দীর্ঘদিন ধরে দেশে ডলার সংকট চলছে। এই সংকট মোকাবিলায় যথাসময়ে রপ্তানি আয় দেশে আনার ওপর জোর দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য রপ্তানি আয় দেশে আনতে ব্যবসায়ীরা বিলম্ব করলে তাদের চলতি বিনিময় হারের পরিবর্তে নির্ধারিত প্রত্যাবাসনের তারিখের ডলার রেটে মূল্য পরিশোধের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন নির্দেশনার পর রপ্তানি খাতের অনেক ব্যবসায়ী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। এরই মধ্যে একাধিক সংগঠনের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। এসব চিঠিতে নির্ধারিত তারিখে প্রত্যাবাসনের পরিবর্তে প্রত্যাবাসিত দিনের ডলার রেট (চলতি বিনিময় হার) চেয়ে আবেদন করেছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, বন্দর থেকে পণ্য রপ্তানির পরপর তা বাংলাদেশ ব্যাংকের ড্যাশ বোর্ডে রিপোর্ট করতে হয়। রিপোর্টিংয়ের ১২০ দিনের মধ্যে রপ্তানি মূল্য দেশে আনার নিয়ম রয়েছে। এই নিয়ম মেনে অনেক ব্যবসায়ীই রপ্তানি আয় দেশে প্রত্যাবাসন করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, নির্ধারিত সময় অতিক্রম হওয়ার পরও দেশে আসেনি প্রায় ৯০০ কোটি ডলারের মতো রপ্তানি আয়। এই আয় দ্রুত দেশে আনতে সম্প্রতি ব্যাংকগুলোকে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে গত ৬ মার্চ জারি করা এক নির্দেশনায় বলা হয়, রপ্তানি পণ্যের মূল্য দেশে আনতে বিলম্ব করলে প্রত্যাবাসনের তারিখের চলতি রেটের পরিবর্তে নির্ধারিত প্রত্যাবাসনের তারিখে ডলারের রেটে মূল্য পাবেন ব্যবসায়ীরা। চলতি বিনিময় হার এবং মূল্য প্রত্যাবাসনের প্রকৃত তারিখের বিনিময় হারের ব্যবধানের অর্থ পৃথক খতিয়ানে রাখতে হবে।
জানা যায়, রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসনের দিনের রেট দাবি করে গত ১১ অক্টোবর বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেজিইএ) পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বরাবর চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, পাটপণ্য রপ্তানির প্রধান দেশ ইরানে স্যাংশন থাকায় সেখানকার কোনো ব্যাংক পেমেন্ট করতে পারে না। ফলে আমাদের অনুকূলে কোনো এলসি ইস্যু করতে পারে না। এজন্য নরমাল কন্ট্রাক্টের বিপরীতে আমাদের মালামাল রপ্তানি করতে হয় এবং তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে পেমেন্ট পাই। এটা অনেকটা কনসাইনমেন্ট সেলের মতো, মালামাল বিক্রয় করে পেমেন্ট দেয়। দুই একটা দেশ ব্যতীত অন্যান্য দেশের সঙ্গেও একই প্রক্রিয়ায় পাটপণ্য রপ্তানি হয়ে আসছে। যে কারণে পাটপণ্য রপ্তানির মূল্য প্রত্যাবাসন করা বেশ কষ্টসাধ্য এবং অনেক সময় বিলম্ব হয়।
এ বিষয়ে বিজেজিইএ’র চেয়ারম্যান এস আহমেদ মজুমদার বলেন, আমরা যারা ব্যবসায়ী তারা কেউই চাইব না মাল বিক্রির পর আয়টা বিলম্বে নিতে। কিন্তু যারা ক্রেতা তারা যদি পেমেন্ট বিলম্বে করে তাহলে আমাদের করার কিছু থাকে না। তাছাড়া পাট শতভাগ ফ্রেশ রপ্তানি পণ্য। এখানে ব্যাক টু ব্যাক এলসির কোনো বিষয় নেই। তাই এখানে টাকা পাচারেরও কোনো বিষয় নেই।
তিনি আরও বলেন, আমরা রপ্তানি আয় বিলম্বে পেলেও মিল থেকে অগ্রিম মূল্য পরিশোধে পণ্য কিনে থাকি। এছাড়া শ্রমিকদের পাওয়া ও পরিবহন খরচও যথাসময়ে পরিশোধ করি। তাহলে বিলম্বে রপ্তানি আয় আসলে কেন চলতি বিনিময় হার পাব না? এজন্য গভর্নরকে আমরা অনুরোধ করেছি বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার জন্য।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, ডলার রেট ঊর্ধ্বমুখী থাকায় অনেক ব্যবসায়ী রপ্তানি আয় নির্ধারিত সময়ে আনছেন না। তাই আমরা ১২০ দিনের মধ্যে যে তারিখে প্রত্যাবাসিত হবে সেই তারিখে ব্যাংকগুলোকে ডলার রেট দিতে বলেছি। ১২০ দিনের পর যে দিনই আনুক ১২০ দিনে যে রেট ছিল সেটাই পাবে। আমাদের বাইরে এখন অনেক রপ্তানি আয় আটকে রয়েছে। তাই ডলার সংকটে তাদের এ দাবি মেনে নেয়া সম্ভব নয়।
বিজেজিইএ’র চিঠিতে আরও বলা হয়, কভিড-১৯-এর তৃতীয় টেউয়ের সময় বিদেশে পাটপণ্যের মূল্য অনেকটা কমে যায়। ফলে ওই সময় বিদেশি বায়াররা মাল রিলিজ করতে গড়িমসি করে এবং আমাদের অনেক পেমেন্ট আটকে যায়। এক্ষেত্রে আমদানিকারকের ব্যাংকের তেমন কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকায় পেমেন্টের বিষয়ে বায়ারের সঙ্গেই যোগাযোগ ও নেগোশিয়েট করে পেমেন্ট রিয়েলাইজ করতে হয়। ফলে রপ্তানি সম্পন্ন হওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পেমেন্ট রিয়েলাইজড করা সম্ভব হয় না। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রপ্তানিকৃত মালের পেমেন্ট রিয়েলাইজড হলে ডলারের বর্তমান বিনিময় হারে কনভার্ট হবে। তবে গ্রাহক পেমেন্ট পাবে শিপমেন্ট হওয়ার ১২০ দিনের দিন যে হার ছিল সেই হারে এবং অতিরিক্ত টাকা সংশ্লিষ্ট এডি শাখার সান্ড্রি হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে, যা ছক আকারে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে। এই সান্ড্রিতে জমাকৃত টাকা পরবর্তীকালে কী হবে বা গ্রাহক কবে নাগাদ ফেরত পাবেÑএ বিষয়ে কিছুই সুস্পষ্টভাবে বলা নেই। এতে আমরা জুট গুডস রপ্তানিকারকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কারণ আমরা কিছু মিলের কাছে থেকে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করে পাটপণ্য কিনে শ্রমিকদের পাওনা, পরিবহন খরচ সব আগেই বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু সময়মতো পেমেন্ট পাই নাই, যেটা পেলে আমরা পুনরায় বিনিয়োগ করতে পারতাম। অন্যদিকে যে পেমেন্ট পাব সেটাও আগের রেটে পাব, তাহলে আমরা তো উভয় দিকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
এর আগে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টস অ্যাসোসিয়েশনও একই দাবি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে বলা হয়, রপ্তানিকারকরা এলসি ও টিটির মাধ্যমে রপ্তানিকার্য সম্পন্ন করে থাকেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে বৈদেশিক ক্রেতারা (আমদানিকারক) বিভিন্ন অজুহাতে রপ্তানিমূল্য বিলম্বে পাঠিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে বিলম্বিত সময়ের জন্য রপ্তানিকারকদের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শর্ত অনুসারে বিভিন্ন রেটে উক্ত পণ্যের বিপরীতে গ্রহণকৃত ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়। ফলে রপ্তানিকৃত পণ্যের উৎপাদন খরচের সঙ্গে ব্যাংকঋণের অতিরিক্ত সুদ যুক্ত হয়ে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের খরচ আরও বৃদ্ধি পায়। যেহেতু রপ্তানিকারকরা ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে রপ্তানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন, সেহেতু ডলার প্রাপ্তিতে উক্ত ঋণ সুদসহ সমন্বয় হয়ে থাকে। সে কারণে রপ্তানিকারকদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তাই বিলম্বিত ব্যাংকঋণের সুদ সমন্বয়ের জন্য রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রত্যাবাসিত তারিখের ডলার মূল্যে (ব্যাংকিং দরে) রপ্তানি বিল নগদায়ন করা না হলে রপ্তানিকারকরা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।