এম এম মাসুদ
২৭ এপ্রিল ২০২৩
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির ধীরগতির মধ্যেও গত কয়েক মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারলেও মার্চে নিম্নমুখী ধারায় চলে এসেছে। পূরণ হয়নি সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি আয় কমেছে ১১ কোটি ৮২ লাখ ডলার বা ২.৪৯ শতাংশ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ব্যবসা বাণিজ্য সংকটে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন রপ্তানিকারকরা। এ ছাড়া আগামী দিনে রপ্তানি আয়ে সুখবর নেই বলে জানান ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রপ্তানি আয় কমে আসায় বাণিজ্যের ঘাটতিও বড় হচ্ছে। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে রপ্তানি আয় আরও বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে বাংলাদেশের সরকার।
সংশ্লিষ্টদের মতে, রপ্তানি আয়ের সূচক এতদিন অর্থনীতিকে সামাল দিয়ে আসছিল। সেই সূচক ধাক্কা খাওয়ায় অর্থনীতিতে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। আগামীতে এই সূচক না বাড়লে রিজার্ভ আরও কমবে। সবমিলিয়ে অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, মার্চে বাংলাদেশ থেকে ৪৬৪ কোটি ৩৯ লাখ ডলার সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
গত অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় যা ২.৪৯ শতাংশ কম। ওই সময় রপ্তানি আয় হয়েছিল ৪৭৬ কোটি ২২ লাখ ডলার। বার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী মার্চের কৌশলগত রপ্তানির লক্ষ্য ছিল ৫০২ কোটি ডলার। তবে একক মাসের হিসাবে মার্চে রপ্তানি আয় কমলেও সার্বিকভাবে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে অর্থাৎ প্রথম ৯ মাসে রপ্তানি আয় বেড়েছে। ৯ মাসে মোট রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ১৭২ কোটি ১৬ লাখ ডলারের। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এটি ৮.০৭ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৩ হাজার ৮৬০ কোটি ৫৭ লাখ ডলার।
ইপিবি’র তথ্যমতে, এর আগে চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক ধারা দেখা গেছে। ওই মাসে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৪৩৬ কোটি ডলার, যা তার আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৭ কোটি ডলার কম। এর পর থেকে ইতিবাচক ধারায় ছিল রপ্তানি আয়। বেড়েছিল টানা ৪ মাস। তবে মার্চে এসে তা আবারো কিছুটা হোঁচট খেলো।
মূলত তৈরি পোশাকের ওপর ভর করেই দেশের রপ্তানি আয় বাড়ে। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই পোশাক রপ্তানিকারকরা বলে আসছিলেন, তাদের ক্রয়াদেশ কমে গেছে। গত মার্চ মাসের রপ্তানি আয়ের চিত্রে তা কিছুটা প্রতিফলিত হয়েছে।
পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ তথ্যে দেখা গেছে, গত কয়েক মাস ৪ বিলিয়ন করে পোশাক রপ্তানি হয়েছিল। কিন্তু মার্চে এসে তা ৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। শুধু মার্চে মোট পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩৮৯ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১ শতাংশ কম।
বিজিএমইএ’র পরিচালক ও মুখপাত্র মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, রপ্তানিকারকরা বলে আসছিলেন যে, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দাভাব এবং আমদানিকারক দেশগুলোর মূল্যস্ফীতির চাপের প্রভাব পড়বে রপ্তানিতে। কারণ মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে ক্রেতাদের আমদানি কমে যাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের পোশাক খাতের রপ্তানি কমবে। তার কিছুটা চিত্র দেখা গেছে মার্চের রপ্তানি আয়ের হিসাবে। তবে মার্চে রপ্তানি কমলেও প্রতিযোগীদের তুলনায় বাংলাদেশ তেমন একটা পিছিয়ে নেই। আগামীতে রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।
ইপিবি’র প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত ৯ মাসে পোশাক খাতে মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ৩ হাজার ৫২৫ কোটি ২৪ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এটি ছিল ৩ হাজার ১৪২ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। জুলাই-মার্চ সময়ে পোশাকের বাইরে অল্প কয়েকটি খাতে রপ্তানি আয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে। এর মধ্যে প্লাস্টিক খাতে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে বেড়েছে ২.৫৬ শতাংশ। এ ছাড়া বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ পণ্যে রপ্তানি আয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমে গেছে। এরমধ্যে কৃষিপণ্যে ২৮ শতাংশ এবং পাট ও পাটপণ্যে ২১ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়া হিমায়িত খাদ্যে ২০ শতাংশ, বিশেষায়িত টেক্সটাইলে ১৯ শতাংশ কমেছে রপ্তানি আয়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রপ্তানি আয় কমলে সেটা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়াবে।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ২২৬ কোটি ৪০ লাখ ডলারের। ওই সময়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১.২৮ শতাংশ কম হয়েছে রপ্তানি। চলতি অর্থবছরে মোট ৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয় হয় ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার।
বিজিএমইএ’র ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের প্রধান মার্কেট হচ্ছে ইউএস এবং ইউরোপ। এখন আমাদের যেসব অর্ডার পাওয়ার কথা ছিল, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ক্রেতারা অর্ডারও কমিয়ে দিয়েছে।
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি এবং বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, আমাদের রপ্তানি আয় কমছে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা করছে। এ অবস্থায় আগামী দিন আমাদের রপ্তানি আয়ে সুখবর নেই বলেই মনে হচ্ছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি কিছুদিন আগে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, অর্থনীতি গতিশীল রাখতে রপ্তানি বৃদ্ধির বিকল্প নেই। সেজন্য আগামী ৪ বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১০ হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করতে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছি। সেজন্য যেসব চ্যালেঞ্জ আছে, সেগুলো মোকাবেলার জন্য কাজ শুরু করেছি।