যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিস্তৃত বিশ্লেষণ

logo

ড. সিরাজুল আই. ভূইয়া

(৭ মিনিট আগে) ১১ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ৯:৪৩ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৯:৪৪ পূর্বাহ্ন

mzamin

facebook sharing button

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং সাম্প্রতিক মূল্যায়ন

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক  সমাবেশে সাবেক মার্কিন কূটনীতিক জন এফ. ড্যানিলোভিচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতীতের দিনগুলির কথা উপস্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের প্রতি বৈদেশিক নীতি, বিশেষ করে  ‘ওয়ান-ইলেভেন’ সময়ের উপর তিনি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সেই যুগে ২০০৭ সালে সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ড্যানিলোভিচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছেন। গণতান্ত্রিক স্থিতিস্থাপকতা রক্ষার জন্য  প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি, সেইসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ তদারকির কথাও তুলে ধরেছেন।

‘মাইলাম এবং জনের সাথে সংলাপ’ শিরোনামের (“Dialogue with Milam and John)এই অনুষ্ঠানটি ১৯৭১ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের গতিপথ পুনর্বিবেচনা এবং পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে আসছে।আলোচনায় চলমান চ্যালেঞ্জগুলি তুলে ধরা হয়েছে, যেমন ক্ষমতাসীন দলগুলির মধ্যে বৃহত্তর জবাবদিহিতার প্রয়োজনীয়তা এবং কর্তৃত্ববাদী প্রবণতাগুলিকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার জন্য সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ককে  শক্তিশালী করা। এই আলোচনা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং শাসনব্যবস্থার সূক্ষ্মতা সম্পর্কে আরও গভীর অনুসন্ধানের দাবি রাখে। এই ধরনের বিশ্লেষণগুলি ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ড কীভাবে সমসাময়িক রাজনৈতিক আবহাওয়াকে প্রভাবিত করে তা বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক। শুধু তাই নয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া এবং গণতান্ত্রিক সমর্থনের উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতের যোগাযোগের পথ প্রশস্ত করতে সহায়তা করে।

বর্তমান চ্যালেঞ্জ এবং তথ্য বিভ্রাটের  সংকট

জন এফ. ড্যানিলোভিচ  বাংলাদেশ সম্পর্কে  একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন। একটি  ভুল তথ্য দ্বারা সমন্বিত পরিমণ্ডল  বা ‘তথ্য যুদ্ধ’ বাংলাদেশের  সমাজের কাঠামো এবং এর আন্তর্জাতিক অবস্থানের ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রাম্পের আমলে মার্কিন সামরিক কার্যকলাপ সম্পর্কিত তথ্য বিকৃতি এবং মার্কিন আর্থিক সহায়তা সম্পর্কিত বিভ্রান্তিকর বর্ণনাগুলি দেখায় যে ভুল তথ্য কীভাবে জনসাধারণের ধারণা এবং নীতিগত প্রতিক্রিয়াকে বিভ্রান্ত করে দিতে পারে। এই ভুল উপস্থাপনা কেবল অভ্যন্তরীণ গতিশীলতাকেই জটিল করে তোলে না, এগুলি বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ক্ষয় করার ঝুঁকিও তৈরি করে। পাশাপাশি এর বিশ্বব্যাপী ভাবমূর্তির উপরও প্রভাব ফেলে। এই ধরনের ভুল তথ্যের পরিণতি বহুমুখী এবং সুদূরপ্রসারী। অভ্যন্তরীণভাবে, এটি সরকার এবং তার নাগরিকদের মধ্যে আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যা সামাজিক সম্প্রীতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিকভাবে, এটি বৈদেশিক নীতির মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে এবং গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি করতে পারে। একইসঙ্গে অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নমূলক সহায়তা আলোচনার উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

বিকৃত সত্য এবং আংশিক বাস্তবতার এই দৃশ্যপট  মিডিয়ার সততা এবং তথ্যের দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। জনসাধারণের কাছে প্রচারিত তথ্যের নির্ভুলতা নিশ্চিত করা কেবল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা রক্ষা করার জন্য নয় – এটি জাতির ভবিষ্যত রক্ষা করার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। জর্জ অরওয়েল যেমন যথার্থ  বলেছেন, ‘প্রতারণার যুগে সত্য বলা একটি বৈপ্লবিক  কাজ।’ গণতন্ত্র রক্ষার জন্য বাংলাদেশকে এই বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ভুল তথ্যের প্রভাব প্রশমিত করার লক্ষ্যে মিডিয়ার  ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে যা জনগণকে তথ্যের সত্যতা যাচাই  এবং সমালোচনামূলকভাবে মূল্যায়ন করার বিষয়ে দায়িত্বশীল করে। সাংবাদিকতার মান জোরদার করা এবং সরকার ও গণমাধ্যম উভয় কার্যক্রমে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা ভুল তথ্যের জোয়ারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশ যখন তার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তখন নাগরিকদের ভূমিকা এখানে  ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই সম্পৃক্ততা হলো সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর একটি স্থিতিস্থাপক এবং আলোকিত গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলা যেতে পারে। যা নিশ্চিত করে যে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মিথ্যা দ্বারা নির্ধারিত হবে না বরং সত্য দ্বারা পরিচালিত হবে।

ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা এবং গণতান্ত্রিক পথ

জন এফ. ড্যানিলোভিচ তার দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের মধ্যে বর্ধিত সহযোগিতার সম্ভাবনার উপর জোর দেন, বিশেষ করে গণতন্ত্রের বিকাশ এবং মানবাধিকার সুরক্ষায়। ২০০৭-২০০৮ সাল থেকে শিক্ষা নিয়ে (যখন মার্কিন নীতিগুলি অর্থপূর্ণ গণতান্ত্রিক সংস্কারের পরিবর্তে নির্বাচনের ওপর অযৌক্তিক জোর দিয়ে অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলির ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছিল) ড্যানিলোভিচ গণতন্ত্রের মূল নীতিগুলির পুনর্নবীকরণের পক্ষে কথা বলেন। এই  বোধগম্যতা দরকার যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি করে তৈরি করলেও, তা পর্যাপ্ত নয়। তাদের অবশ্যই শক্তিশালী শাসন কাঠামো দ্বারা পরিচালিত হতে হবে যা স্বচ্ছতাকে সমর্থন করে, ক্ষমতাকে জবাবদিহি করে এবং সংলাপ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নাগরিক সমাজকে সক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত করে। এই প্রক্রিয়াগুলির মাধ্যমেই গণতন্ত্র সমৃদ্ধ হয় এবং পশ্চাদপসরণের ঝুঁকি কমে। ড্যানিলোভিচের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে লাভবান হতে পারে। এই ধরনের সহযোগিতা বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেতে পারে:

১. শাসন সংস্কারের যৌথ উদ্যোগ:  এই উদ্যোগের  মধ্যে এমন বিনিময় কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে যার মাধ্যমে উভয় দেশের কর্মকর্তারা শাসন, দুর্নীতি দমন এবং জনপ্রশাসনের সর্বোত্তম অনুশীলনগুলি ভাগ করে নিতে পারে।

২. নাগরিক সমাজকে শক্তিশালী করা : মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক সম্পৃক্ততার পক্ষে কাজ করে এমন বেসরকারি সংস্থা এবং তৃণমূল পর্যায়ের আন্দোলনগুলিকে সমর্থন করা, যার ফলে আরও স্থিতিশীল নাগরিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব  হবে।

৩. স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির ব্যবস্থা:  এমন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা যা নিশ্চিত করে যে সরকারি কর্মকাণ্ড জনগণের সামনে দৃশ্যমান এবং কর্মকর্তারা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। যার ফলে দুর্নীতি হ্রাস পাবে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর আস্থা বৃদ্ধি পাবে।

৪. শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক বিনিময়: যুবসমাজ এবং ভবিষ্যৎ নেতাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের গভীর উপলব্ধি গড়ে তোলার জন্য গণতান্ত্রিক শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এমন কর্মসূচির  প্রচার করা।

৫. শাসনব্যবস্থায় প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নাগরিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো।  যা নাগরিকদের সমস্যাগুলি রিপোর্ট করতে, প্রতিক্রিয়া জানাতে এবং তাদের সরকারের সাথে সরাসরি ও  স্বচ্ছভাবে যোগাযোগ করতে সাহায্য করে।

এই কৌশলগুলিকে একীভূত করার মাধ্যমে, দু দেশের অংশীদারিত্ব কেবল গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ রোধ করার জন্যই নয়, বরং আরও গভীর গণতান্ত্রিক পথকে প্রশস্ত করতে পারে। অ্যালেক্সিস ডি টোকভিল একবার নিজের পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক সমাজের স্বাস্থ্য পরিমাপ করা যেতে পারে বেসরকারি নাগরিকদের দ্বারা সম্পাদিত কাজের মানের দ্বারা।’ যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা আরও গভীর করার প্রতিশ্রুতি একটি স্থিতিশীল এবং গতিশীল গণতান্ত্রিক নীতিমালা গঠনের  জন্য  শক্তিশালী কাঠামো হিসেবে কাজ করতে পারে। শুধু তাই নয় এটি  উভয় দেশের নাগরিকদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা যাতে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করবে।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা জোরদার করার জন্য যা প্রয়োজনীয় :

১. আইনের শাসন জোরদার করা: আইনি প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা নিশ্চিত করবে যে সরকারি কর্মকর্তাসহ সকল সত্তা আইনের আওতায় জবাবদিহি করার জন্য তৈরি থাকবে।

২. সুশীল সমাজকে উৎসাহিত করতে হবে: গণতন্ত্রের জন্য একটি প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি বিভিন্ন স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সরকারকে জবাবদিহি করে। এনজিও এবং তৃণমূল পর্যায়ের সংস্থাগুলিকে সমর্থন করলে নাগরিকদের বৃহত্তর অংশগ্রহণ এবং তদারকি সহজতর হতে পারে।

৩. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বৃদ্ধি : গণতন্ত্রে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং নাগরিক সাংবাদিকতাকে সমর্থন করলে তা  ভুল তথ্যর প্রবাহকে  প্রতিরোধ এবং একটি সচেতন ভোটারমণ্ডলী গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে।

৪. শিক্ষাগত সংস্কার: গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কার্যকরভাবে জড়িত হতে পারে এমন একটি রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত সমাজ গড়ে তোলা প্রয়োজন।

সেই উদ্দেশে নাগরিক শিক্ষা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে উৎসাহিত করে এমন শিক্ষামূলক উদ্যোগ অপরিহার্য।

সমাপ্তি

জন এফ. কেনেডি যথার্থই বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র কখনই চূড়ান্ত অর্জন নয়। এটি এমন একটি চেতনা যা ক্রমাগত রক্ষা এবং লালন করতে হবে।’ সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) অনুষ্ঠানে জন এফ. ড্যানিলোভিচ এবং উইলিয়াম বি. মাইলামের মতো অভিজ্ঞ কূটনীতিকরা যে অন্তর্দৃষ্টি ভাগ করে নিয়েছেন তা এই স্থায়ী সত্যের সাথে গভীরভাবে অনুরণিত হয়। তাদের প্রতিফলন কেবল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটই নয় বরং দূরদর্শী কৌশলও প্রদান করে যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ উভয়ের জন্যই ফলপ্রসূ হতে পারে। বাংলাদেশ যখন তার জটিল রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে, তখন আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।  এইসময়ে স্বল্পমেয়াদী সুবিধার পরিবর্তে গণতান্ত্রিক অখণ্ডতার নীতিগুলিকে লালন ও সমুন্নত রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উপর টেকসই সংলাপ যেমন প্রয়োজন, তেমনি  সহযোগিতার হাত প্রশস্ত করতে হবে। এই ধরনের অটুট সম্পৃক্ততার মাধ্যমেই আমরা আরও স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে পারি।

 

ডঃ সিরাজুল আই. ভূঁইয়া, একজন অধ্যাপক এবং জর্জিয়ার সাভান্না স্টেট ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here