যেভাবে সাড়ে ৪ হাজার টাকা বেতন থেকে মো. শাহরিয়ারের টার্নওভার ৪৫ মিলিয়ন ডলার

২০০৭ সালে মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টাকা বেতনে পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট অ্যাক্সেসরিজ প্রস্তুতকারী একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন মো. শাহরিয়ার।

তার বয়স এখন ৩৪ বছর। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি। এ পর্যন্ত সংগঠনটির সভাপতি নির্বাচিত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সী সভাপতি।

সংগঠনটির ৩৩ বছরের ইতিহাসে শাহরিয়ারই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ভোটাভুটির মাধ্যমে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। সংগঠনটিতে প্রায় এক হাজার সক্রিয় ব্যবসায়ী রয়েছেন। তার নির্দেশনায় সংগঠনটি রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্যাকেজিং উপকরণ, ট্রিম ও অ্যাক্সেসরিজ তৈরি করছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে সংগঠনটির সদস্যরা দেশের রপ্তানি শিল্পে ৮.১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবদান রেখেছেন, যার মধ্যে ১.১২ বিলিয়ন ডলার এসেছে সরাসরি রপ্তানি থেকে।

সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার আগে শাহরিয়ার দুবার সংগঠনটির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি তরুণ পোশাক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাপারেল ইয়ুথ লিডারস অ্যালায়েন্সের (বিএওয়াইএলএ) প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক।

বর্তমানে সাতটি ব্যবসায়িক ইউনিটের মাধ্যমে শাহরিয়ারের কোম্পানির বার্ষিক টার্নওভার ৪৫ মিলিয়ন ডলার। পরিবারের কাছ থেকে আর্থিক কোনো সহযোগিতা ছাড়াই তিনি এটি করে দেখিয়েছেন।

‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একদিন আমি নিজের কোম্পানি চালাব’

শাহরিয়ারের বেড়ে ওঠা পটুয়াখালী সদরে। তখন তিনি সবেমাত্র চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। ওই সময় একটি ঘটনা তার মনে উদ্যোক্তা হওয়ার বীজ বুনে দেয়।

স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ছেলে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। আর শাহরিয়ারের পরিবারের সদস্যদের বেশিরভাগই ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। শাহরিয়ার একদিন তার প্রধান শিক্ষকের ছেলের কাছে তার বেতন জিজ্ঞাসা করেছিলেন। জবাবে জানতে পারলেন তার বেতন ৩৫ হাজার টাকা। ওই সময়ে ৩৫ হাজার টাকা বেতন শুনে বেশ অবাক হয়েছিলেন শাহরিয়ার।

শাহরিয়ারের কৌতূহল আরও বেড়ে যায়। তিনি এ বিষয়ে আরও খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন, সিনিয়র এক্সিকিউটিভদের বেতন আরও বেশি। এর চেয়েও বেশি শীর্ষ নির্বাহীদের। তাদের বেতন এক লাখ ১০ হাজার টাকা। এ থেকেই শাহরিয়ারের মনে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন তৈরি হয়।

শাহরিয়ার বলেন, ‘সেদিন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমি একদিন আমার নিজের কোম্পানি চালাব। আমি এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলাম, যেখানে অনেকেই আমার কোম্পানিতে চাকরি করবে।’

সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর শাহরিয়ারের বাবা সাপ্লাই বিজনেস শুরু করেছিলেন। এ ব্যবসার কারণে ১৯৯৮ সালে সাভারের নবীনগরে চলে আসে তার পরিবার।

নবীনগরে থাকার সময় একদিন বাবার সঙ্গে শাহরিয়ারের মনোমালিন্য হয়। তাই তিনি বাড়ি ছেড়ে কিছুদিনের জন্য নারায়ণগঞ্জে বন্ধুদের কাছে চলে যান। তিনি সেখানে একমাস ছিলেন এবং কয়েকদিনের জন্য তার চাচার ব্যবসাও সামলে ছিলেন। ওই সময় তিনি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন।

তখন শাহরিয়ার তার এক পরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে একটি চাকরির বিষয়ে জানতে পারেন। কোম্পানিটি ছিল পাক্সার বাংলাদেশ। এটি একটি অ্যাক্সেসরিজ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। সেখানে তিনি কোয়ালিটি অফিসার হিসেবে যোগ দেন।

চাকরিতে থাকা অবস্থায় তিনি উচ্চশিক্ষা নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও কর্মজীবনে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়ার জন্য একসময় পড়ালেখা বন্ধ করে দেন। অবশ্য পরবর্তীকালে তিনি প্রাইম ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

পাক্সার বাংলাদেশে দুই বছর চাকরি করার পর শাহরিয়ার অ্যাক্সেসরিজ উৎপাদনকারী একটি স্থানীয় কোম্পানিতে প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে ১৫ হাজার টাকা বেতনে যোগ দেন।

উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা

এর চার বছর পর শাহরিয়ার বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের কার্যক্রম তত্ত্বাবধানের জন্য কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে এলিট প্রিন্টিং ইঙ্ক নামে একটি ব্রিটিশ কোম্পানিতে যোগ দেন।

এ কোম্পানিতে চাকরির সময় শাহরিয়ার একটি ফার্ম শুরু করেন। এখান থেকে অ্যাক্সেসরিজ নির্মাতাদের জন্য যন্ত্রপাতি, প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও রাসায়নিক সরবরাহ করা হতো। এরপর তিনি অন্যদের সঙ্গে যৌথভাবে দুটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন।

এলিট প্রিন্টিংয়ে মাসিক তিন হাজার ইউরো বেতনে চাকরি ও ফার্ম চালানোর সময় একদিন শাহরিয়ার কসমো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছ থেকে একবার অপ্রত্যাশিতভাবে আমন্ত্রণ পান। তার সঙ্গে বৈঠকে স্টিকার ও গাম টেপ তৈরির একটি যৌথ উদ্যোগের প্রস্তাব পান শাহরিয়ার।

আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকায় প্রাথমিকভাবে দ্বিধায় পড়েছিলেন শাহরিয়ার। শেষ পর্যন্ত ৮ লাখ টাকায় কোম্পানির ১৫ শতাংশ শেয়ার লাভ করেন তিনি। এরপর ঈশ্বরদী ইপিজেডে ফুজিয়ান এক্সপোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজের নির্মাণকাজ শুরু হলেও বিভিন্ন কারণে তা বিলম্ব হতে থাকে। পরবর্তীকালে কসমো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের উদ্যোগে গাজীপুরে ভিক্টোরিয়া ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি নামে আরেকটি ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়, যেখানে শাহরিয়ারের শেয়ারের পরিমাণ ২০ শতাংশ।

শাহরিয়ার বলেন, ‘গাজীপুরে কারখানা স্থাপন করার জন্য কঠিন প্রচেষ্টার প্রয়োজন ছিল। আমি ভোর ৬টায় বাড়ি থেকে বের হতাম এবং প্রায়ই ১৮ ঘণ্টা কাজ করতাম। এতটাই চাপ ছিল যে আমি টানা কয়েক রাত কারখানার সোফাতেই কাটিয়ে দিয়েছি।’

কিছুদিন পর শাহরিয়ার তার শেয়ার ছেড়ে দেন এবং রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পের তিনি নিজের অ্যাক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং পণ্য তৈরির কারখানা চালু করেন। এ কাজে তাকে সহায়তা করেছিলেন তারই বন্ধু শিকদার সফিউজ্জামান। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় আদজি ট্রিমস লিমিটেড। প্রথম কারখানাটি ২০১৬ সালে তুরাগে চালু করা হয়েছিল। এটি চালু করার জন্য দুটি ব্যাংক ও স্পেনের এক বায়ারের কাছ থেকে সহায়তা পেয়েছিলেন তারা।

শাহরিয়ার সে সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘ফ্যাক্টরির প্রথম দিনগুলোতে আমি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘আর্থিক সংকট ছিল। অনেক দিন আমাকে নিজের টাকা থেকে কারখানার ডিজেল কিনতে হয়েছে। তবে অধ্যবসায় এবং প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধীরে ধীরে আরও বেশি করে জানার মধ্য দিয়ে আমরা দ্রুত উন্নতি করতে পেরেছি।’

মাত্র চার বছরে আদজি ট্রিমস লিমিটেড অ্যাক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং শিল্পের একটি শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিতে পরিণত হয়, যার দুটি কারখানা বিসিক শিল্পনগরী ধামরাই এবং আরেকটি তুরাগ এলাকায় অবস্থিত।

কোম্পানিটি জারা, ম্যাঙ্গো, পুল অ্যান্ড বিয়ার এবং অ্যালকোড ইংলিশসহ ৩১টি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জন্য অ্যাক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং তৈরি করছে। তাদের পণ্য সরাসরি ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান, মরক্কো, পর্তুগাল এবং স্পেনের মতো দেশে রপ্তানি হয়।

আদজি ট্রিমস বর্তমানে ওভেন লেবেল ও ট্যাগ, টুইল টেপ এবং কাগজের মোড়কসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে। সেইসঙ্গে এনভায়রোনমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটি বাড়াতে বায়োডিগ্রেডেবল পলি ব্যাগও তৈরি করছে। এটি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (আরএফআইডি) লেবেল ও ট্যাগ প্রস্তুতকারী দেশের গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শাহরিয়ার অ্যাক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং পণ্যের পাশাপাশি কৃষিপণ্যেও বিনিয়োগ করেছেন। তার সার ও কীটনাশক উৎপাদনের তিনটি কোম্পানি রয়েছে।

২০২৫ সালের মধ্যে বার্ষিক আরও ২০ মিলিয়ন ডলার টার্নওভারের প্রত্যাশা

শাহরিয়ার তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য ট্রিম, অ্যাক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং খাতের গ্রাহকদের ওয়ান স্টপ পরিষেবা দেওয়ার বিষয়ে মনোযোগ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা জিপার, বোতাম, কার্টন ও সেলাইয়ের সুতা ছাড়া সব ধরনের পণ্য উত্পাদন করি। আগামী বছরের মধ্যে জিপার এবং বোতাম উত্পাদন শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে৷’

এজন্য আদজি ট্রিমস লিমিটেড ধামরাইয়ে ৪৬ বিঘা জমিতে একটি শিল্প পার্ক গড়ে তুলছে। তুরাগের পুরনো কারখানাটি এখানে স্থানান্তর করা হবে। চলতি বছরের নভেম্বরের মধ্যেই সেখানে উৎপাদন শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সেইসঙ্গে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ জিপার উৎপাদন শুরুর জন্য আমেরিকান কোম্পানি টেলন জিপার্সের সঙ্গে একটি চুক্তিও হয়েছে তাদের।

শাহরিয়ার বলেন, ‘নতুন প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত এক হাজার মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান হবে।’

তিনি আশা করেন, ২০২৫ সালের মধ্যে তার কোম্পানির টার্নওভার ৬৫ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। শিল্প পার্কটিও আরও বাড়িয়ে ৬৫ বিঘা করা হবে।

Tbs