Prothom Alo
শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ভারত–পাকিস্তানের যুদ্ধ বা সংঘাত নতুন কিছ নয়। ১৯৪৮ সাল থেকে এ দুই দেশ মাঝেমধ্যে যুদ্ধ ও সংঘাত করছে। কখনো শুরু করে এক পক্ষ, আবার কখনো অন্য পক্ষ। শুরু হয় আক্রমণ ও প্রতি–আক্রমণ। কয় দিন চলে, তারপর যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। কখনো নিজেদের প্রচেষ্টায়, আবার কখনো অন্যদের মধ্যস্থতায়। এর আগের বড় যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৬৫ সালে, যা ১৭ দিন স্থায়ী ছিল। আসল যুদ্ধ শেষ হলেও এ দুই দেশের ঠান্ডা যুদ্ধ ও বাগ্বিতণ্ডা বছরের পর বছর চলতেই থাকে।
ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ যেভাবেই শুরু হোক না কেন, শেষটা মোটামুটি বলে দেওয়া যায়। যুদ্ধ শেষে, আজাদ কাশ্মীর ‘আজাদ’ই থাকবে। ভারত অধিকৃত কাশ্মীর ভারতের অংশ হয়েই থাকবে। সীমান্তের দুই পাশে অনেক সাধারণ মানুষ মারা যাবে দুই পক্ষেই। ভারতের কয়েকজন জেনারেলকে ভূষিত করা হবে ‘পরম বীরচক্র’ ও ‘মহাবীরচক্র’—এসব পদকে। পাকিস্তানি জেনারেলরা পাবেন ‘নিশানে হায়দার’ ও ‘নিশানে ইমতিয়াজ’। স্থগিত আইপিএল আবার শুরু হবে। শুরু হবে পিসিএলও। সবই আবার ঠিকঠাক। তাহলে যুদ্ধটা কেন হলো?
পৃথিবীর অন্য জায়গায় যুদ্ধ কেন হয়? ইউক্রেনের যুদ্ধে রুশরা ইউক্রেনের কিছু জায়গা দখল করতে চায়। কারণ, ওই জায়গাগুলোর অধিবাসীরা রুশ বংশোদ্ভূত। ইসরায়েল ফিলিস্তিনের জায়গা দখল করতে যুদ্ধ করে; কারণ, তাদের অনেক জায়গা দরকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ইহুদিদের তাদের ‘স্বপ্নের দেশ’ ইসরায়েলে স্থান দিতে।
ভারতের এই যুদ্ধে এসব জায়গাজমি দখলের ব্যাপার নেই। এবারের ভারত–পাকিস্তানের যুদ্ধটা হলো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘হিন্দু প্রাইডের’ যুদ্ধ। এর নাম নামও দেওয়া হয় ‘অপারেশন সিঁদুর’। শুরু হয়েছিল কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলাকে নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদের বাগ্যুদ্ধ দিয়ে। এই কথার যুদ্ধ দিয়ে ব্যাপারটা চাপা দেওয়া যেত।
কিন্তু মোদির ওপর পাকিস্তানের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো থেকে চরম চাপ শুরু হলো। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উগ্র হিন্দু জাতীয়বাদী আদর্শ সামনে রেখে রাজনীতি করেন এবং হিন্দু ভোটারদের কড়া সমর্থন নিয়ে বারবার প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। কাশ্মীরের এই হামলার জবাব না দিলে তাঁর ভোট ব্যাংকে ধস নামবে। তাই তিনি জেনারেলদের নির্দেশ দিলেন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে। মোদ্দাকথা, পাকিস্তানকে শাস্তি দিয়ে মোদির ‘হিন্দু প্রাইড’ ও হিন্দু ভোট ব্যাংক টিকিয়ে রাখাই ছিল এ যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য।
সব মিলিয়ে দেখা যাবে মোদির ‘হিন্দু প্রাইডের’ যুদ্ধ মোদির জন্য সম্ভবত হিতে বিপরীত হলো।
পাকিস্তানও আঁচ করে নিয়েছিল যে ভারতীয় হামলা আসছে। ভারতের সঙ্গে যেকোনো সংঘাত মোকাবিলা করতে পাকিস্তানি জেনারেলরা মোটামুটি সব সময় প্রস্তুত থাকেন। আসলে এটাই পাকিস্তানের জাতীয় আকাঙ্ক্ষার একটা মূল স্তম্ভ। জন্মের পর থেকেই এই ‘ভারত জুজু’র ভয় দেখিয়ে পাকিস্তানি জেনারেলরা কখনো সামরিক শাসন দিয়ে, কখনো বেসামরিক প্রক্সি দিয়ে দেশ শাসন করছেন। যেহেতু ভারতের সঙ্গে বেশির ভাগ সংঘর্ষই কাশ্মীরকে ঘিরে, একে জেনারেলদের ‘কাশ্মীর কার্ড’ নাম অভিহিত করা হয়। পাকিস্তানি জেনারেলদের ‘কাশ্মীর কার্ড’ আর মোদির ‘হিন্দু প্রাইড’ হয়েছিল মুখোমুখি।
যুদ্ধটা ভারত বলেকয়েই শুরু করেছে। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি দেখে অনেকেই প্রশ্ন করছেন, ভারত যুদ্ধে যাওয়ার আগে তাদের ‘হোম ওয়ার্ক’ কি ঠিকমতো করেছে? যুদ্ধ ভারতীয়রা যে রকম চেয়েছিল, সে রকম কি হয়েছে? নাকি এই যুদ্ধ মোদির জন্য হিতে বিপরীত হলো?
যুদ্ধের শুরুতেই আধা ঘণ্টার মধ্যেই ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তর কয়েকটা ‘কাশ্মীরি ট্রেনিং ক্যাম্প’ ধ্বংস করে। ভারত দাবি করে আসছে, এগুলো থেকেই কাশ্মীরে হামলাকারীদের ট্রেনিং দেওয়া হয়। পাকিস্তান যদি চুপচাপ প্রাথমিক হামলা হজম করে নিত, তাহলে যুদ্ধটা হয়তো তখনই থেমে যেত। আর মোদি তাঁর লোকদের অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য দেখিয়ে, ‘হিন্দু প্রাইড’ পুনরুদ্ধার করতে পারতেন। কিন্তু পাকিস্তান তাদের জাতীয় অহংকার বিসর্জন দেবে কেন?
পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সমানতালে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে গেছে। যুদ্ধের প্রথম পর্বটা দুই পক্ষেই সীমাবদ্ধ ছিল মোটামুটি বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুকে ঘিরে। যদিও যুদ্ধবিমান, ড্রোন ও মিসাইল—সবই ব্যবহার করা হয়েছে।
রয়টারের খবরে বলা হয়েছে, পাকিস্তান বিমানযুদ্ধে ছিল এগিয়ে, ভারতের কমপক্ষে দুটি ফ্রান্স নির্মিত সর্বাধুনিক রাফাল যুদ্ধবিমানকে পাকিস্তান ভূপাতিত করেছে তাদের চীনে নির্মিত অত্যাধুনিক জে-১০সি ফাইটার বিমানের সাহায্যে। এই প্রথম কোনো যুদ্ধে চীনা জে-১০সি ব্যবহার করা হলো। চীন এই যুদ্ধে তাই অনেক লাভবান।
ড্রোনযুদ্ধে দুই দেশই সমানতালে ছিল। ভারতের আছে ইসরায়েলে তৈরি ড্রোন। পাকিস্তানের তুরস্কের তৈরি। মিসাইল দুই দেশ নিজেরাই তৈরি করছে। তা সমানতালে ব্যবহার করা হয়েছে।
কলকাতার বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা জম্মুতে মিসাইল হামলার বিবরণ দিয়েছে এভাবে, ‘জম্মুর আকাশে উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল বল, বিয়ের রোশনাই নাকি? সংবিত ফিরল হ্যাঁচকা টানে, ওগুলো সব মিসাইল!’ দুই দেশের ১৯৬৫ সালের ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ মূলত ছিল একে অন্যের জায়গা দখল করার যুদ্ধ। এবার জায়গা নিয়ে যুদ্ধ হয়নি। তাই ট্যাংক ব্যবহার করা হয়নি তেমন।
যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে পাকিস্তান ও ভারত দুই পক্ষই একে অপরের সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলোয় হামলা করে। তখনই আশা করা হচ্ছিল, বিশ্বের মুরব্বিরা এই যুদ্ধ আরও বিস্তৃত হওয়ার আগেই পারমাণবিক অস্ত্রধারী এ দুই দেশ যুদ্ধ থামাবে। হলোও তা–ই।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গতকাল শনিবার ঘোষণা দিয়েছেন, ‘সারা রাত ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার ফলে’ ভারত ও পাকিস্তান অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি হয়েছে। পাকিস্তান ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ঘোষণায়ও যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়েছে। যুদ্ধ থেমে যাবে। শুরু হবে জয়-পরাজয়ের হিসাব।
ভারতীয় বিরোধী দল যুদ্ধের সময় চুপচাপ থেকে সমর্থন জানিয়ে আসছিল। এখন প্রশ্ন উঠবে, এ যুদ্ধে ভারত কী পেল? যেভাবে ভারতীয় হামলার জবাব দিয়েছে, তাতে পাকিস্তান এই যুদ্ধ থেকে ভারতের চেয়েও বেশি সমীহ আদায় করে নিয়েছে, তা বলে দেওয়া যায়। কিন্তু এখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘হিন্দু প্রাইডের’ কী হবে? মোদি বোধ হয় এই যুদ্ধ লাগিয়ে তাঁর ও ভারতের সম্মানের অনেক ক্ষতি করেছেন। এমনিতে মোদির দলের লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই।
বিজেপি বিহারের নীতীশ কুমারের জনতা পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন করে সরকার বাঁচিয়ে রেখেছে। গত নির্বাচনে মোদির দল অনেক আসন হারিয়েছিল। এবার এই যুদ্ধের পর মোদির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। যুদ্ধের লাভ-ক্ষতি আর মোদির নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধী দল, এমনকি হিন্দুত্ববাদী দলগুলো থেকেও প্রশ্ন আসবে। অনেকেই বলবেন, মোদির রাজনীতির শেষের বোধ হয় এবার শুরু হবে।
সব মিলিয়ে দেখা যাবে মোদির ‘হিন্দু প্রাইডের’ যুদ্ধ মোদির জন্য সম্ভবত হিতে বিপরীত হলো।
- সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
- [email protected]