যে কারণে উপজেলায়  নৌকা দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ১২দিন পরই সোমবার দলের কার্যনির্বাহী সংসদের জরুরি বৈঠক ডাকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। জরুরি বিধায় নির্দিষ্ট কোনো এজেন্ডার কথা জানানো হয়নি সংশ্লিষ্টদের  কার্যনির্বাহী সংসদের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা কোনো এজেন্ডার বিষয় আগে থেকে নিশ্চিত করতে পারেননি।  বৈঠক শুরু হওয়ার পরই এজেন্ডার বিষয়টি জানতে পারেন নেতারা। দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা দেয়া হবে কি হবে না সে বিষয়টি উত্থাপন করেন। এরপর তিনি সংশ্লিষ্টদের মতামত চান।  বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন নেতা মানবজমিনকে জানান, দলীয় প্রতীকের বিষয়টি নিয়ে একাধিক নেতা বক্তব্য রাখেন। তাদের প্রত্যেকেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ইস্যু নিয়ে কথা বলেন। পাশাপাশি কেউ কেউ নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। তারা জানান, বৈঠকে উপস্থিত কোনো নেতা উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা বরাদ্দ দেয়ার পক্ষে কথা বলেননি। সবমিলিয়ে নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে উপজেলা নির্বাচনে নৌকা প্রতীক না থাকার সিদ্ধান্তের কথা জানান দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা।

বৈঠকে নৌকা প্রতীক না দেয়ার জন্য দুটি কারণ উল্লেখ করা হয়। প্রথম কারণ হলো, সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা এড়ানো ও দ্বিতীয় কারণ হলো, স্থানীয় নির্বাচনকে উৎসবমুখর ও অংশগ্রহণমূলক করা। যুক্তি তুলে ধরে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সব নেতা বলেন, কদিন আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় তৃণমূলে বিভেদ তৈরি হয়েছে। এখন স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে একজনকে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দিলে অন্যরা স্বতন্ত্র ভোট করবে। এতে বিভেদ আরও বাড়বে। বরং উন্মুক্ত করে দেয়াই ভালো হবে।

 

এরপর দলের সভাপতি শেখ হাসিনা সবার মতামতের প্রতি সমর্থন করেন। তিনি বলেন, আপাতত স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয়ভাবে কাউকে মনোনয়ন দেয়া হবে না। এতে ভোট উৎসবমুখর ও অংশগ্রহণমূলক হবে। যিনি জনপ্রিয় প্রার্থী, তিনিই জয়ী হয়ে আসবেন। বিষয়টি নিয়ে দলের মনোনয়ন বোর্ডকে অবহিত করা হবে বলে জানান তিনি। সোমবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির জরুরি সভা শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, উপজেলা নির্বাচনে আমরা দলের প্রতীকের প্রার্থিতা দেবো কিনা… এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওয়ার্কিং কমিটি প্রায় সর্বসম্মত যে, এবারের উপজেলা নির্বাচনে আমাদের দলীয় প্রতীক নৌকা ব্যবহার করা হবে না। নৌকা না দেয়ার জন্য ওয়ার্কিং কমিটির সভায় এখন অভিমত পেশ করেছে। আমাদের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, সবার অভিমতের সঙ্গে তিনি ভিন্নমত প্রকাশ করেন না।

তিনি বলেন, যেহেতু সবাই এখানে একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। আপাতত এটা ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত। ওয়ার্কিং কমিটি যেটা সিদ্ধান্ত নেয়, মনোনয়ন বোর্ড সেই সিদ্ধান্ত বহাল করে। এটা মনোনয়ন বোর্ডের আনুষ্ঠানিকতা। সেই আনুষ্ঠানিকতার আগে বিষয়টি নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না। একই প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণমূলক দেখানোর কৌশলগত পদক্ষেপ নিইনি, নির্বাচনকে সর্বজনীন করার জন্যই দলীয় প্রতীক থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচন সর্বজনীন করা হলে উপজেলা পর্যায়ে সঠিক নেতৃত্ব উঠে আসবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে করেন। আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে নির্বাচনে প্রতীক না দিলে কারও কিছু বলারও থাকবে না। তিনি আরও বলেন, বিএনপি-জামায়াত যদি উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে তাও আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করবে না। তাছাড়া উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বা দলীয় মনোনয়ন দেয়া না হলে আইনি কোনো জটিলতা হবে না। বিএনপি’র নির্বাচনে আসা নিয়ে জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসলে স্বাগত জানাই। এখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে আসবে কিনা, এর সঙ্গে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই। আওয়ামী লীগের বেশ কয়েক নেতা মানবজমিনকে বলেন, আওয়ামী লীগের এই দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের প্রধান কারণ হলো দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল সামাল দেয়া।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ এবার সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। যারা দলের মনোনয়ন পাননি তাদেরকেও নির্বাচনের সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল স্বতন্ত্রভাবে। এজন্য আওয়ামী লীগ কারও বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে না এমন ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। সেই প্রেক্ষিতে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হিড়িক পড়ে। প্রচুর স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং রেকর্ড সংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী এবার নির্বাচনে জয়ী হন। কিন্তু এই জয়ের পরে সারা দেশে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রবল আকার ধারণ করেছে। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক এবং উৎসবমুখর করার জন্যই আওয়ামী লীগ জেনে বুঝে এই ঝুঁকি নিয়েছে। কিন্তু এই ঝুঁকির পর এখন সারা দেশে আওয়ামী লীগের কোন্দল এবং বিরোধ ছড়িয়ে পড়েছে। এরকম বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনের জন্য উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরকম বাস্তবতায় উপজেলা নির্বাচনে দলের কোন্দল এবং বিরোধ কিছুটা প্রশমিত হবে বলে ধারণা করছেন দলীয় নেতারা।

এদিকে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন শেষ করতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। স্থানীয় সরকারের এ ভোটে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পদ্ধতি ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে কমিশনের। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর এসব পরিকল্পনার কথা জানান। মো. আলমগীর বলেন, উপজেলা নির্বাচন করার সময় যেটা, সে সময়টা চলে এসেছে। সামনে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে যাচ্ছে। এরপর রোজা। রোজার মধ্যে তো নির্বাচন করা সম্ভব না। ঈদের পরপরই যাতে নির্বাচন হয় সেইভাবে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হয়ে মে মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যে শেষ করবো। তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যালটেও হতে পারে আবার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) হতে পারে। আবার ব্যালট-ইভিএম দুটোর সমন্বয় থাকতে পারে। এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।

মানব জমিন