- সালাহউদ্দিন বাবর
- ২৬ নভেম্বর ২০২২
– ছবি : নয়া দিগন্ত
যেকোনো স্থানে ব্যক্তিবিশেষ রাজনৈতিক দল বিশেষের এটি যদি তাদের ইন্টেনশান তথা উদ্দেশ্য থাকে তার রাষ্ট্রক্ষমতা কোনো প্রকারে ক্ষমতা কব্জা করতে সক্ষম হয়। তবে যে করেই হোক সে ক্ষমতাকে দীর্ঘ সময় নিজেদের মুঠোয় ধরে রাখতে চায়। তবে তাদের চিন্তা-চেতনায় প্রতি মুহূর্তে এমন কৌশল আঁটবে। সেটি হয়তো এমনই হতে পারে; দেশ ও দশের সেবা তাদের কল্যাণের চিন্তাভাবনা ও কর্ম প্রয়াস থাকবে একেবারে ফোর্থ বা থার্ড ক্যাটাগরিতে তথা চতুর্থ অথবা তৃতীয় স্তর বিন্যাসে। প্রথম স্তরের চিন্তায় স্থান পাবে জনগণকে কিভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখা যায়, সে জন্য অলীক স্বপ্ন-খোয়াব দেখিয়ে বিভোর রাখা। মানুষের নাকের ডগায় মুলা ঝুলিয়ে তাদের দূর-দূরান্তে নিয়ে চলা। এক স্বপ্ন উবে যাওয়ার আগে ভিন্ন স্বপ্নে জাল বুনতে থাকা। ইত্যবসরে মানুষ কিন্তু সর্বস্বান্ত হতে থাকবে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় স্তরের ক্রম ধারায় থাকবে, ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষ অন্য সব রাজনৈতিক দলকে কিভাবে দমন-পীড়ন করা যায় ও তাদের আত্মরক্ষার জন্য ব্যতিব্যস্ত করে রাখা। আরো লক্ষ্য থাকবে, তাদের কেটে ছেঁটে ‘বনসাঁই’ বানান। এ ছাড়া পরিকল্পনায় থাকবে আমলা মুৎসুদ্দিদের ‘গুড হিউমারে’ রাখতে যতটা পারা যায় অনিয়ম করে, অন্যায্য অনিয়ম করে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বশংবদ করে রাখা। তারপর একদল অবিবেচক দলান্ধ ক্যাডার সৃষ্টি করে যাদের সব ধরনের চাহিদা নিমিষেই পূরণ করা হয়। এসব সুবিধাভোগীকে তারা ব্যবহার করে যখন বঞ্চিততৃষিত ক্ষুধার্ত জনতার পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ার পর, তাদের মধ্যে প্রতিবাদের মহাজাগরণ ও সুনামির মতো প্রলয় তৈরির পূর্বাহ্নে জনতাকে রোখার নিমিত্ত সম্মিলিতভাবে সবাই লঙ্কাকাণ্ড বাঁধানোর জন্য তৈরি রাখা যুগপৎ, যে কাজটি করতে থাকে সেটি হলো প্রচলিত সব বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, ইতিহাস ঐতিহ্য গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা নির্বাচনী বিধিব্যবস্থার অনুশীলনগুলো ছত্রখান করে দেয়া। পরিবর্তে প্রস্তুত থাকবে, যা তাদের অনুকূলে ও পছন্দের প্রহসন করা। এতে কারো কোনো ওজর-আপত্তি সহ্য করা হয় না। শক্তি-বল-কৌশলই তাদের শেষ কথা। এসব ক্ষেত্রে যারা নিপুণ নির্মম তাদের হাতে তৈরি হয় এক বধ্যসমাজ যে সমাজের চিত্রটা উপরে কিঞ্চিত আভাস দেয়া হয়েছে। তবে সেটি কোনো পূর্ণ অবয়ব নয়, যৎ কিঞ্চিত মাত্র।
গণতান্ত্রিক দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থায় ভিন্নতর এক শৈলী অনুসরণ করা হয়ে থাকে, যা আগের বর্ণিত সব বিধিব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো জনগণের মতামতকে শুধু মেনে নেয়াই নয়, তাকে শ্রদ্ধা-সম্মান করে থাকে। ভোটাধিকার চর্চার মাধ্যমেই রাষ্ট্রক্ষমতার পালা বদল হবে, তাতেই তাদের পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস। জনগণ যাদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা অর্পণ করে, সেই সরকারের তখন একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের সেবা-শুশ্রুষা করার জন্য ক্ষমতাসীনরা প্রতি মুহূর্তে তৈরি হয়ে থাকে তাদের সব বিষয় দেখাতে। জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন, সব মৌলিক অধিকারকে সমুন্নত করা, বৈষম্য বিভেদ দূর করা। মিডিয়ার স্বাধীনতায় তারা শুধু বিশ্বাসই করে না, মিডিয়ার ওপর সর্বক্ষণ সতর্ক দৃষ্টি ও কানকে খাড়া রাখে। কোথাও কোনো ব্যত্যয়ের খবর পাওয়া মাত্র তার প্রতিবিধানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকে। এভাবেই তাদের ক্ষমতার মেয়াদকাল পূর্ণ হওয়ার পর্ব। ফের জনগণের কাছে যায়, তাদের গ্রহণযোগ্য যাচাইয়ের লক্ষ্যে। ক্ষমতা চর্চার মেয়াদে তাদের দায়িত্ব পালন করা নিয়ে মানুষ সন্তুষ্ট কি না। যদি ইতিবাচক ফল আসে তবে দ্বিগুণ উৎসাহে দেশকে এগিয়ে নিয়ে নিবেদিত প্রাণ হয়ে ওঠে। এভাবেই বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশ পথ চলে থাকে।
উপরে দুই মেরুর দেশগুলোকে নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম। সেটি মূলত রাষ্ট্র পরিচালনা তত্ত্ব বিশেষ। তবে প্রথম পর্যায়ে যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হলো সে সারিতে বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশ অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় পর্যায়ে যে দেশগুলোর বৈশিষ্ট্যে কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সে তালিকায় পশ্চিমের দেশগুলো অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের অবস্থানটা কোন বলয়ে সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে যা প্রত্যাশিত সাদৃশ্য নয়। প্রথমে যে বলয়ের কথা বলা হয়েছে তার নেতিবাচক যে বৈশিষ্ট্যের বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে, তা আসলে দেশবাসীর বৃহত্তর অংশের জন্য ভোগান্তির, গ্লানি দুঃখ বেদনার অন্যতম কারণ। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার ওপর নির্ভর করছে আগামী দিনের এ দেশের মানুষের মুক্তি। স্বাধীনতা লাভের অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় অতিবাহিত হলেও সব প্রতিযোগিতায় দেশ কেবলই পিছিয়ে যাচ্ছে। হালে এমন কোনো ক্ষেত্রই অবশিষ্ট নেই যেখানে আমরা কেবল মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছি না। সে জন্য এটাকে শুধু বিপর্যয় বললেই সব বলা শেষ হবে না, এর আগে আরো একাধিক বিশেষণ সংযোজন করতে হবে। প্রতিটি দেশের ভিত্তি মূলে থাকে মধ্যবিত্ত সমাজ। আমাদের অনেক কিছু নিঃশেষ হওয়ার সাথে সাথে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। অথচ এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসে জ্ঞানী গুণী বোদ্ধা, বিবেচনাসম্পন্ন যোগ্য সক্ষম সব মানুষ, দেশ গড়ার জন্য যাদের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। খোঁজ নিলে জানা যাবে, যেখানে যত যোগ্য সক্ষম পারঙ্গম মানুষ রয়েছে, তাদের শতকরা নব্বই ভাগ উঠে এসেছে এই মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে। এরা ধসে গেলে দেশের কতটা ক্ষতি হবে- সেটি পরিমাপ করা কঠিন। অথচ দেশের কর্তৃপক্ষের সম্মুখেই এই সমাজ বিলীন হতে চলেছে। তাদের অর্থাৎ এখনকার হর্তাকর্তাদের অক্ষমতাই এ জন্য দায়ী।
বলা হয়েছে আমাদের অনেক কিছুই বিগত দেড় দশকে বিনষ্ট হয়েছে যা নিয়ে এর আগেও বহু কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সে বিষয়গুলো অবশ্যই বারবারই স্মরণ করতে হবে। এ জন্য যে এমন সব ব্যত্যয়ের কোনো প্রতিবিধানের ব্যবস্থা হয়নি। তাই পুনঃপুনঃ এ নিয়ে কথা জারি রাখা ছাড়া কোনো পথ নেই। কেউ শুনুক আর নাই শুনুক, কথা বলা শেষ করা যাবে না, কেউ তাদের দায়িত্ব ভুলে গেলেও সবাই দায়িত্ব পালনে গাফেল থাকবে, সেটা কোনোভাবেই বিবেকবানের জন্য শোভনীয় নয়। মধ্যবিত্ত সমাজের এমন দুরবস্থার আরো প্রভাব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বিশেষ করে দেশী শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের প্রধান গ্রাহক এই মধ্যবিত্ত সমাজ, কাপড়-চোপড় প্রসাধনী পণ্য এসব দেশীয় পণ্য। বিত্তবান ক্রয় করে না, তারা সব কিছু, বড় বড় বিপণি থেকে বিদেশী পণ্য ক্রয় করে থাকে। এসব পণ্য বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করেই আমদানি করতে হয়। ধনিক শ্রেণীর একটা থেকে দুটো হাঁচি হলেই চিকিৎসার জন্য ছুটে যান থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এসব স্থানে। পক্ষান্তরে মধ্যবিত্তরা দেশে থেকেই চিকিৎসা নিয়ে থাকে। এসব উদাহরণ থেকে এটা উপলব্ধি করা যায়, মধ্যবিত্ত হারিয়ে গেলে পরিস্থিতিটা কোন তিমিরে পৌঁছবে। সব দেশে মধ্যবিত্তের কদর আছে এবং উচ্চ নিম্ন বিত্তের মানুষদের তাদের অবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টা অনবরত চালিয়ে যায়। অথচ আমাদের উন্নয়নের ঠিক তার বিপরীত ঘটনা ঘটছে। নিঃসন্দেহে এটা দেশের হর্তাকর্তাদের বোধ বিবেচনায় রয়েছে, সেটি বিরাজমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বোঝার কোনো উপায় নেই।
শুধু অর্থনৈতিক কারণেই মধ্যবিত্তের মানুষ জীবন্মৃত হয়ে আছে, হয়তো নয়। অবশ্যই তা মৌলিক একটি বিষয় সন্দেহ নেই। তবে আরো অনেক কারণেই তারা বিপর্যস্ত। মধ্যবিত্তরা সমাজে সুস্থমুক্ত মূল্যবোধকে লালন করে এবং তাতে অটুট থাকতে ভালোবাসে। সেখানে অনিয়ম দুর্নীতি ও দেশের প্রতি কারো দায়িত্বহীনতা তাদের মনে প্রচণ্ড মর্মপীড়া দেয়, অথচ তাদের চার পাশে এখন অহরহ চলছে অনিয়ম, দুর্নীতি আর জাতীয় অর্থসম্পদের লুটপাট-পাচার। এসব অনিয়মের জালে তাদেরও জড়ানোর জন্য অহর্নিশ প্রচেষ্টা চালায় সব দুরাচারী, যারা আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে আছে এসব অপকর্মের ভেতর। এরা গোটা সমাজটাকে পুঁতিগন্ধময় করা তোলার হীনপ্রচেষ্টায়। আসলে এখন দেশের অর্থনৈতিক যে দুরবস্থা এর অন্যতম কারণ সেই ব্যক্তি যারা এই দেশকে বিন্দুমাত্র ভালোবাসে না তারা দেশের অর্থ পাচার করে বিদেশে ঠাঁই নেয়ার পাকা বন্দোবস্ত করছে। মধ্যবিত্তরা এসব কেবল নীরব দর্শকের মতো দেখছে। তাদের এসব প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করার মতো অবস্থা নেই। কেননা, তাদের আর্থিক সঙ্গতি এতটা খারাপ যে, উল্লিখিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করলে তাদের চাকরিচ্যুত হতে হবে। যে পরিবেশে তারা এখন অবস্থান করছে তাকে নিছক ঘৃণা করা ছাড়া আর কিছু করার উপায় নেই, সব পবিত্র মূল্যবোধের ওপর নিয়ত আঘাত আসছে।
একটা কথা বলে এসেছি মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে মেধাবী ও ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন যুবকরাই বেরিয়ে আসে; কিন্তু আজকে শিক্ষাঙ্গনের যে মারদাঙ্গা পরিস্থিতি বিরাজ করছে সে জন্য কারো পক্ষে এখন শিক্ষাজীবন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে শিক্ষাজীবন। আর শিক্ষা লাভ করতে বহু গুণ বেশি অর্থের প্রয়োজন হয় এখন যা মধ্যবিত্ত সমাজের ছাত্রদের অভিভাবকদের পক্ষে সন্তানদের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থার কারণে মধ্যবিত্তের সন্তানরা নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর হতাশা ও গ্লানির ভেতর ডুবতে বসেছে। সে ক্ষেত্রে তাদের জ্ঞানগরিমা কিভাবে বিকশিত হবে? হয়তো এমনও দিন আসতে পারে যখন মধ্যবিত্তের অহঙ্কার জ্ঞান ও গরিমা, সেটি তাদের কাছ থেকে হারিয়ে যেতে পারে যা শুধু ব্যক্তির নয় রাষ্ট্র একটি জ্ঞানশূন্য জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল হয়ে দাঁড়াতে পারে। অথচ আজকের বিশ্বে বেঁচে থাকতে হলে জ্ঞানের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। মধ্যবিত্তের আরো দুর্দশার কথা বলা যায়; কিন্তু যারা নিম্নবিত্তের মানুষ তাদের দুঃখ গ্লানির যে কাহিনী, সে তো কম বেদনার নয়; বরং কিছু বেশি। আর এই জনপদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তো তারাই।
ক্ষমতাধররা একটি কথা খুব বড়াই করে বলে। তাদের রাজনীতি লক্ষ্য নিম্নবিত্তের মানুষের জীবনমান বৃদ্ধি, তাদের মলিন চেহারা উজ্জ্বলতর করা। কিন্তু যে তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান হাতে পাওয়া যায় সেখানে এই সত্যটা শুধু পাওয়া যায়, দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ আরো একধাপ নিচে নেমে গিয়ে হতদরিদ্র হয়ে পড়ছে। বলা হচ্ছে, এই হতদরিদ্রদের জন্য ঢাকায় ওএমএস ট্রাক পণ্য বোঝাই করে শহরময় ঘুরছে। কিন্তু পত্রপত্রিকার খবর হচ্ছে যে, এই ওএমএসে ট্রাকের লাইনে মধ্যবিত্তদের সংখ্যাও কম নয়। না হয় বুঝলাম, এখানে দরিদ্ররাই পণ্য কিনতে যায়। কিন্তু বিপুল আয়তনের এই মহানগরীতে ক’টি ট্রাক ওএমএস পণ্য ফেরি করছে? ঢাকায় এখন প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস, আর এই বিপুল জনসমষ্টির বেশির ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে। তা হলে জানতে ইচ্ছে করে, কত শত ট্রাক ওএমএস পণ্য নিয়ে ঢাকায় ঘোরাফেরা করছে? একটি বহুল প্রচলিত কথা রয়েছে ৯টার ট্রেন ক’টায় ছাড়ে, এমনও খবর রয়েছে ওএমএস ট্রাকের আসা-যাওয়ার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। তবে কি এসব একান্তই লোক দেখানো কর্মকাণ্ড যা কি না দরিদ্র মানুষকে পরিহাস করার শামিল?
তবে এ কথা সত্য, দেশে এবং এই শহরে অবশ্যই কিছু ভাগ্যবান মানুষ বসবাস করে। দেশের আজকের নজিরবিহীন পরিস্থিতি কিন্তু তাদের স্পর্শ করছে না। কোনো শোকতাপ সেখানে তাদের ননীর শরীরকে কষ্ট দিচ্ছে না। কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপে সেখানে চিরবসন্ত বিরাজ করে। এসব ভাগ্যবানদের আগলে রাখা হয় যাতে তাদের ননীর শরীর গলে না যায়। ফুলের টোকা যেন না লাগে। হ্যাঁ, এমন বৈষম্যের সমাজেই এই দেশবাসীকে এখন বসবাস করতে হয়। সেই ভাগ্যবানদের ক্ষুধা পেলে অমৃত আসে, আর নিম্নআয়ের সবার ক্ষুধা পেলে উপুড় হয়ে শুয়ে পেটের নিচে বালিশ দিয়ে থাকতে হয়। যাদের ভাগ্যের বাতাবরণ সুবিন্যস্ত করতে তো কিছু নয়ছয় করতে হয়। কিন্তু বিভেদের সৃষ্টির জন্য সমাজকে এমনভাবেই ঢেলে সাজানো হয়েছে। কেউ ভুরি ভুরি পাবে আর কেউ একেবারেই পাবে না। একে নিয়তির খেলা বললে ভুল করা হবে। কেননা নিয়তি নৈর্ব্যক্তিক। সে এক চোখে নুন আর এক চোখ বণ্টন করে না। এসব বরং যারা সমাজ বিনির্মাণের কারিগর, তাদের কারসাজিতে উঠানো নামানো হয়েছে।
যারা আজকের পরিবেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং এর পরিবর্তনের বাসনা পোষণ করেন তারা নিশ্চয়ই বিজ্ঞ অভিজ্ঞ এবং দেশদরদি। তারা অবশ্যই জানেন কিভাবে কোথায় কতটুকু পরিবর্তনের প্রয়োজন। এই মুহূর্তেই তাদের হাতিয়ার হওয়া উচিত দক্ষ যোগ্য সক্ষম ন্যায়নিষ্ঠতা এবং প্রতিক্ষণে দেয়ালে লিখন পাঠ করতে, কোনো ব্যত্যয় নিয়ে অনুকম্পা প্রদর্শনের এতটুকু সুযোগ নেই। এই জনপদের প্রতিটি মানুষ গণতন্ত্র, শান্তি, স্থিতি, সহনশীলতার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আজো আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষকে কেবলই জনতা করে রাখা হয়েছে। যাতে তাতে নিয়ত ঠকানো বিড়ম্বিত করা যায়। তারা তাদের অধিকার নিয়ে কখনোই জেগে উঠতে না পারে সে জন্য দেড় দশক ধরে যত মেকি স্বপ্ন খোয়াব দেখিয়ে রাখা হয়েছে। এখন সব উল্টে দিতে হবে, যারা নিচে পড়ে আছে তাদের টেনে তুলতে হবে।