- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ২২:০০
বাংলাদেশে রক্ষক প্রায়ই ভক্ষক হয়ে থাকে। এর হাজারো উদাহরণ রয়েছে। বাংলা প্রবাদবাক্যে এই বাগধারাটি সহজে প্রবেশ করেনি। হয়তো বা এর রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। রাজা-রাজ্য-রাজধানীর ইতিহাস, ভূগোল ঘাঁটলে অনেক মীরজাফরের সন্ধান পাওয়া যাবে। প্রাচীন বাঙালি জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ভ্রমণকারীরা ভালো কথা লিখেননি।
আকবর আলি খান তার সর্বশেষ গ্রন্থে ‘ছলনা জালের রাজনীতিতে’ কিঞ্চিৎ বর্ণনা দিয়েছেন। রাজনীতিকদের সাধারণভাবে জনগণের জীবন, সম্মান ও সম্পদের রক্ষক বিবেচনা করা হয়। তারা আগেকার রাজা-বাদশাহ ও জমিদারদের স্থান দখল করেছেন। আগেকার চিন্তা অনুযায়ী ‘কিং ক্যান ডু নো রং’। ব্রিটেনে এর অর্থ ভিন্ন হলেও বাঙালি সমাজে এর তাৎপর্য হলো- রাজা বা রক্ষক অন্যায় করেন না। রাজা যেমন এই নীতিবাক্যকে বরণ, ধারণ ও সংরক্ষণ করেন, তেমনি জনসাধারণও বিশ্বাস করে রাজার সর্বোচ্চ মর্যাদাকে। ক্রমেই দেশের শাসনব্যবস্থায় বর্তমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যতই অনুসৃত হতে থাকে, ততই নীতিবোধের স্খলন লক্ষ করা যায়।
রাজনৈতিক দল শাসিত রাষ্ট্রপতি বা মন্ত্রিপরিষদ সরকারে শপথ পাঠ করানো হয় এরকম যে-‘সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি আইন অনুযায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী (কিন্তু ক্ষেত্রমত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী) পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’ এই শপথবাক্য উচ্চারণের পর পদাধিকারীরা কী রকম আচরণ করেন তা সচেতন নাগরিক সাধারণ জানেন।
বিগত ৫০ বছর বিশেষত গেল ১৫ বছর আমরা দেখেছি এই শপথকারীদের হাতে মানুষের জীবন নিরাপদ নয়। এদের হাতে মানুষের সম্মান কিভাবে পদদলিত হয় ইদানীং রাজনৈতিক নেতা ও নাগরিকদের ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর ঘটনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এই দেশে শাসকদলের লোকেরা গোটা জাতীয় সম্পদকে নিজেদের সম্পদ মনে করেন। ক্ষমতাসীনরা এক লাখ ৪৯ হাজার ২১০ বর্গকিলোমিটারের এই মানচিত্রকে তাদের নিজস্ব সম্পত্তি মনে করেন। তারা কিভাবে অপরের সম্পত্তিকে নিজের সম্পত্তি বানিয়ে নেন তার হাজার হাজার উদাহরণ সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। তারা তাদের ওই ত্রিবিধ স্বার্থ- জীবন হরণ, সম্মান বিনষ্ট ও সম্পত্তি দখলের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আদালত ও দলীয় অবস্থানকে কিভাবে কাজে লাগিয়েছেন তা একরকম প্রকাশ্য। তবুও তারা আইনের ভান করেন। নিয়ম রক্ষার নির্বাচন করেন। দলতন্ত্রের মহড়া দেন।
রাষ্ট্রের অঙ্গ সংগঠনগুলো- আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচারালয়কে তারা তাদের মতো করে ধারণ ও সংরক্ষণ করেন। তারা আইনের রক্ষক। অথচ আইনকে ভঙ্গ করেন। আওয়ামী লীগের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের ১৯ নম্বর সদস্যও মনে করেন- তিনিই সরকার। রাজপথে ট্রাফিককে থানা কমিটির সেক্রেটারিও প্রশ্ন করেন ‘তুই জানিস আমি কে?’ নির্বাহী বিভাগের ওসি ও ডিসিরা মনে করেন তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নন, তারা আওয়ামী লীগের আজ্ঞাবহ। বিচার বিভাগ দলীয় সরকারের মতো আজ্ঞা দেয়। জামিন না দিলে বিচারককে অপমান করে অথবা তাৎক্ষণিক বদলি করে দেয়। সবচেয়ে প্রকাশ্য ও প্রশ্নসাপেক্ষ ভ‚মিকা আইন ও শৃঙ্খলা বাহিনীর। তাদের শীর্ষ কর্তৃত্ব দলীয় নেতৃত্বের ভাষায় কথা বলে। তাদেরকে জনগণের জীবন, সম্মান ও সম্পদ রক্ষার যে পবিত্র দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। দেশের আইন ও শৃঙ্খলার বিষয়টি সবসময়ই সংবেদনশীল থেকেছে। সব সরকারের আমলেই কিছু না কিছু দৃষ্টিকটু বিষয় ঘটেছে। তবে বিগত ১৪ বছরে এ ক্ষেত্রে আর রীতি-নীতি, ভদ্রতা-সভ্যতার লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন। তারা মানুষকে অসম্মান করার কৃতিত্বে সম্মানিত হন। জনগণকে পেটানোর কৃতিত্বে পদক ধারণ করেন।
ক্ষমতাসীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশে হত্যা, গুম, খুন, যখম মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। প্রকাশিত প্রতিবেদনে এটি প্রতিপন্ন হয়, দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে আরো অনেক বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। বিগত বছরগুলোতে ক্রমবর্ধমানভাবে যখন গুমের সংখ্যা বেড়ে যায় তখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইন ও শৃঙ্খলা বাহিনীর অস্বীকার ওই তৃতীয় বাহিনী সৃষ্টির প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করে। ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে তিন ধরনের আলামত দৃশ্যমান হয়- ১. আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরাসরি গুম ও খুনের ইসতেমাল করছে। সরাসরি পোশাকে আবিভর্‚ত হয়ে তারা অপরাধ অস্বীকার করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক দিন পর আটকের ঘটনা স্বীকার করছে। ২. এ অবস্থার সুযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আদলে দুষ্কৃতকারীরা অপকর্ম করার সুযোগ নিয়েছে। ৩. আমাদের নিজস্ব আইন ও শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি বিদেশী এজেন্সিগুলোর সম্পৃক্ততা সন্দেহ আরো প্রবল হয়েছে।
সাম্প্রতিককালে মানবাধিকার সম্পর্কে পাশ্চাত্যের কঠোর মনোভাবের কারণে এর ব্যাপকতা কমেছে। তবে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ গল্প এখনো বহাল রয়েছে। আরো একটি গুরুতর অভিযোগ এই- আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেই নানা ধরনের অন্যায় ও অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। অন্যায়কারীকে আইনে সোপর্দ না করার যে অলিখিত নীতি সরকার অনুসরণ করছে তার ফলে এর প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায়ই দলীয় খুনি ও দুষ্কৃতকারীদের মাফ করার সংস্কৃতি আমাদের বিচলিত করছে। এ ক্ষেত্রে সাক্ষ্য হিসেবে আল-জাজিরার সেই বিখ্যাত প্রতিবেদনের ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ উদাহরণ দেয়া যায়। আইন ও শৃঙ্খলা বাহিনী তথা সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা নিয়ে বেশ কয়েক মাস আগে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়। ‘আয়না ঘর’ নামে সেই প্রতিবেদনের কথা সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে সংঘটিত একটি ঘটনা আইন ও শৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধ সম্পৃক্ততা সম্পর্কে নাগরিক সাধারণকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সংবাদপত্রের শিরোনাম এরকম-‘গভীর রাতে গাড়ি থামিয়ে ছিনতাই : র্যাব সদস্যসহ তিনজন গ্রেফতার।’ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর মহাখালী ফ্লাইওভারে র্যাব পরিচয়ে অপহরণ চেষ্টাকালে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গভীর রাতে গাড়ির গতিরোধ করে দুই ব্যক্তিকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দুই ব্যক্তি প্রাইভেটকারে করে যাচ্ছিলেন। রাত ২টায় তারা যখন মহাখালী ফ্লাইওভারের মাঝামাঝি পৌঁছান তখন পেছন থেকে একটি গাড়ি এসে তাদের গতিরোধ করে। ওই প্রাইভেটকারে থাকা চার ব্যক্তি নিজেদের র্যাব পরিচয় দিয়ে গ্রেফতার করে গাড়ির আরোহীদের। গাড়ির আরোহী দুজনকে হাতকড়া পরিয়ে দেয়া হয়। র্যাব নামধারীরা আরোহীদের মারধরও করে। তাদের আচরণে সন্দেহ হয় ভুক্তভোগীদের। তারা চিৎকার শুরু করেন। এ সময়ে এক পথচারী ঘটনাস্থলে এসে দুষ্কৃতকারীদের থামান ও পুলিশে ফোন দেন। পুলিশে ফোন দেয়ার পর চক্রটির সদস্যরা যে যেভাবে পারে পালিয়ে যায়। ওই সময় এক পুলিশ সদস্য চিৎকার শুনে ঘটনাস্থলে যান। পরে পুলিশ সদস্য ও স্থানীয়রা এক দুষ্কৃতকারীকে আটক করে বনানী থানায় সোপর্দ করেন। পরে বাকি দুজনকেও আটক করা হয়।
ওই মামলার বাদি শহীদুল ইসলাম বলেন, তিনি একজন ট্র্যাভেল এজেন্সি ব্যবসায়ী। তার মামা রিয়াজকে নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বাসায় ফিরছিলেন। মহাখালী ফ্লাইওভারে উঠতেই তাদের গাড়ির গতিরোধ করে পেছন থেকে আসা আরেকটি গাড়ি। ওই গাড়ির আরোহী চার ব্যক্তি র্যাব পরিচয়ে অস্ত্র দেখিয়ে গাড়ি থামিয়ে দেয়। এরা তাদের সোনা চোরাচালানকারী বলে অভিহিত করে। যখন আমরা বলি চেক করে দেখেন, তখন তারা গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এ সময় একজন পথচারী ৯৯৯-এ ফোন করেন। মোটরসাইকেলে তখন বাসায় ফিরছিলেন আরেক পুলিশ সদস্য। তিনি এগিয়ে এসে ভুক্তভোগীদের সহায়তা করেন। ধৃতদের একজন র্যাবের সাথে সম্পৃক্ত বলে জানান। গত কয়েক বছরে এ ধরনের অনেক ঘটনা সংবাদপত্রে এসেছে। খুব কম ক্ষেত্রেই প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা গেছে। ওই ঘটনায় র্যাবের সাথে সংশ্লিষ্ট একজন কিভাবে সম্পৃক্ত হলো তা একটি বড় জিজ্ঞাসা। এরকম বহু ঘটনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর নাম এসেছে। এতে তাদের দুর্নাম হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের আসামি র্যাব কর্মকর্তাদের দেশবাসী ভুলে যায়নি।
বর্তমান সরকারের আমলে এরকম বহু ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা র্যাবের সম্পৃক্ততা লক্ষ করা গেছে। র্যাবের সুনাম নষ্টকারী কোনো ঘটনা সহজে গ্রহণ করা যায় না। দেশ-বিদেশে প্রাথমিকভাবে দক্ষতা-যোগ্যতার প্রমাণ দিলেও পরবর্তীকালে র্যাব নিয়ে গুরুতর বিতর্ক সৃষ্টি হয়। র্যাব শুধুই যে দুর্নাম কামিয়েছে এরকম নয়; তাদের ভালো কাজেরও কিছু রেকর্ড আছে। পাশ্চাত্যের বিধি-নিষেধ ও দেশজ গণপ্রতিক্রিয়াদৃষ্টে র্যাবের অবলুপ্তি, পুনর্গঠন ও সংস্কারের বিষয়টি এখন বিবেচনার দাবি রাখে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]