।

যেই পরিস্থিতিই হোক না কেন — তাতে কোন কাজটা করলে নিজের জন্য সবচেয়ে ভালো হয় তা তিনি ঠান্ডা মাথায় ভালো ধরতে পারতেন। গড়পড়তা বাঙ্গালীদের মতো আবেগী না হয়ে নির্মোহ থাকতে পারতেন। সাকিবকে দেখলে মনে হতো, ক্রিকেট শুধু নয়, যে কোনো জায়গায় বসিয়ে দিলে তিনি সফল হতেন। এরপরে আমরা দেখবো, তিনি এই মেধা যতোটা না ক্রিকেট খেলার সফলতায় কাজে লাগিয়েছেন, এরচেয়ে অনেক বেশী ব্যয় করেছেন অর্থ কামানোর উদ্দেশ্যে।

তবে এহেন সাকিবেরও ‘লাকি ব্রেক’ দরকার ছিলো। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটা সাফল্যর গল্পে তা লাগে। সাকিবের জন্য যেই আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলো, আইসিএল বা ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লীগ। ভারতের সেই প্রাইভেট লীগকে নিষিদ্ধ করে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আর এর সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশী ক্রিকেটারদেরও নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড। অভিজ্ঞ একগাদা ক্রিকেটার দল থেকে বাদ পড়ায় সাকিব ও তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমের মতো যারা তখন দলে তরুণ, তারা পরের কয়েকটা বছর অনেকটা চাপ ছাড়াই খেলতে থাকেন। উপমহাদেশের দলগুলোতে সাধারনত এমনটা দেখা যায় না। সেই ব্রেকটা পেয়েই এই তরুনেরা দলে জায়গা পাকা করে ফেলেন।

সাকিবের জীবনের অনেকগুলো আশ্চর্য ব্যাপারের একটি হচ্ছে, একদিকে আইসিএল নামে নিষিদ্ধ ফ্যাঞ্চাইজি লীগের কারনে তার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে; অন্যদিকে ভারতীয় বোর্ডের আয়োজিত, দুনিয়ার সবচেয়ে দামী লীগ, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ বা আইপিএল খেলেই তিনি প্রচুর অর্থ ও খ্যাতি অর্জন করেন। ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে তিনি দুনিয়ার কোনায় কোনায় ফ্যাঞ্চাইজি লীগ খেলে বেড়িয়েছেন। ক্রিকইনফোতে তাকে নিয়ে যেই পেজ তাতে দেখা যায় তিনি এ যাবত বিভিন্ন লীগে ২২টি আলাদা দলের হয়ে খেলেছেন।

আইসিএল খেলতে গিয়ে নিষিদ্ধ হন বাংলাদেশের ইতিহাসে তখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল ও ক্যারিশমাটিক ক্রিকেটার মোহাম্মদ রফিক। রফিকের প্রভাবেই দেশে বাংলাদেশে বহু তরুন বাহাতি স্পিনার হতে চাইতেন বলে অনেকে মনে করেন। রফিক না থাকায়, ওয়ানডেতে ‘কাজ চালানোর’ মতো অলরাউন্ডার সাকিব টেস্টেও সুযোগ পেয়ে যান। তবে তখনও তাকে দেখা হতো মূলত ব্যাটার হিসেবেই। প্রথম ছয় টেস্টে উইকেট পান সাকুল্যে তিনটি। ব্যাটার হিসেবে কোনো অর্ধশত রানের ইনিংস নেই।

সেই সাকিবের ক্যারিয়ার রকেটের গতি পেলো চট্টগ্রামে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্টে। বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে ২৪২ রান (যাতে সাকিব আটে নেমে করেছিলেন মাত্র ৫ রান)। এর জবাবে স্বাগতিকরা ১৭১ রানে অলআউট হয়ে যায়। সাকিব একাই ৭টি উইকেট নেন। সাকিবকে দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবে খেলানোর কৌশল কাজে লেগে যায়।

এখানেও সম্ভবত বাংলাদেশের পরিবর্তিত মানসিকতা সাকিবের পক্ষে আসে।

এর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ ঘরের মাঠেও মূলত হাইওয়ের মতো পিচ বানাতো। লক্ষ্য থাকতো কোনভাবে যদি ব্যাট করে পাঁচদিন পার করা যায়। তবে ব্যাটারদের অক্ষমতা তাও হতে দিতো না। হারতে হারতে একটা পর্যায়ে ক্রিকেট বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয় পিচটা স্পিন বোলারদের সহায়ক করা হোক। এমনিতেও হারবে ওমনিতেও হারবে; নিয়তি যখন নির্ধারিত, তাহলে একটা সুযোগ নেয়া যাক। তখনকার বাংলাদেশের কোচ অস্ট্রেলীয় জেমি সিডন্সের এই সিদ্ধান্তে প্রভাব ছিলো বলে জানা যায়। তিনি সাকিবকে পছন্দ করতেন। তিনিই আব্দুর রাজ্জাকের পরে সাকিবকে দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবে দলে সুযোগ দিতে থাকেন — শুরুতে টেস্টে তেমন সাফল্য না পেলেও। রাজ্জাক স্পিনার হলেও তার শক্তি ছিলো ওয়ানডের মতো আর্ম বল আর লাইনলেন্থ। অন্যদিকে সিডন্সের স্নেহধন্য সাকিব ফ্লাইট আর টার্নের উপর ভরসা করতেন। পিচ সহায়ক হলে তাই রাজ্জাকের চেয়ে তিনি বেশী সুবিধা পাবেন। মনে রাখতে হবে সেই সময়টা দেশে তত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামল। ফলে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে বোর্ডে যতোটা রাজনৈতিক চাপ থাকে তা সম্ভবত কম ছিলো। সব মিলিয়ে স্পিন সহায়ক পিচের সিদ্ধান্ত সহজে বাস্তবায়িত হয়। এর দুমাস বাদেই জাতীয় নির্বাচন হবে। তাতে অনেক আসন নিয়ে আওয়ামী লীগ জিতবে। সাকিব আর আওয়ামী লীগের উত্থান ও পতনের গল্প লেখা হবে পরের দেড় দশক।

তবে সেই ২০০৮ সালে সাকিব নিজের গল্প লেখা শুরু করলেন। বোলিং করে সাত উইকেট পাওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে করলেন ৭১। তবুও জয় এলো না। সাকিবের মতোই বাঁহাতি স্পিনিং অলরাউন্ডার নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক ড্যানিয়েল ভেট্টোরি একাই ম্যাচ জিতিয়ে দিলেন। সাকিবের মতোই ম্যাচে ৯ উইকেট তবে ব্যাটিংয়ে দুইটা অর্ধশত। দ্বিতীয় ইনিংসের ম্যাচ জেতানো ৭৬।

বাংলাদেশ হারলো, সাকিব হারলো। এক হিসেবে কথাটা ভুল। আদতে বাংলাদেশ হারলেও সাকিবের জয় হলোই। এর পরের এক দশকে আমরা এরকম বহু উদাহরণ পাবো যেখানে সাকিবের দারুন পারফরম্যান্সের পরেও বাংলাদেশ হেরে যাবে। এশিয়া কাপের ফাইনালটার কথা তো শুরুতেই বলা হলো। সেই ফাইনালের আগের বছর, ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে সেঞ্চুরী ও ইনিংসে ৬ উইকেট নিয়েও পরাজিত দলে থাকতে হয় সাকিবকে।

সেই বছরটা অবশ্য সাকিবের ভালো যায়নি। ঘরের মাঠে মাত্র ২৪ বছর বয়সে বিশ্বকাপে অধিনায়ক। দেশবাসীর আশার প্রচণ্ড চাপ। বাংলাদেশ ব্যর্থ হলো। শুধু তাই না; ওয়েষ্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ আর দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৮ রান করে অলআউট হলো সাকিবের দল। অধিনায়কত্ব হাতছাড়া হলো।

তবে সবচেয়ে কম বয়সে অধিনায়ক হওয়ার রেকর্ড করা সাকিব কিন্তু আরো একবার ভাগ্যর সহযোগীতা পেয়েছিলেন — ২০০৯ সালে। ওই বছরর শেষদিকে বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যায়। তবে স্বাগতিক বোর্ডের সঙ্গে বেতন ও অন্যন্য বিষয়ে ঝামেলা থাকায় তাদের প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়রা সিরিজটি বয়কট করে। দ্বিতীয় সারির দলটিকে হারিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে টেস্ট ম্যাচ ও সিরিজ জেতে। শেষ ইনিংসে ৯৬ রান করে সাকিব দলকে জেতান। ১৫৯ রান ও ১৩ উইকেট নিয়ে ম্যন অফ দ্যা সিরিজ হন। অধিনায়কত্বের অভিষেকই বিরাট সাফল্য। অথচ, নিয়মিত অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা প্রথম টেস্টে চোট না পেলে সাকিবের অধিনায়ক হওয়া হতো না। এই মাশরাফির দেখানো পথেই পরবর্তীতে সাকিবের মহাপতন হয়।

তবে ক্যারিয়ারের শুরুতে দক্ষতার পাশাপাশি ভাগ্যও সাকিবকে সহায়তা করে। কে জানে! এতেই হয়তো তিনি আরো বেশি উদ্ধত হয়ে উঠেন। নিজেকে অপরাজেয় ভাবতে থাকেন। ইতিহাস সাক্ষী — এই মানসিকতা একদিন না একদিন পতনের কারণ হয়। সাকিবের বেলাতেও তাই হয়েছিলো।

যেমনটা হয়েছিলো আওয়ামী লীগের। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নামক চমক দিয়ে তরুনদের আকৃষ্ট করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দেশের সবচেয়ে বড় দলটি তখন আকাশে উড়ছে। সাকিবের মতোই শেখ হাসিনা ভাগ্যের ছোঁয়া পাচ্ছেন। নাইন-ইলেভেন পরবর্তী বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তখন হাসিনার ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তির ব্যাপক কদর পশ্চিমা দুনিয়ায়। বিএনপির আমলে ইরাক-আফগানিস্তান যুদ্ধের ধকলে বিশ্বব্যাপী তেলের বাজার তখন তুঙ্গে; দেশে মুদ্রাস্ফীতি ছিল আকাশছোঁয়া। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ে পরবর্তী তত্বাবধায়ক সরকারকেও বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার সময় শুরু হলো উল্টোটা। রাশিয়াকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কৌশলে সৌদি আরব তখন প্রতিদিন রেকর্ড তেল উৎপাদন করছে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম তলানিতে। সুফল পায় শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে তেলের দামের পেছনে ভর্তুকি দিতে প্রায় প্রতিটি সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যায় করতে হতো; অথচ হাসিনা উল্টো তেল বিক্রি করে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পেয়েছেন। শুধু কি ভাগ্য সহায় ছিল?! রাজনৈতিক সব কৌশলে হাসিনা পরাস্ত করছেন সব প্রতিপক্ষকে!

ম্যাচ জিতলে তো কথাই নেই, হারলেও যেমন সাকিব নায়কই থাকছেন, হাসিনার বেলাতেও তাই। দোষ দলের, সরকারের, কিন্তু উনার ব্যক্তিগত কোনো দোষ নেই — এই ছিলো তখনকার গণমাধ্যমের, দলীয় কর্মীদের ভাষ্য।

সাকিবে ফিরে আসা যাক। তিনি পারফর্ম করতেই লাগলেন। ২০১০ সালে তার অধিনায়কত্বে ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডকে ৪-০ তে (একটি ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেসে যায়) হারায় বাংলাদেশ। সাকিব যথারীতি ম্যান অফ দ্যা সিরিজ। চতুর্থ ওয়ানডেতে সেঞ্চুরীও করেন, কিন্তু সেদিন ৯২ রানে ব্যাট করার সময় সাইটস্ক্রিনের সামনে দর্শক হাটাচলা করছিলো। আম্পায়ারের নিষেধে কাজ না হওয়ায় সাকিব ব্যাট হাতে তেড়ে গিয়ে গালাগাল দেন দর্শককে। প্রায় নিখুঁত এক সিরিজে কলংকের এক মূহুর্ত। সবচেয়ে সফল সময়গুলোতেই নাকি পতনের বীজ রোপিত হয় অতি আত্মবিশ্বাসে। সাকিবেরও কি তাই হয়েছিলো?

‘ব্যাড বয় ইমেজটা’ পরের বছর আরো গাঢ় হলো। বাজে একটা বিশ্বকাপের পর সমালোচনায় মেজাজ হারিয়ে সংবাদপত্রে প্রাক্তন ক্রিকেটারদের নিয়ে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেন। বিভিন্ন সময় বাজে আচরণ করেও পার পেতে লাগলেন বিসিবির সোনার ডিম পাড়া হাঁস হিসেবে। কর্পোরেট পুঁজি লগ্নি করা যার পিছনে। সাকিব আল হাসানকে রোখার কেউ নেই তখন।

তবে টিভি ক্যামেরায় অশ্লীল ইঙ্গিত করার পর আর পার পেলেন না। ড্রেসিং রুমে বসে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বাজে অঙ্গভঙ্গি করায় তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা আর তিন লাখ টাকা জরিমানা গোনেন ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারীতে। এর চেয়েও বড় সাজা পান কয়েক মাস পর। এক দর্শককে পেটানোর অপরাধে ছয় মাসের জন্য তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বিসিবি। তবে দর্শক পেটানোই শুধু না, এর আগে ক্যারিবীয় প্রিমিয়ার লীগ বাদ দিয়ে দেশের হয়ে খেলতে বাধ্য করায় তিনি গোঁ ধরেন। দেশের হয়ে আর খেলবেন না বলে হুমকি ধামকি দেন। শেখ হাসিনার মতো “সব বন্ধ করে দেই?” বলে অহমে ভাসছেন নিজের বিকল্প নাই ভাবা সাকিব। যেই বোর্ড প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান সাকিবের সব দাবী মেনে নিতেন, তিনি পর্যন্ত বললেন, বাকি খেলোয়াড়দের আচরণ সাকিবের মতো হয়ে যাচ্ছে। তাকে শাস্তি না দিলেই নয়। তবে সাকিবের গোয়ার্তুমিরই জয় হয়। ‘বিকল্প’ না থাকা সাকিবের শাস্তির মেয়াদ সাড়ে তিন মাস কমিয়ে তাকে আবার বাংলাদেশ দলে ডাকা হয়।

সেই বছরের শেষদিকে প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে জিতে এসে প্রথমে সংবিধান সংস্কার করে আবার নির্বাচন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও পাঁচ বছর কাটিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ। সরকারী দল তখন সাকিবের মতোই উদ্ধত। অথবা বলা ভালো, পরিস্থিতিকে দারুন পড়তে পারা সাকিব অবস্থা বুঝে উদ্ধত হয়ে গেছেন। সম্ভবত সেই উদ্ধত মনোভাব তাকে টেনে আনে অপরাধ জগতে। জুয়াড়ি চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। নানারকম ব্যাবসায় জড়িত হন যেগুলোর বেশিরভাগই প্রশ্নবিদ্ধ। সাকিবের কাছের লোকেরা বলেন, টাকার নেশায় তখন তিনি বড় বড় ঝুঁকি নিচ্ছেন। ব্যর্থ হবার তো সুযোগ নেই — আফটার অল, তিনি সাকিব!

মাশরাফির নেতৃত্বে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ কেবল দারুণ এক বিশ্বকাপই কাটায় না; ঘরের মাঠে ওয়ানডে সিরিজ জেতে একে একে পাকিস্তান, দক্ষিন আফ্রিকা ও ভারতের বিপক্ষে। ঘরের মাঠে সত্যিকারের বাঘ হয়ে উঠার সেই শুরু। মিরপুরের নিচু, কম গতির পিচ বাংলাদেশের জন্য আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়। যথারীতি বোলিং আর ব্যাটিং দুইদিকেই অন্যতম ট্রাম্প কার্ড সাকিব।

ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট আর ব্যাবসা করে টাকা কামানো সাকিব স্বভাবসুলভ দক্ষতা ও পরিস্থিতি পড়তে পারার গুনের কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খারাপ করছিলেন না। তবে ফর্মটা পড়তির দিকেই ছিলো। খেলাতেও মনোযোগ যেন কমে আসছিলো। অধিনায়ক থাকা অবস্থায় ২০১৮ সালে শ্রীলংকায় নিদহাস ট্রফিতে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দলকে মাঠ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন; পরে খেলায় জিতে পুরো দল নিয়ে ‘নাগিন ড্যান্স’ দেন। বাংলাদেশের সাথে শ্রীলংকার ক্রিকেটিং সম্পর্কের এই উত্তেজনার রেশ চলতেই থাকে। কিন্তু সাকিব ততদিনে পুরোদস্তুর ব্যাবসায়ী।

তবে বিপদ আসছে টের পেয়েই বা টিকে থাকার স্বভাবজাত প্রেরণায় তিনি আরেকবার জ্বলে উঠেন ২০১৯ বিশ্বকাপে। একদম টিপিক্যাল সাকিবীয় গল্প। জীবনের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স করেন ব্যাট হাতে আট খেলায় দুইটা সেঞ্চুরী আর পাঁচটা হাফ সেঞ্চুরী করে। তবে বাংলাদেশের জন্য টুর্নামেন্টটা ভালো হয়নি। অন্যতম অভিজ্ঞ দল নিয়েও তলার দিকে শেষ করে। সাকিবকে যেমন অন্যরা যথেষ্ঠ সমর্থন দিতে পারেনি; একই সাথে দলাদলি আর খেলার মাঠের বাইরের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মাশরাফি আওয়ামী লীগের হয়ে প্রহসনের নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন। আর তাই ফিটনেস ছাড়াই একের পর এক ম্যাচ খেললেন অধিনায়ক হয়ে। দলকে ডোবালেন। এক সময়ের দেশের তরুণদের রোল মডেল রাজনীতির সমীকরণ মেলাতে গিয়ে হয়ে পড়লেন বিধ্বস্ত, নীতিহীন এক খলনায়কে। আশ্চর্য! সাকিবের শেষটাও এভাবেই হবে।

তবে তার আগে সাকিব খেলার মাঠে তলানিতে যেতে থাকেন। বিশ্বকাপ থেকে ফিরে আসার কিছুদিন পরেই আইসিসি তাকে এক বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞা( দুই বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞা) দেয়। অভিযোগ ছিলো জুয়াড়িদের সঙ্গে যোগাযোগ; ফলশ্রুতিতে আইসিসির দুর্নীতি দমন আইনের লঙ্ঘণ। এতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড় হয়ে; দুর্নীতি দমন ইউনিটের শয়ে শয়ে ট্রেনিং ক্লাসে হাজির থাকা সাকিবের এইসব অপরাধ ছিলো অবিশ্বাস্য। সম্ভবত ক্রিকেটীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশ ও এশিয়ার প্রভাবের কারনেই তার শাস্তিটা এতো কম হয়। রীতিমত গুরুপাপে লঘুদণ্ড।

ফিরে আসার পর আর পুরনো সাকিবকে পাওয়া যায়নি। ব্যাট হাতে কোন ফরম্যাটেই আর একটি সেঞ্চুরীও করতে পারেননি। বল হাতে ঘরের মাঠে টেস্টে খারাপ না করলেও প্রিয় ফরম্যাট ওয়ানডেতে বিবর্ণ হয়ে গেলেন। এমনকি আইপিএলে ঠিকঠাক ফিরতে পারলেন না। অন্যন্য লীগেও যেন বুড়ো নেতিয়ে পড়া ঘোড়া।

কারন তিনি তখন টগবগ করছেন মাঠের বাইরে। শেয়ারবাজার কারসাজির সাথে যুক্ত হয়েছেন। নিজের চিংড়ি ব্যাবসায় পাওনাদারদের বঞ্চিত করছেন। শ্রমিকদের ঠকাচ্ছেন। খুনী আসামীর জুয়েলারীর দোকান উদ্বোধন করছেন। আর মাশরাফির দেখানো পথে সরকারী দলের এমপি হয়ে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখছেন।

মাশরাফির মতোই তার শেষ বিশ্বকাপটা গেলো জঘন্য। চোখের সমস্যা নিয়ে ব্যাট-বল হাতে কিছুই করতে পারলেন না, দলের ভরাডুবি হলো। অথচ সাকিবীয় স্বভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে বিশ্বকাপের আগে দীর্ঘদিনের বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হওয়া তামিমের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে এসে বিষেদগার করলেন, ছোটো করলেন।

বিধ্বস্ত হলেও বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচটা খেললেন দারুন। শ্রীলংকার এঞ্জেলো ম্যাথিউসকে টাইমড আউট করে দারুণ বিতর্ক তৈরী করার পর ব্যাট হাতে ৮২ করে দলকে জেতালেন। এশিয়ার দুই দলের অতি জঘন্য বিশ্বকাপের মুখোমুখি লড়াইয়ে জিতে পরের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলার যোগ্যতা অর্জন করলো বাংলাদেশ। সাকিব বহুদিন ধরেই বলছেন, সেই টুর্নামেন্টই হবে বাংলাদেশের হয়ে তার শেষ।

কিন্তু, ‘ব্যাড বয়’ সাকিব কি সেই সুযোগ পাবেন? দেশে ফিরে আরো একটা তামাশার নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের এমপি হলেন। শুল্কমুক্তের সুবিধা নিয়ে দশ কোটি টাকার গাড়ি দেড় কোটিতে আনলেন। না জানি আর কী কী সুবিধা নিলেন!

কিন্তু ততদিনে সাকিবের ভাগ্য ফুরালো। কারণ হাসিনার সৌভাগ্যের চাকাও থমকে গেছে। দেশে সূচনা হলো এক প্রবল গণআন্দোলনের। আন্দোলনের ঝড়ে পালিয়ে গেলেন হাসিনা। পতন হলো আওয়ামী লীগ সরকারের। স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে গণশত্রু হলেন সাকিব। তবে জনতা তার উপর ফুঁসে উঠলো আন্দোলনের সময়কার আচরণে। আওয়ামী পুলিশ যখন শয়ে শয়ে মানুষ মারছে তখন দেশের এই সুপারস্টার নির্বিকার। শুধু তাই নয়; তিনি তখন বিদেশে পরিবারের হাসিখুশি ছবি দিয়ে বেড়াচ্ছেন সামাজিক মাধ্যমে।

এতো বছরের এতো ভালোবাসা যারা দিলো, যারা এশিয়া কাপের ফাইনাল হারার পর সাকিবের সাথে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলো, সেই বাংলাদেশী সমর্থকরা তার এই আচরণে ক্রুদ্ধ হলেন। সাকিবের পাঁড়ভক্তরাও তাকে ঘৃণা করতে শুরু করলেন।

সাকিব তো আর ব্রাজিলীয় কিংবদন্তী সক্রেটিস নন, যিনি বলেছিলেন দেশে গণতন্ত্র না ফিরলে, ঠিকঠাক নির্বাচন না দিলে তিনি দেশের হয়ে খেলবেন না। লাখো লাখো লোকের সমাবেশে এই হুমকি দেয়ার পর সেদেশের শাসকেরা নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।

সাকিব বরং তার ঠিক বিপরীত। নিরাবেগী, হিসেবী। সারা জীবন খেয়াল রেখেছেন কেবল নিজেরটাই। তবে তিনিও হিসেবে মস্ত ভুল করেছিলেন। আবেগী জনতার রাগ কতো ভয়ঙ্কর হতে পারে তা তিনি বুঝতে পারেননি। যখন বুঝেছেন তখন দেরী হয়ে গেছে। কয়দিন আগেও বিদেশের মাটিতে “আপনি দেশের জন্য কি করেছেন?” বলতে অভ্যস্ত সেই উদ্ধত সাকিব এখন দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চান। কিন্তু, সাকিবকে লোকে আর বিশ্বাস করে না।

বিশ্বাস দুরের কথা, তাকে জন্মভূমিতেও ফিরতে দেখতে চায় না মানুষের বড় একটি অংশ। ইতিমধ্যেই খুনের মামলার আসামী হওয়া সাকিব আওয়ামী লীগ পতনের পর পাকিস্তান ও ভারতে চারটি টেস্ট ম্যাচ খেললেও দেশে আর খেলতে পারবেন কিনা সন্দেহ। দক্ষিন আফ্রিকার সঙ্গে ২১ তারিখ থেকে শুরু হওয়া সিরিজে ঘরের মাঠে খেলে বিদায় নিতে চাইলেও, দলে ডাক পেলেও, গণরোষের ভয়ে শেষ মূহুর্তে তিনি আর দেশে ফিরছেন না বলেই জানা গেছে।

কেউ কেউ সন্দেহ করছেন সাকিব দেশে ফিরতে চান আসলে নিজের সম্পদ বাঁচাতে। কেউ ভাবছেন সাকিব আসলে পতিত আওয়ামী লীগের এসিড টেস্ট। সাকিব যদি খেলার অজুহাতে ফিরতে পারেন, তবে একে একে আওয়ামী লীগের বাকিরাও পূণর্বাসিত হওয়া শুরু করবে। হাসিনা পতনের পর ক্ষমতা নেয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে জণগণের সম্পূর্ণ সন্তুষ্টি না থাকলেও, স্বৈরাচার ও তার দল ফিরে আসুক তা জনগণ চাইছে না বলেই প্রতীয়মান হয়। ফলে, সাকিব আর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের গল্পটা সম্ভবত এখানেই শেষ।

গল্পটা শেষ হলেও আফসোসটা থাকবেই। আধুনিক যুগের পেশাদার খেলোয়াড়দের পক্ষে সক্রেটিস কিংবা বক্সার মোহাম্মদ আলী, যিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধ থামাতে নিজের ক্যারিয়ার হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিলেন, তাদের মতো হওয়া কঠিন। তবে সাকিবের পরিণতিটাও কাম্য নয় কোনোভাবেই। পিংক ফ্লয়েডের গানের কথায়:

Did they get you to trade your heroes for ghosts?
Hot ashes for trees? Hot air for a cool breeze?
Cold comfort for change? Did you exchange
A walk-on part in the war for a lead role in a cage?

টলস্টয়ের তিন বিঘা জমির নায়কের মতো থামতে না জানা সাকিব নিজের নির্মম মৃত্যুও বেছে নিলেন। না, তার পতন সম্ভবত মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রণাক্লিষ্ট।

netra news