যুক্তরাষ্ট্রের চীন নীতির পরোক্ষ ক্ষতি হ্রাসের সম্ভাব্য উপায়

bonikbarta.net

শ্যাং-জিন ওয়েই   জুলাই ১৫, ২০২৩

 

চীনা রফতানি পণ্য ও চীনে মার্কিন বিনিয়োগের ওপর ওয়াশিংটনের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে দূরপ্রাচ্যের ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী অর্থনীতিটি একটা বড় আকারের ধাক্কা খাবে, যার ফলে দুটি দেশের মাঝে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু হাইনান দ্বীপের মতো বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ব্যাপারে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র ঐকমত্যে পৌঁছতে পারলে পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ ও ভূরাজনৈতিক সংঘাতের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান চীনের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে উঁচু দেয়ালঘেরা ছোট উঠানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন সামরিক শক্তিকে অপ্রতিরোধ্য করার নিমিত্তে চীনের সামরিক সামর্থ্যকে আঘাত করাই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা জারি করা সত্ত্বেও মার্কিন নীতিনির্ধারকরা এখনো জলবায়ু পরিবর্তন, ফেন্টানাইল নিয়ন্ত্রণ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কিংবা পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের মতো বৈশ্বিক ইস্যুতে চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার আশা পোষণ করেন। এ বার্তা নিয়ে মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি জ্যানেট ইয়েলেন সম্প্রতি চীন সফরে গিয়েছিলেন এবং সেক্রেটারি অব স্টেট আন্থনি ব্লিঙ্কেন গত মাসে চীন সফর শেষ করে ফিরেছেন।

সেমিকন্ডাক্টর কিংবা তা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রপাতি রফতানির ওপর আঘাত হানাই চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য। নিষেধাজ্ঞার আওতায় পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে—বিদ্যুৎ কুপরিবাহী অন্তরক, লুব্রিক্যান্ট, অতিবিশুদ্ধ পানি, চিপ বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় ২০টির অধিক যন্ত্রাংশ, যেগুলোর বৈশ্বিক বাজার নিয়ন্ত্রণ করে গুটিকয়েক মার্কিন, জাপানিজ ও ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান।

নিম্ন ও মাঝারি মানের সেমিকন্ডাক্টরের বৈশ্বিক চাহিদার ২০ শতাংশ জোগান দেয় চীন। চীনে উৎপাদিত নিম্ন ও মাঝারি মানের সেমিকন্ডাক্টরগুলো মূলত বৈদ্যুতিক যানবাহন, মেডিকেল যন্ত্রপাতি, সাধারণ বৈদ্যুতিক পণ্যাদি ও শিল্প-কারখানার বিভিন্ন যন্ত্রে ব্যবহার করা হয়।

রফতানি ও বিনিয়োগের ওপর পশ্চিমা এ নিষেধাজ্ঞার কারণে চীনা শিল্প-কারখানাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফলে চীনের অর্থনীতি একই সঙ্গে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে এবং চীন মাথাপিছু আয় ও রাজস্ব কমে যাবে এবং অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পিছিয়ে পড়বে। এসব বৈরী প্রভাবের কারণে চীনা নীতিনির্ধারকরা সুলিভান কথিত ‘উঁচু দেয়ালঘেরা ছোট উঠান’ সদৃশ নিষেধাজ্ঞাকে বিরূপ দৃষ্টিতে দেখবে এবং বৈশ্বিক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করতে অনাগ্রহী হবে।

তবে আগামী কয়েক বছর চীনের ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার কুপ্রভাব চীনা অর্থনীতিতে ততটা পরিলক্ষিত হবে না, কারণ চীনা কোম্পানিগুলো আগে থেকে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞাধীন পণ্যাদি মজুদ করে রেখেছিল। কিন্তু যদি চীনের অভ্যন্তরীণ শিল্পনীতি চিপ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে চীন উৎপাদিত চিপ ও বিশ্বের অন্যত্র উৎপাদিত চিপের গুণগত মানের মাঝে ব্যাপক ফারাক দেখা দেবে।

মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কথিত ‘চীনের শ্রেষ্ঠ সময়’ ধারণা অনুসারে, চীন এরই মধ্যে তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাতে চীনের প্রতিরোধশক্তি এখনই সবচেয়ে সেরা অবস্থানে আছে কিংবা অতিনিকট ভবিষ্যতে সেরা অবস্থানে পৌঁছবে। যেহেতু চীনের প্রবৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির নিচে শিগগিরই নামবে না, সেহেতু ‘চীনের শ্রেষ্ঠ সময়’ অনুমিতিটি অর্থনীতির মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

কিন্তু বাইডেন প্রশাসনের রফতানি ও বিনিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা চীনকে তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে  উৎসাহিত করবে। বিশেষত, মার্কিন ও পশ্চিমা প্রযুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন খাতে এবং সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহারকারী অন্যান্য শিল্প খাতে চীনের অগ্রযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করছে।

চীনের অপেক্ষা যত দীর্ঘায়িত হবে, দুই দেশের মাঝে প্রযুক্তিগত দূরত্ব তত বাড়বে। ফলে নিষেধাজ্ঞাসৃষ্ট বাধা উতরানোর জন্য অন্য কোনো উপায় খুঁজে না পেলে চীন হয়তো সম্ভাব্য সামরিক সংঘাতের জন্য প্রস্তুত হবে। এ ধরনের সংঘাত এড়ানোই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য।

কাজেই চীনের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার উপায় খুঁজে বের করলে সব পক্ষের জন্য লাভজনক হবে। উপায়গুলোর একটা হচ্ছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা। দুই দেশ এ ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছলে চীন তার সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনকারী কারখানাগুলো হাইনানের মতো বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় স্থানান্তর করতে পারবে।

তবে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীন অনুমোদিত আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের জন্য চীনকে বিশেষ ভিসার ব্যবস্থা করতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিদর্শকরা যখন ইচ্ছা এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শনের স্বাধীনতা রাখবেন। তাদের কাজ হবে এটা নিশ্চিত করা যে এসব অঞ্চলে শুধু নিম্ন ও মাঝারি মানের চিপ উৎপাদন হচ্ছে।

চীনের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত উদ্বেগ হ্রাসের জন্য আন্তর্জাতিক পরিদর্শকরা তাদের বিশেষ ভিসায় চীনের অন্যত্র ভ্রমণের সুযোগ পাবেন না। চীনের অন্যত্র ভ্রমণের জন্য তাদের নিয়মিত ভিসা লাগবে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে আরেকটা ব্যাপার নিশ্চিত করবে যে চীন নিষিদ্ধ পণ্যগুলো চীন অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবে।

বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো চীনের অর্থনীতির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরোক্ষ ক্ষতি হ্রাসে সহায়তা করবে এবং বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির মতো অসামরিক শিল্প খাতে বৈশ্বিক বাজারে চীনের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বজায় রাখতে সহায়তা করবে।

বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ব্যাপারে দুই দেশ ঐকমত্যে পৌঁছলে মার্কিন কোম্পানিগুলো চীনের মূলভূমিতে তাদের ব্যবসা অব্যাহত রাখার সুযোগ পাবে এবং এর ফলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জনসংখ্যার বাজার থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে না। আর বেসামরিক শিল্প খাতে আঘাত না এলে চীন হয়তো জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক ইস্যুগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতায় বেশি আগ্রহী হবে।

সবচেয়ে বড় কথা, দুই দেশের মাঝে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব বজায় থাকলে চীন যুদ্ধের দিকে ধাবমান হবে না। সম্ভাব্য সামরিক সংঘাত এড়ানোর এ সমাধান বাকি বিশ্বকে উপকৃত করবে, কেননা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর কারণে চীন বৈশ্বিক উৎপাদন অঞ্চল হিসেবে তার ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখতে পারবে।

ইউরোপসহ বাকি বিশ্বের দেশগুলোর কোম্পানিগুলোও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মধ্য দিয়ে চীনের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য চলমান রাখবে, যা ওইসব দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান ও রাজস্বের সুযোগ অক্ষুণ্ণ রাখবে। এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

শ্যাং-জিন ওয়েই: এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ এবং কলাম্বিয়া বিজনেস স্কুল ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের অর্থনীতি ও ফাইন্যান্সের অধ্যাপক

ভাষান্তর: জামান মঞ্জু