কামাল আহমেদ : নৃশংসতার শিকার হয়ে যাঁরা প্রাণ হারান, তাঁদের মৃত্যুতে কষ্ট পায় না, এমন মানুষ বিরল। সব সহিংসতাই তাই নিন্দনীয় এবং সবারই তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কথা। গত ২৮ অক্টোবরের রাজনৈতিক সহিংসতা এবং তার প্রতিক্রিয়ায় আরও সহিংসতার ধারাবাহিক ঘটনাক্রমে তাই স্বাভাবিকভাবেই আমরা সবাই উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত।
কিন্তু গাজায় দখলদার ইসরায়েলিদের নৃশংসতার সঙ্গে ঢাকার ২৮ অক্টোবরের রাজনৈতিক সহিংসতার যাঁরা তুলনা টেনেছেন, তাঁরা ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রামের সীমাহীন ত্যাগ এবং চলমান গণহত্যার প্রতি যে অবিচার করেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এ রকম চরম অসম তুলনার পটভূমিতে আমরা কি বোকার মতো জানতে চাইতে পারি, ঢাকার ঘটনায় কোন পক্ষকে কার সঙ্গে তুলনা করা হলো? মারমুখী পুলিশের যে নিষ্ঠুরতা এবং তাদের পাশাপাশি ‘শান্তি’র লাঠিধারীদের হামলা, হতাহতের পরিসংখ্যান, গ্রেপ্তার এবং গণহারে মামলার খবর ও ছবি দেখে ধন্দে পড়ে যাই। দুর্ভাবনা তৈরি হয়, তাহলে কি প্রতিপক্ষ নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত এগুলো থামবে না?
দুই.
২৮ অক্টোবর ঢাকায় কী ঘটেছিল, তা নিয়ে সরকারি ভাষ্য ও বিএনপির ভাষ্য সম্পূর্ণ আলাদা এবং বিপরীতমুখী। নয়াপল্টন ও তার আশপাশে সংঘাত যখন চলছিল, তখন মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সরাসরি না হলেও অল্প সময়ের ব্যবধানেই কিছু বিবরণ পাওয়া যাচ্ছিল। ইন্টারনেট–সেবা বিঘ্নিত হলেও নানাভাবে সেসব ঘটনার ছবি ও ভিডিও সবার কাছে পৌঁছে গেছে, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। এসব ছবি দেখে প্রশ্ন ওঠে, পুলিশ কি শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় যথাযথ ভূমিকা রেখেছে?
তাদের কৌশল কী কাজ করেছে? শান্তি বজায় রেখে সমাবেশ করতে দেওয়ার ব্যবস্থা ও প্রস্তুতি থাকলে এত বড় একটি সমাবেশে এক প্রান্তের একটি হাঙ্গামা নিয়ন্ত্রণের বদলে পুরো সমাবেশ কেন ভেঙে দিতে হলো? শক্তি প্রয়োগে জনসমাগম ভাঙতে হলে তা যে কখনোই ভালো হয় না, তার ভূরি ভূরি নজির থাকা সত্ত্বেও সেই পথ অনুসরণ মোটেও স্বাভাবিক নয়।
বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পটভূমিতে দলটি ও তার সহযোগীরা হরতাল ও অবরোধের যেসব কর্মসূচি দিয়েছে, সেগুলো মোকাবিলায়ও পুলিশকে একটু বেশিই মারমুখী দেখা যাচ্ছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদও বিবৃতি দিয়ে পুলিশের শক্তি প্রয়োগে আইনের মূলনীতি অনুসরণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে।
জাতিসংঘ সংস্থাটির বিবৃতিতে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলায় এমন কিছু ব্যক্তির জড়িত থাকার কথা বলা হয়েছে, যারা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক। সেদিনের ঘটনার বিবরণ যা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে প্রধান বিচারপতির বাসভবন, ফকিরাপুল, পুলিশ হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি জায়গায়। কিন্তু ‘ক্রাইম সিন’ হিসেবে অন্য কোনো স্থান সংরক্ষণ না করে শুধু বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে বেছে নেওয়ায় তদন্তের নিরপেক্ষতা কি প্রশ্নবিদ্ধ হয় না?
বিএনপি হরতাল ঘোষণার পর সমকাল–এ পুলিশ কমিশনারের উদ্ধৃতি পড়েছি, হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার, তবে বিশৃঙ্খলা করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু মিছিল দেখলেই পুলিশকে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে, তা মোটেও স্বাভাবিক নয়। বিক্ষোভকারীদের প্রতিবাদ জানানোর স্বাভাবিক পথকে শক্তি প্রয়োগে রুদ্ধ করার অর্থ হচ্ছে তাদের অস্বাভাবিক পথে ঠেলে দেওয়া, যা কখনোই কাম্য হতে পারে না।
ক্ষমতাসীন দল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে পুলিশকে ব্যবহার করছে বলে যে অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে শোনা গেছে, এসব ঘটনা সেই অভিযোগকে নতুন করে সামনে নিয়ে আসছে। নির্বাচনের মাস তিনেক আগে এ ধরনের আচরণ পুলিশের প্রতি পক্ষপাতিত্বের প্রশ্নকে আরও বিশ্বাসযোগ্যতা দেবে। নির্বাচন কীভাবে হবে এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক রাজনীতিতে অচলাবস্থা তৈরি করে রেখেছে, পুলিশের পক্ষপাত তাতে আরও জটিলতা বাড়াবে।
গ্রেপ্তার-নিপীড়নের চাপে বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে বাধ্য করা যদি সরকারের লক্ষ্য হয়, তাহলেও বলতে হবে, পুলিশের বাড়াবাড়ি রকম শক্তি প্রয়োগ বরং বিরূপ প্রভাব তৈরির সম্ভাবনাই বেশি। গণহারে নির্যাতনের শিকার তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের কাছে আপস তখন কীভাবে গ্রহণযোগ্য হবে? ২০১৮ সালেও একই রকম নিপীড়ন ও হয়রানির মুখে সংলাপের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস রেখে তারা নির্বাচনে যাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা কীভাবে ভুলবে?
তিন.
২৮ অক্টোবর থেকে যে রাজনৈতিক সহিংসতা আলোচিত হচ্ছে, তার সূত্রপাত যেমন সেদিন হয়নি, তেমনি তার উৎস নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক অচলাবস্থারও নিরসন ঘটেনি। অংশীদারত্বমূলক, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রশ্ন মীমাংসা না করে বিরোধী দলকে দমনের প্রক্রিয়া জোরদার করলে তার পরিণতি কী হতে পারে? ৩১ অক্টোবরের সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা থেকে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। নির্বাচন সময়মতো হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচন এভাবে তারা থামাতে পারবে না।
নির্বাচন কমিশনও একই দিন জানিয়ে দিয়েছে, তাদের সামনে কোনো বিকল্প (অপশন) নেই। সময়মতো নির্বাচন হবে। কমিশন এ ক্ষেত্রে আরও সরস বলে মনে হয়। এত দিন তারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আর কোনো আলোচনা নয় বলে এলেও হঠাৎ তাঁরা এখন নিবন্ধিত ৪৪ দলকে সংলাপে ডেকেছেন। সরকার যখন কারও সঙ্গে সংলাপ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে, বিএনপিসহ তার মিত্ররা যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্ন ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনায় রাজি নয়, তখন নির্বাচন কমিশনের সর্বদলীয় সভা আহ্বানের উদ্যোগের উদ্দেশ্য কী, তা বোঝা মুশকিল।
সর্বদলীয় সভায় কি তাঁরা নির্বাচনের আচরণবিধি বয়ান করবেন? নাকি রাজনৈতিক ঐকমত্য সন্ধান করবেন? নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়নি বলে তাঁরা যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেই পরিবেশ তৈরির ব্যবস্থা করতে তাঁরা কি সরকারকে কিছু বলেছেন? না হলে নির্বাচনের পরিবেশহীন পরিবেশে সর্বদলীয় সভায় কী সমাধান মিলবে?
ভালো নির্বাচন করার জন্য আমাদের নির্বাচন কমিশন যে আইনগতভাবে যথেষ্ট ক্ষমতাবান, প্রতিবেশী দেশগুলোর সাবেক ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের কাছ থেকে গত সপ্তাহে এমন সার্টিফিকেট পাওয়ায় কমিশন হয়তো বেশ আত্মতৃপ্তি অনুভব করছে। তাদের এই ক্ষমতা নিয়ে কেউ কখনো সন্দেহ করেছে বলে মনে পড়ে না। বরং তাদের বিরুদ্ধে বরাবরের অভিযোগ, তারা ওই ক্ষমতা স্বাধীনভাবে নিরপেক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগ করে না, বরং ক্ষমতাসীন দলের প্রতি পক্ষপাত এবং দলীয় প্রভাবাধীন প্রশাসনের ওপর নির্ভরতাকেই শ্রেয় জ্ঞান করে।
আগের দুই নির্বাচনের যেকোনো একটি মডেলের পুনরাবৃত্তি বা তার কাছাকাছি কিছু একটা ঘটানোর চেষ্টা যে চলছে, তার আলামত অনেক দিন ধরেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কথিত একাধিক ‘কিংস পার্টি’র তর্জন-গর্জনে তা বেশ ভালোই বোঝা গেছে।
কিন্তু তারা যে বিএনপির বিকল্প নয় এবং রাজনীতির প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর একটিকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন যে অংশগ্রহণ ও বৈধতার সংকটে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শুধু যে যুক্তরাষ্ট্রই চাপ দিচ্ছে, এমন ধারণাও যে ঠিক নয়, তা নিশ্চয়ই সাত দেশের যৌথ বিবৃতিতে স্পষ্ট হয়েছে। আর ওই সাত দেশের মধ্যে এশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার অন্তর্ভুক্তি ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জেরও ইঙ্গিত বহন করে।
- কামাল আহমেদ সাংবাদিক
- প্রথম আলো