রফতানি খাতকে গুরুত্ব দিন

  • মো: মাঈনউদ্দীন
  •  ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:০৭

আয়তনে ছোট ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হলেও বাংলাদেশের অনেক সম্পদ রয়েছে। রয়েছে জনসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ। কৃষি এখনো আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। আমাদের আছে পোশাকশিল্প, মৎস্য খাত, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ। কৃষিজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্রকৌশলী পণ্য, হোমটেক্সটাইলসহ প্রায় সাত শতাধিক ছোট-বড় পণ্যসহ রফতানিযোগ্য অনেক পণ্য রয়েছে। পাশাপাশি বিদেশে কর্মরত আমাদের জনশক্তি থেকেও আয় হচ্ছে।

চলতি বছরের মে মাস থেকে ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রবাসী আয় ও রফতানি আয় দিয়ে ডলারের চাহিদা মিটছে না। এ ছাড়া প্রযুক্তি ও সেবা খাতে বিদেশী বিল পরিশোধ, জাহাজ ও বিমান ভাড়া, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে খরচ মেটানো, সরকারি ও বেসরকারি বিল পরিশোধসহ আয় এবং নানা খাতে ডলার খরচ হচ্ছে। আবার চলতি বছর ১,৫০০ থেকে এক হাজার ৭০০ কোটি ডলার বিদেশী ঋণ শোধ দিতে হবে। তাই সঙ্কট মোকাবেলায় রফতানি আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে। হুন্ডির বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে বৈধ পথে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) দেশে আনতে হবে।

বর্তমানে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে হয়েছে তিন হাজার ৭০৬ কোটি ডলার। যেখানে সর্বোচ্চ মজুদ উঠেছিল চার হাজার ৮০০ কোটি ডলার। বৈশি^ক অর্থনীতি টালমাটাল অবস্থায় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছর ২০২২-২৩ এ পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য এবং ৯০০ কোটি ডলারের সেবা পণ্য রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। পণ্য ও সেবা মিলিয়ে মোট রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ছয় হাজার ৭০০ কোটি ডলার। ২০২১-২২ সালে মোট রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল পাঁচ হাজার ১০০ কোটি ডলার। বিপরীতে রফতানি আয় হয়েছে ছয় হাজার কোটি ডলারেরও কিছু বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে রফতানি আয় ছিল চার হাজার ৫০০ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের পণ্য গ্রহণযোগ্য করার জন্য কানেক্টিভিটি বাড়াতে হবে। ক‚টনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে পণ্যের রফতানি বাড়ানো যেতে পারে। আমাদের রফতানি আয় আটকে আছে সাত বা আটটি পণ্যের মধ্যে। সরকারের বিভিন্ন সহায়তা ও উদ্যোক্তাদের নানা উদ্যোগের পরও রফতানি আয় নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের মধ্যে থমকে আছে। রফতানিতে প্রধান পণ্যের মধ্যে তৈরী পোশাক ওভেন-নিটওয়্যারই রয়ে গেছে।

পোশাক খাতে নিট ও ওভেন থেকেই আসে মোট রফতানির ৮১ শতাংশ। রফতানিতে হোম টেক্সটাইলের অংশ ৩.১১ শতাংশ। অর্থাৎ মোট রফতানিতে পোশাক খাতের অবদান প্রায় ৮৫ শতাংশ। এছাড়া রয়েছে হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ, কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ইত্যাদি। রফতানি আয় আরো বাড়াতে হলে শুধু পোশাক খাতের ওপর নির্ভর করা ঠিক হবে না। বাংলাদেশী তৈরী পোশাকের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। এসব দেশেও ভোক্তারা বর্তমানে মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। এতে দোকানগুলোতেও পোশাক বিক্রি কমে যাচ্ছে। বিজিএমইএর এক পরিচালকের মতে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো চলমান ক্রয়াদেশ স্থগিত করছে। নতুন ক্রয়াদেশও কম আসছে। তাই রফতানি আয় বাড়াতে হলে অন্যান্য পণ্য যেমন, কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্যসহ রফতানিযোগ্য পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো ও রফতানি বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের রফতানির নীতি ও কাঠামোতেও যে সব সমস্যা আছে তা দূর করতে হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আমরা ব্যাপকহারে পণ্য আমদানি করি কিন্তু রফতানি করি মাত্র হাতেগোনা কিছু পণ্য। ফলে ভারতের সাথে আমাদের বাণিজ্যিক ব্যবধান অনেক। এই ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে। বিগত বছরগুলোতে ভারতে রফতানি বৃদ্ধি পেলেও তা সম্ভাবনা অনুযায়ী খুবই কম। এ ক্ষেত্রে কিছু শুল্ক ও অশুল্ক বাধা আছে। এগুলো যদি দূর করা যায় তাহলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানি কয়েকগুণ বাড়বে। ভারত বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যের ধরন ও বাণিজ্যের যে উপায় অর্থাৎ নদী ও স্থলবন্দরের অবকাঠামোগত অবস্থা অনেক দুর্বল। এটিও রফতানিতে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। তবে গার্মেন্টস সেক্টরের বাংলাদেশ ভারত থেকে যেসব কাঁচামাল আমদানি করে তা যথাযথ ব্যবহার করে রফতানি করে যাচ্ছে। এই রফতানির পরিমাণও বাড়ানো সম্ভব। তথ্য ও প্রযুক্তি প্রসারের কারণে পোশাক শ্রমিকদের দক্ষতা এবং কারিগরি জ্ঞান বৃদ্ধি করতে হবে। শ্রমিকদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার সংক্রান্ত জ্ঞানার্জন করতে হবে। প্রযুক্তি ও কর্মকৌশল প্রণয়নের মাধ্যমে রফতানিতে সক্ষমতা অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

এদিকে বৈশ্বিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস বাংলাদেশের ঋণমান প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের ঋণমান নির্ণয় করা হয়েছে দীর্ঘমেয়াদে বি বি মাইনাস ও স্বল্পমেয়াদের জন্য বি। দীর্ঘ সময় ধরে যদি পণ্যমূল্য বাড়তে থাকে, আমদানি চাহিদা বাড়তে থাকে- তাহলে টাকার আরো অবমূল্যায়ন হতে পারে। ফলে অর্থনীতি বহিঃস্থ খাতের আরো অবনতি হতে পারে, এ বিষয়গুলো চিন্তা করে সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে রফতানি আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। আধুনিক যুগে জাতীয় উন্নয়ন প্রশ্নে উৎপাদনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ছাড়া কোনো শিল্পই টিকে থাকতে পারে না।

উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন দক্ষ শ্রমিক। বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস পোশাক খাত যা ২০ শতাংশ দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি নিয়ে চলছে। এই সুযোগে পোশাক খাতে কয়েক হাজার বিদেশী শ্রমিক কাজ করছে। অন্য দিকে বিশে^র বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি জনশক্তি কাজ করছে। এতে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসার কথা তা আসছে না। কারণ প্রবাসে বাংলাদেশী দক্ষ জনশক্তির অভাব। দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে চাকরি হচ্ছে না বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর। আবার কারখানার মালিকরাও দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছেন না। ফলে উৎপাদন ও উন্নয়ন স্তিমিত হয়ে আসছে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি হাতে-কলমে শেখানো, বাস্তবিক অর্থে আধুনিক মেশিন তৈরি করা, চালানো, জীবন ও প্রযুক্তির মধ্যকার সম্পর্ক বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করা উচিত। শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের জ্ঞানের যথাযথ ব্যবহার করতে পারে সেজন্য শিক্ষকদেরও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দক্ষ শ্রমিক দল থাকলে কারখানার উৎপাদনশীলতা বাড়বে। ফলে মালিকপক্ষ শ্রমিকের মজুরি বাড়াতে বাধ্য হবে। দক্ষ শ্রমিক ও প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে আমাদের রফতানি পণ্য যদি মানসম্পন্ন হয় ও সঠিক সময়ে জোগান দেয়া যায় তাহলে সুনামও বৃদ্ধি পাবে, রফতানি আরো বৃদ্ধির পথ সুগম হবে। বর্তমান সঙ্কট মোকাবেলায় শুধু কৃচ্ছ্র সাধন করলে হবে না, পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

প্রবাসী আয় তুলনামূলক কম আসায় ডলারের ঘাটতি সৃষ্টি হলে অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হয়। সতর্কতা হিসেবে সরকার কৃচ্ছ্র সাধনের পদক্ষেপ নিয়েছে। সেইসঙ্গে সঙ্কট উত্তরণে দক্ষ শ্রমিকের সন্নিবেশ ঘটানো এবং পণ্য উৎপাদন ও রফতানি বাড়ানো এবং প্রবাসী আয় বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে হবে।

ইপিবির তথ্য মতে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) পণ্য রফতানি থেকে ৮৫৯ কোটি ১৮ লাখ (৮.৫৯ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশী মুদ্রা দেশে এসেছে, যা গত ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৫.৩২ শতাংশ বেশি। তৈরী পোশাক থেকে এসেছে ৭১১ কোটি ২৬ লাখ ডলার (৭.১১ বিলিয়ন) যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৬.১ শতাংশ বেশি। ১ জুলাই থেকে (২০২২-২৩ অর্থবছরে) আগস্ট পর্যন্ত ৪৬০ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছিল। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৩০ কোটি ডলার। গত আগস্টে রফতানি হয়েছিল ৩৩৮ কোটি ৩১ লাখ ডলারের পণ্য। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি না বাড়ালে ও খাদ্যশস্যে উৎপাদন, কৃষি এবং কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হলে রফতানিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে। এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও রয়েছে। তাই ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষতার সাথে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে ঋণের সুদের হার বাড়ানোর পক্ষে কেউ কেউ মত দিচ্ছেন। এতে ডলারের ওপর চাপ কমতে থাকে। কারণ তখন অনেকে বেশি সুদে আমদানি করতে চাইবে না।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
ইমেইল : [email protected]